অামার লাল রুমালের পাশে শচীর দেওয়া গােলাপী রুমালটি রাখলাম। পেছনের বা পকেটে রাখাই আমার অভ্যেস। নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে করে সমস্ত ঘটনাটা একবার ভেবে নিলাম।
বেজির খাঁচার ওপর একটা কাপড় দিয়ে ঢেকে দিলাম। সবাই বলল বেজিটা ছেড়ে দিতে। আমি বললাম, না পুষব। আমার সঙ্গী হবে সে। শচী তো এক রকম জোর শুরু করল ছেড়ে দেবার জন্যে। আর সে জন্যেই জেদ করে পোষার সিদ্ধান্ত নিলাম। প্রথম দিনেই কিন্তু বেজিটা শচীর নেওটা হয়ে গেল।
ব্যাপারটা খুলেই বলি। আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু বাবুর শ্বশুরবাড়িতে শচীর সঙ্গে পরিচয়। নিয়ম অনুযায়ী বিয়ে হয় বাবুর বাড়িতে। এটাই আমাদের রীতি। বিয়ের পরদিন বর শ্বশুরবাড়িতে যায় কনেকে নিয়ে। সঙ্গে থাকে বন্ধু-বান্ধব, ছােট ভাই-স্থানীয় আত্মীয় ও বোনজামাইরা। অন্ধকার রাতে হ্যাজাক বাতি জ্বালিয়ে পাঁচ মাইল হেঁটে আমরা বাবুর শ্বশুরবাড়িতে পৌছি। সেখানে শচীর সঙ্গে পরিচয়।
বসন্তের সেই রাতে শচী আমাকে নিয়ে গিয়েছিল ওদের গ্রামের নদীর কূলে। সঙ্গে আরও একজন ছিল। সে কৃষ্ণপক্ষের সমীর চাঁদ।
আমি জানি রুমালটী আমার জন্যে সে সেলাই করে নি। এও জানি, এটা আমাকে দেওয়ার জন্যেই ঘাসের ওপর পেতে দিয়েছিল। সে বসে ছিল ঘাসের ওপর। ওঠার সময় বলল, এটা আপনি রাখুন।
পরদিন গানের আসর বসল । শচী গান গেয়েছিল। দুপুরে সাঁতার কেটে নদী পেরিয়ে কাশবনের গভীরে চলে যাই একা একা। মাথার নিচে দু-হাত রেখে অকশি পাহারা দিতে দিতে অনেকক্ষণ শুয়ে ছিলাম। সবাই ফিরে গেল আমাকে ফেলে । আমি উঠে পুরো কাশবন জরিপ করে একটা বেজির ছানা ধরি।
ততক্ষণে নৌকোতে করে অামাকে খুঁজতে এল ওরা। চিৎকার করে ডেকে খুজে বের করল। অামার হাতে বেজির ছানা। ওরা ভেবেছিল আমার কোনো বিপদ হয়েছে, কোনো দুর্ঘটনার শিকার হয়েছি। নেউল ছানাটি (তুলতুল) একটা খাঁচায় পুরলাম। সেদিন থেকে তুলতুল আমার বন্ধু হয়ে গেল। এরপর আরও দু বার শচীদের বাড়িতে গিয়েছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে ছিল তুলতুল। সেও শচীর প্রিয় হয়ে উঠল।
শচী তামার এক ক্লাস নিচে পড়ে। ওদের গ্রামেই ওর কলেজ। সেবার শরতের ছুটিতে শহর থেকে আমি গ্রামে এলাম আর শচী একা বাবুদের বাড়িতে। বাবুর বাবা মারা যাওয়ায় পড়া ছেড়ে তাকে বিয়ে করতে হল। জমিজমা চাষবাস দেখা ছাড়া ওর কোনো উপায় রইল না। আমার শুরু হল শচী থেকে পালিয়ে বেড়ান। শচীর আসার খবর পেয়ে আমি তৈরি হয়ে গেলাম হোস্টেলে চলে যেতে। বাবু আমাকে ডাকতে পাঠান। আমি ততক্ষণে কাপড়-চোপড় বোঁচকা বেঁধে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েছি। পথেই বাবুদের বাড়ি। ওর সামনে দিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। উঠতি পা থেমে যায়। শচীকে একবার না দেখে যাই কি করে ? আমার নিজের অজান্তে রাস্তা থেকে বাবুদের বাড়ির ঘাটায় পা বাড়ালাম।
ওদের বাড়ির দীর্ঘ ঘাটা পেরিয়ে পুকুর। পুকুরের পাশে বড় উঠান, মধবী ও অপরাজিতার ঝাড় এবং সেখানে শচী দাড়িয়ে,আছে। ওকে দেখতে পেয়েই তুলতুল এক লাফে ওর কাছে চলে যায় অার কি। আমি টান টান করে ওকে বাধ্য করলাম সংযত হতে। কিন্তু ওযে নিরীহ বেজি মাত্র, ওকে থামাই কতক্ষণ!
শচী মাধবীলতার ঝােপের নিচে দাড়িয়ে পুকুরের দিকে তাকিয়ে রইল। আমাকে দেখে নাকি না দেখে আমি বলতে পারব না। ওকে ডাকব কি ডাকব না বুঝে উঠতে পারলাম না। এক বার ভাবলাম না ডেকে চলে যাই। তাহলে তো এতদূর আসার অর্থ হয় না। আমার ভালোলাগা বা অবহেলারও মনে থাকে না।
শচীর পাশে গিয়ে বললাম, আমি যাচ্ছি। শচী চমকে এবং ঝলমলে চোখে চুপ করে তাকিয়ে রইল কিছু ক্ষণ। তুলতুল তখন চিঁ চিঁ করে ওর পা গুঁকছে। বলল, বীঃ কী সুন্দর বড় হয়ে গেছে ? তারপর ওকে আদর করতে করতে আমার দিকে তাকিয়ে না তাকিয়ে বলল, কোথায় চললেন? শচী বোধহয় ভাবল আমার কলেজ খোলা। তাই যেন তাড়াতাড়ি বলল এ কদিন পরে গেলে হয় না?
তুলতুল তখন দু পায়ে দাঁড়িয়ে দুরে কি যেন দেখল। আমিও এক মুহর্ত ভাবলাম। তারপর বললাম, হ্যা, তুলতুল এখন আমার সারাক্ষণের সঙ্গী, আমার সঙ্গে এক বিছানায় শোয়। আমি কলেজে গেলে একা থাকে আমার কামরায়। আমার বন্ধু।
আমি থাকব না বুঝে শচী হঠাৎ করে বলল, আমাকে কিছু টাকা দিতে পারেন? আমি অবাক হয়ে ভাবলাম, শচী আমার কাছে এভাবে টাকা চাইছে কেন? কোনো কারণ খুঁজে না পেয়ে তাড়াতাড়ি পকেট থেকে টাকা বের করলাম। সঙ্গে শচীর দেওয়া রুমালও বেরিয়ে এল। রুমালটা যে কী করে টাকার পকেটে এল বুঝতে পারলাম না, কারণ ওটা থাকার কথা পেছনের বাঁ পকেটে। যাক গে ; শচী দেখেও না দেখার ভান করে রইল। তামি খুচরো টাকাগুলো রেখে একটা নোট ওর হাতে তুলে দিলাম।
শচী শুধু বলল, এভাবে টাকা চাইলাম বলে অামাকে খুব ছোট ভাবছেন না তো? আমি বলতে পারতাম, না নিলে নিজেকে খুব ছোট মনে করব।
সে অবাব বলল, অত দরকার নেই। খুচরোগুলাে দিলেই চলবে। হঠাৎ দরকার হয় পড়ল।
তবুও কিছুতেই মেলাতে পারলাম না ওর টাকা চাওয়ার ব্যাপারটা। ওর সম্পর্কে কোনো সিদ্ধান্তেই পৌছুঁতে পারলাম না। আরও কিছুক্ষণ থাকার পর শচী প্রায় অদেশের মতো বলল, আপনি আর দেরি করবেন না। সন্ধে হয়ে এল, আপনার যাওয়া উচিত। তারপর তুলতুলকে আদর করে গোমড়া মুখে আমাকে বিদায় দিল।
বাসে প্রায় তিরিশ মাইল যেতে হবে। সেটাও খুব দূরত্ব কিছু নয়। চেনা-জানা পথ। রাতবিরেতে কত আসা-যাওয়া করি। কিন্তু তুলতুল আমাকে জানিয়ে দিল সে কোথাও যেতে রাজী নয়। একটু ধমক দিলাম। দড়ি ধরে আচ্ছা করে কিছুক্ষণ শূন্যে ঝুলিয়ে রাখলাম। কিন্তু ভেতরে ভেতরে আমি অনেকখানি দুর্বল হয়ে গেলাম। বাসে উঠে বসার সঙ্গে সঙ্গে সবকিছু দিনের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল।
অাকাশে চাঁদ উঠেছে। নদীর ওপর বালুচরে লুটোপুটি খেলছে। শচীর প্রতিটি কথার অর্থ আমার কাছে গভীর অর্থবহ হয়ে উঠতে লাগল। সে বােধহয় বোঝাতে চেয়েছে রুমালটিই আমাদের মধ্যেকার বিপিত্তির কারণ। তার জন্যেই টাকা নিয়ে মিটমাট করতে চাইছে। নামমাত্র হলেও কিছু মূল্য নিতে চেয়েছে। পাঁচ পয়সা চাইলে আমি বুঝতে পারতাম। এক টাকা চাইলেও বুঝতাম। কিন্তু শচী বোধহয় বুঝতে দিতে চায় না যে রুমালের জন্যেই আমাদের মধ্যে শত্রতা দানা বেঁধে উঠছে।
আমিও ভালোবাসি কথাটা বলতে পারছি না, সেও বলতে পারছে না হয়তো। আমারই প্রথম প্রকাশ করা উচিত বৈকি। আমি কিনা নির্বোধের মতো নিজের হাতে নিজে সব তছনছ করে চলেছি। তবুও আমি বলতে পারি নি। সেবার সে দশ দিন ছিল আমাদের গ্রামে। সেদিন বাবুর সঙ্গে দেখা না করাতে সে অপমানিত বােধ করে এবং রাগ করে আমার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দেয়। ওর কথা হল শচীকেও আমি অপমান করেছি। সাধারণ সৌজন্যবোধটুকুও আমার মধ্যে নেই। ভালোবাসা ছাড়াও তো মানুষের ভদ্রতাবোধ থাকে। শচী, বাবু ও বাবুর বউ—সকলকে আমি অপমান করেছি। বাবুর এই ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গেল।
সে-রাতে আমি আর শহরে যাইনি। আমি আবার সিদ্ধান্ত পল্টিালাম। পাঁচ মাইল হেঁটে শচীদের গ্রামে পৌছুলাম। শচীর ভাই তরুণের সঙ্গে ওদের বাড়িতে গেলাম। শচীর মা-বাবা খুশি হল। অনেক রাত পর্যন্ত তরুণের সঙ্গে নানা গল্প করলাম। তুলতুলের নানা খেলা ও বুদ্ধিমত্তার প্রমাণ দিলাম। ঘর থেকে বেরিয়ে ধরে নিয়ে এল মাছ ও ইদুর। লুকোচুরি খেলল টেবিল ও চেয়ারে বসে। বইয়ের ফাঁকে উকি মারল চমৎকার ভঙ্গি করে। শচীর পিঠোপিঠি ছােট তরুণ। ওরা ভাইবোনে চমৎকার বন্ধুত্ব।
আমিও আর লুকোচুরি না করে বললাম শচীর সঙ্গে দেখা হয়েছে।
তরুণ অবাক হয়ে বলল, শচী বাবুভাই আপনাকে ছেড়ে দিল। বললাম, তুলতুলকে ছেড়ে দিতে এসেছি। কেন? আপনার কষ্ট হবে না?
হ্যা, কষ্ট হবে। ওর সঙ্গে দীর্ঘ ছয় মাস ধরে অন্তরঙ্গতা। তবুও ছেড়ে দিতে হবে। একা একা আমার সঙ্গে থেকে ও-বেচারী তার জীবন ও জগৎ থেকে একেবারে আলাদা হয়ে যাচ্ছে। সে প্রকৃতির সন্তান, প্রকৃতির সন্তানকে প্রকৃতির মাঝে ফিরিয়ে দিতে এসেছি।
তরুণ বলল, যে কোনোখানে ছেড়ে দিলেই তো হয়।
তা হয়। তবুও ভাবছি ওর পাড়ায় ওকে ছেড়ে দেব। নিজের পাড়া, নিজের গ্রাম ও নিজের দেশ অনেক বড়।
ভোরে উঠেই তরুণ ও অমি নদী পেরিয়ে কাশবনে গেলাম। শরতের আলো হাওয়ায় কাশবন দুলছে। মাথার ওপর নীল আকাশ ও নদীর চুলেছল ঢেউয়ের শব্দ। কিন্তু আমার সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেল। ওর গলার রশি খুলে দিলাম। যেতে বললাম। ওর বাড়ি-ঘর, প্রেম ভালােবাসা ও আত্মীয়-স্বজনের কথা বললাম। আমার সঙ্গে থাকা মানে জীবন বরবাদ।
বললাম, তুলতুল, তুই মুক্ত। তোর সঙ্গী সাথী খুঁজেনে। তোর মধুময় জীবন সামনে পড়ে অাছে। যা তুলতুল, আমার ভালোবাসা নিয়ে চলে যা। আমাকে অবাক করে, হতাশ করে সে আমার পাশে ঘুরঘুর করতে লাগল। দু পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে নিঃশ্বাস টেনে টেনে কি যেন বুঝতে চেষ্টা করল। চারদিকে তাকাল। রশিটা ছুড়ে ফেলে দিলাম। আবার বললাম, তুলতুলরে অাজ থেকে তুই স্বাধীন, তোর পাড়া-পড়শিদের মাঝে ফিরে যা ।
তুলতুল গেল না। আবার বললাম, আমার পিছে পিছে ঘুরে বেড়াতে হবে না। যা যা।
সে যায় না। দু পায়ে দাঁড়ায়, এদিক-ওদিক তাকায়, ঘাস শোকে, আমার দিকে তাকায়। আবার বললাম, তুলতুল, তুই কি স্বাধীনতা চাস না? যেদিকে দু চোখ যায় চলে যা।
না, ওর কোনো ভাবান্তর নেই।
যাওয়ার আগ্রহ নেই। ধমক দিলাম। সে চমকে লাফিয়ে প্যান্টের পা বেয়ে উঠতে চাইল। নিচে নেমে আমার দিকে তাকাল করুণ চোখে। হ্যাঁ, আমি ওর অনেক কিছু বুঝি। রাগ, আনন্দ ও বিষাদ আঁচ করতে পারি।
তুলতুল স্বাধীন সিদ্ধান্ত নিয়ে আমার সঙ্গে রয়ে গেল। আমার ও আর কিছু করার নেই। এমনিতেই তো আমি ওকে ছেড়ে দেব বলে হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিয়েছি। শচী ওর গ্রামে ফিরলে আমাকে নিয়ে যাতে ভাবে,তার পথ করে দিলাম। শচী বুঝুক, শচী আরও বেশি আমাকে ভালোবাসুক আমি ওর ভালোবাসা আদায় করে নিতে চাই ওকে মূগ্ধ করে। তরুণের সঙ্গে শুদের বাড়িতে ফিরলাম। নদী পার হতে সাম্পানে উঠলাম। তুলতুল পিছু পিছু এল। সাম্পানে উঠে তরুণের কোলে উঠল। শরতের মেঘ মাথার ওপর দিয়ে ভেসে চলল অলস হওয়ায়।
তিন মাইল হাঁটার পর সন্ধ্যে নামল। শচীর ভাবনা এত আচ্ছন্ন করে রখিল অথচ কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারি না - বাড়ি ফিরব নাকি শহরে চলে যাব। এতদিন যাকে ভুলতে চেয়েছি, যার সঙ্গে মনে মনে লড়াই করেছি, যার কথা না ভাবতে চেষ্টা করেছি, এমনকি গতকাল এরকম অবজ্ঞা করেছি সে আজ সমস্ত ভাবনায়। শচীকে একবার দেখতে খুব ইচ্ছে করছে। শুধু দেখা, আর কিছু না। দু চোখ ভরে একবার দেখা আর কিছুই চাই না। কিছুই চাই না ভাবতেই বুক কেঁপে উঠল। চাঁদের আকাশ ও আকাশের চাঁদ ডেকে ডেকে কী যেন বলল।
তুলতুল ক্লান্ত হয়ে কাঁধে উঠে বসল। কাঁধ থেকে মুখ বাড়িয়ে চুমু দিল। আমি অাদর ফিরিয়ে দিলাম।
রাস্তায় উঠে বাস ধরলাম। হোস্টেলে পৌঁছে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। উদভ্রান্তের মতো দশটা দিন কেটে গেল। প্রাচীন কালে বর্ষার শেষে শরতে রাজারা দিবিজয়ে বের হত। প্রবাসীরা ঘরে ফিরত। আমিও তুলতুলকে নিয়ে বাড়ির পথে বের হলাম।
বললাম, মা, ঘরে কে এল ? মা ডাক দিল, মিশি এদিকে আয়। মিশি ছুটে এল এবং আমাকে দেখে থমকে দাঁড়াল। হাসতে হাসতে সে বলল, ডেকেছেন পিসিমা। মা তাড়াতাড়ি বলল, প্রণাম কর। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তোর মামাতো বোন হয়। বেড়াতে এসেছে।
মিশিও তাড়াতাড়ি বলল, তুমি চিনতে পারলে না? সে বছর তোমার সঙ্গে দেখা হল, আমাদের গ্রামে ...।
মা একথা ওকথা বলে, চিনিয়ে দিল। আমি ভাবলাম, কেন হঠাৎ এভাবে বেড়াতে এল। সে শহরে পড়াশুনা করে। হোস্টেলে থাকে। শচীর ভাবনা চকিতে আবার দোলা দিয়ে গেল। মিশি বলল, তোমার ‘শিমুলরা বলেছে’ লেখাটি পড়েছি। শিমুল যে মানুষের এত উপকারী বন্ধু আগে জানতাম না। বসন্তের এত কথা অাছে অাগে এভাবে কোনো দিন ভাবি নি।
মা বলল, লেখাটি আর একটা সংক্ষিপ্ত হলে ভালাে হত। আর গাছ ভালোবেসে হলেও যদি দেশলাইয়ের কাঠি কম খরচ করতিস বুঝতাম তুই প্রকৃতি-প্রেমিক। এত সিগারেট খাওয়া ভালো না।
ছোট দু বােন এসে বলল, তােমার তুলতুল কই? মিশিদিকে দেখাই।
এতক্ষণ তুলতুলের কথা ভুলে ছিলাম। সেও এই ফাঁকে কোথায় যে পালাল। তুলতুল তুলতুল বলে ডাকতেই সে ঘরে ঢুকল, সতর্ক পায়ে থমকে দাড়াল। লাফিয়ে আমার কোলে উঠল। মিশি চোখ বড় বড় করে ধরতে গেল। তুলতুলও কেন জানি না হাঁ করে কামড়াবার জন্য রুখে দাঁড়াল। মিশি ভয় পেয়ে তিন হাত পিছিয়ে গেল। আমি তুলতুলের মাথায় হাত রেখে বললাম, অমন করে না। অতিথিকে চিনে রাখ। মা ওর কাছে, পরিচয় করে নে।
মা ঠিক করে নিয়েছে পরীক্ষার পরেই আমার সঙ্গে মিশির বিয়ে দেবে। মায়ের ধারণা ছেলেদের পড়াশোনা শেষেই বিয়ে হওয়া দরকার আর মেয়েদের পড়তে পড়তে বিয়ে হয়ে গেলে সবচেয়ে ভালো। বাবা ব্যবসা নিয়ে গ্রাম থেকে শহরে ছোটাছুটি করে। তাই আমার পরীক্ষা হয়ে গেলেই বিয়ে দিয়ে সংসারী করে তুলবে, বাবার ব্যবসায় ঢুকিয়ে দেবে।
আমি জানি না কিসে কি হয়ে যায়। মিশি আস্তে আস্তে আমার মনে ছায়া ফেলতে থাকে। শচীকে আরও বেশি মনে পড়ে। সেই এক সন্ধেয় মিশি আমাকে নদীর ধারে নিয়ে যায়। শরতের ভরা শান্ত নদী। জোয়ার এসে কল ভরে দিয়েছে। একটা একটা করে সাম্পান কেঁদে কেঁদে উজান চলে যায়। কেন যে সাম্পানওয়ালা পানি দিয়ে শব্দটা বন্ধ করে না।
দড়ির আঙটা পানিতে ভিজিয়ে দিলেই দাড়ের শব্দ ওঠা বন্ধ হয়ে যায়। তার বুক মােচড়ানো দাঁড়ের শব্দ সবসময় এরকম কষ্ট দেয় আমাকে। তুলতুল কোল থেকে নামে না। মিশি তাকে যতই অদর করতে চায় সে ততই ফুসে ওঠে; যেন বলে, চাই না তোমার ভালোবাসা। আমি তুলতুলের কান মলে দিয়ে ধমক দেই। তবুও তার শিক্ষা হয় না।
মিশির পক্ষে বেশি ওকালতি করতে যেতেই আমাকে কামড়াতে উদ্ধত হল। আমিও বুঝে নিলাম ওদের মধ্যে ভাব হবে না। মিশিও আমার কোলের দিকে হাত বাড়ান বন্ধ করে। চুপ মেরে গেল। তারপর এক সময় রেগে বলল, ওটাকে তাড়াবে নাকি আমি চলে যাব। তুলতুলেও কোল থেকে নামে না। সে যেন অামাদের মাঝখানে বেড়া তুলে আগলে রাখতে চায় আমাকে। মিশি হঠাৎ আমার বাঁ হাতখানা নিয়ে আবেগ প্রকাশ করল। আস্তে আস্তে আমাকে ওর কাছে টানতে লাগল, অমনি শচী আমার কানে কানে বলল, ভালোবাসা কেমন ? তুমি কাকে ভালোবাসো?
সঙ্গে সঙ্গে তুলতুল জোর প্রতিবাদ জানিয়ে আমার কোল থেকে নেমে নদীর কুল বেয়ে বিলের মাঝে হারিয়ে গেল। আমি এক বার ভাকলাম, তুলতুল, তুলতুল কোথায় গেলি? কাছে আয় কথা শোন।
তুলতুল এল না। মিশি আমার দিকে তাকিয়ে বলল, অাপদ দুর হয়েছে ভালোই হয়েছে। এবার বলো তুমি আমাকে ভালোবাসো?
মনের মধ্যে তখন শচী। আমার মাথায় তুলতুল। মিশি আবার বলল, কি! অপদ বললাম বলে রাগ করলে ? ওকে তুমি খুব ভালোবাসাে জানি। কিন্তু ও যে আমাকে সহ্যই করতে পারে না।
অামি দাঁড়িয়ে আমতা আমতা করতে লাগলাম। তুলতুলের জন্যে চিন্তিত হয়ে পড়লাম। মিশি বুঝে হোক না বুঝে হােক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অামাকে চুমু খেল। আমি গলে যেতে যেতে আবার তুলতুলের কথা ভাবলাম, কল্পনায় শচী এসে আবার বলল, ভালোবাসা কেমন তাহলে? ভালোবাসলে সুখ কোথায় থাকে, ভালােবাসা কোথায় থাকে?
আমি আবার চঞ্চল হয়ে উঠলাম। রাতের আঁধার ও অাকাশের তারারা পাহারা দিয়ে আমাদের ঘরে ফেরত পাঠাল। সাম্পানের বুক-ফাটা চিৎকার অনেক দূর থেকে বলে চলল—ভালোবাসা কেমন তাহলে, ভালোবাসা কোথায় থাকে... ঘরে পৌঁছে দেখি তুলতুল নেই। সারা বাড়ি তন্ন তন্ন করে খুজলাম, রাতদুপুর অব্দি জেগে রইলাম। ঘরের দরজা-জানালা খোলা রাখলাম। আবার বিছানা ছেড়ে উঠলাম। দরজা বন্ধ করলাম, আবার দরজা খুলে উঠোনে গিয়ে ডাকলাম। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম।কালপুরুষ মাঝ আকাশে মুগুর হাতে অলিদিবরণকে থামিয়ে দিয়ে বীরের মতো দাঁড়িয়ে আছে । আলদিবরণ সুন্দরী সুরাইয়াকে ধরার জন্যে তাড়া করছে আর কালপুরুষ তাদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে।
মা বলল, আসবে না। খুব বকবক করেছিস কি? আজকাল তুই যা খিটখিটে হয়েছিস। বোন অলতা ও সুন্নাত বলল, এতদিন পর তুলতুল এভাবে চলে গেল কেন? তুমি কি বকেছ? মিশি বলল, গেছে ভালােই হয়েছে। যা রাগ দেখায় আমাকে।
সকাল ও দুপুর ছটফট করে কাটল। মিশিকে আমি কী করে বোঝাই যে তুলতুল আমার কত খানি। ভিটে খুঁজলাম। বিল, নদীর কুল হন্যে হয়ে ঘুরলাম। ভিটের যেখানে আমরা খেলতাম সেখানে বসে বসে ওকে ডাকলাম, মনে মনে কাঁদলাম। সে আমার মেজাজ মর্জি বুঝত। অামার অসুখ করলে গায়ে-পিঠে চুলবুল করে এক রকম আরাম ঢেলে দিত। পড়তে পড়তে ক্লান্ত হয়ে পড়লে সে নিজে লাফিয়েঝাঁপিয়ে আমাকে অনিন্দ দিত অথবা আমাকেও ওরকম করতে ইঙ্গিত দিত। হ্যাঁ, আমি তা করতাম। আসলে ওর স্বভাবের মাঝে আমিই নানা ইঙ্গিত খুজে নিতাম হয়তো। ওর খাওয়া-দাওয়া, রুচি, মাঝে মাঝে মটকা মেরে শুয়ে থাকা - সব মনে পড়তে লাগল। মিশি এসে নানা ভাবে আমাকে ভােলাতে চেষ্টা করে।
অলতা ও সুলতা আমাকে বুঝতে পরে, তারাও পাড়া ঘরে খুজল। মা ডেকে সান্ত্বনা দেয়। ঘুরে-ফিরে তুলতুলের স্মৃতিরা সামনে চলে আসে।
শচীকে সে খুব আপন করে নিয়েছিল। এক দিনেই শচীর মনও জয় করে, ওর সঙ্গে সঙ্গে তাই শচী ঘুরে-ফিরে আসে। শচী যেন বলে, ভালোবাসা কেমন, তুমি কাকে ভালোবাসাে?
বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নামে। মিশি বলল, তুমি কি একটা বেজির জন্যে সব কিছু ছেড়ে দেবে? চলো নদীর কূলে যাই। কি নিয়ে যাবে না?
আমি হা-না কোনো জবাব দিতে পারলাম না। অন্য কথা বলে চুপ করে গেলাম। অলিতা ও সুলতা আমার মতো ভেবে ভেবে কোনো কূল করতে পারে না। মিশির প্রতিও ওরা অবহেলা শুরু করল। ওদের ধারণা মিশিই তুলতুলের পালিয়ে যাওয়ার কারণ, প্রথম থেকেই মিশি ওকে সহ্য করতে পারছে না। তুলতুলও প্রথম দেখায় মিশিকে ভালো, বাসতে পারে নি।
সন্ধে নামতেই দক্ষিণ থেকে জোর হাওয়া ছুটল। ভরা নদী থেকে সাম্পানের শব্দ আসে। দুর থেকে ভালো লাগে, কাছ থেকে শুনতেই বেশি কর্কশ লাগে। পুব আকাশ কৃত্তিকা তারাগুচ্ছ উকি মেরে তাকায়। ঠিক তথনই তুলতুলকে নিয়ে উঠোনে এসে দাঁড়াল শচী ও তরুণ। শচীর কোলে তুলতুল। শুনেই বোনরা ছুটে এল। মা বেরিয়ে এল, মিশি এসে দাঁড়াল। কিন্তু তুলতুল শচীর কোল থেকে আমার কোলে এল না। আমার সামনে দাঁড়িয়ে শচী বলল, তুমি কি তুলতুলকে অামার কাছে পাঠিয়েছ ? ভোররাতে আমার বিছানায় উঠে এমন চিৎকার চেঁচামেচি জুড়ে দিল যে ভাবলাম তোমার কোনো বিপদ-আপদ হয় নি তো? তরুণ বলল, সকালে আসতে পারি নি মা-বাবা ঘরে ছিল না বলে।
আলতা ও সুলতা বলল, এত দূরে ও গেল কি করে? মা হয়তো ভাবল তুলতুল শচীর কাছে কেন গেল। তুলতুল শচীর কোলে বসে কিকি কিকি কিকি করে সেই প্রথম থেকেই বকবক করছে।
বেজির খাঁচার ওপর একটা কাপড় দিয়ে ঢেকে দিলাম। সবাই বলল বেজিটা ছেড়ে দিতে। আমি বললাম, না পুষব। আমার সঙ্গী হবে সে। শচী তো এক রকম জোর শুরু করল ছেড়ে দেবার জন্যে। আর সে জন্যেই জেদ করে পোষার সিদ্ধান্ত নিলাম। প্রথম দিনেই কিন্তু বেজিটা শচীর নেওটা হয়ে গেল।
ব্যাপারটা খুলেই বলি। আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু বাবুর শ্বশুরবাড়িতে শচীর সঙ্গে পরিচয়। নিয়ম অনুযায়ী বিয়ে হয় বাবুর বাড়িতে। এটাই আমাদের রীতি। বিয়ের পরদিন বর শ্বশুরবাড়িতে যায় কনেকে নিয়ে। সঙ্গে থাকে বন্ধু-বান্ধব, ছােট ভাই-স্থানীয় আত্মীয় ও বোনজামাইরা। অন্ধকার রাতে হ্যাজাক বাতি জ্বালিয়ে পাঁচ মাইল হেঁটে আমরা বাবুর শ্বশুরবাড়িতে পৌছি। সেখানে শচীর সঙ্গে পরিচয়।
বসন্তের সেই রাতে শচী আমাকে নিয়ে গিয়েছিল ওদের গ্রামের নদীর কূলে। সঙ্গে আরও একজন ছিল। সে কৃষ্ণপক্ষের সমীর চাঁদ।
আমি জানি রুমালটী আমার জন্যে সে সেলাই করে নি। এও জানি, এটা আমাকে দেওয়ার জন্যেই ঘাসের ওপর পেতে দিয়েছিল। সে বসে ছিল ঘাসের ওপর। ওঠার সময় বলল, এটা আপনি রাখুন।
পরদিন গানের আসর বসল । শচী গান গেয়েছিল। দুপুরে সাঁতার কেটে নদী পেরিয়ে কাশবনের গভীরে চলে যাই একা একা। মাথার নিচে দু-হাত রেখে অকশি পাহারা দিতে দিতে অনেকক্ষণ শুয়ে ছিলাম। সবাই ফিরে গেল আমাকে ফেলে । আমি উঠে পুরো কাশবন জরিপ করে একটা বেজির ছানা ধরি।
ততক্ষণে নৌকোতে করে অামাকে খুঁজতে এল ওরা। চিৎকার করে ডেকে খুজে বের করল। অামার হাতে বেজির ছানা। ওরা ভেবেছিল আমার কোনো বিপদ হয়েছে, কোনো দুর্ঘটনার শিকার হয়েছি। নেউল ছানাটি (তুলতুল) একটা খাঁচায় পুরলাম। সেদিন থেকে তুলতুল আমার বন্ধু হয়ে গেল। এরপর আরও দু বার শচীদের বাড়িতে গিয়েছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে ছিল তুলতুল। সেও শচীর প্রিয় হয়ে উঠল।
শচী তামার এক ক্লাস নিচে পড়ে। ওদের গ্রামেই ওর কলেজ। সেবার শরতের ছুটিতে শহর থেকে আমি গ্রামে এলাম আর শচী একা বাবুদের বাড়িতে। বাবুর বাবা মারা যাওয়ায় পড়া ছেড়ে তাকে বিয়ে করতে হল। জমিজমা চাষবাস দেখা ছাড়া ওর কোনো উপায় রইল না। আমার শুরু হল শচী থেকে পালিয়ে বেড়ান। শচীর আসার খবর পেয়ে আমি তৈরি হয়ে গেলাম হোস্টেলে চলে যেতে। বাবু আমাকে ডাকতে পাঠান। আমি ততক্ষণে কাপড়-চোপড় বোঁচকা বেঁধে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েছি। পথেই বাবুদের বাড়ি। ওর সামনে দিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। উঠতি পা থেমে যায়। শচীকে একবার না দেখে যাই কি করে ? আমার নিজের অজান্তে রাস্তা থেকে বাবুদের বাড়ির ঘাটায় পা বাড়ালাম।
ওদের বাড়ির দীর্ঘ ঘাটা পেরিয়ে পুকুর। পুকুরের পাশে বড় উঠান, মধবী ও অপরাজিতার ঝাড় এবং সেখানে শচী দাড়িয়ে,আছে। ওকে দেখতে পেয়েই তুলতুল এক লাফে ওর কাছে চলে যায় অার কি। আমি টান টান করে ওকে বাধ্য করলাম সংযত হতে। কিন্তু ওযে নিরীহ বেজি মাত্র, ওকে থামাই কতক্ষণ!
শচী মাধবীলতার ঝােপের নিচে দাড়িয়ে পুকুরের দিকে তাকিয়ে রইল। আমাকে দেখে নাকি না দেখে আমি বলতে পারব না। ওকে ডাকব কি ডাকব না বুঝে উঠতে পারলাম না। এক বার ভাবলাম না ডেকে চলে যাই। তাহলে তো এতদূর আসার অর্থ হয় না। আমার ভালোলাগা বা অবহেলারও মনে থাকে না।
শচীর পাশে গিয়ে বললাম, আমি যাচ্ছি। শচী চমকে এবং ঝলমলে চোখে চুপ করে তাকিয়ে রইল কিছু ক্ষণ। তুলতুল তখন চিঁ চিঁ করে ওর পা গুঁকছে। বলল, বীঃ কী সুন্দর বড় হয়ে গেছে ? তারপর ওকে আদর করতে করতে আমার দিকে তাকিয়ে না তাকিয়ে বলল, কোথায় চললেন? শচী বোধহয় ভাবল আমার কলেজ খোলা। তাই যেন তাড়াতাড়ি বলল এ কদিন পরে গেলে হয় না?
তুলতুল তখন দু পায়ে দাঁড়িয়ে দুরে কি যেন দেখল। আমিও এক মুহর্ত ভাবলাম। তারপর বললাম, হ্যা, তুলতুল এখন আমার সারাক্ষণের সঙ্গী, আমার সঙ্গে এক বিছানায় শোয়। আমি কলেজে গেলে একা থাকে আমার কামরায়। আমার বন্ধু।
আমি থাকব না বুঝে শচী হঠাৎ করে বলল, আমাকে কিছু টাকা দিতে পারেন? আমি অবাক হয়ে ভাবলাম, শচী আমার কাছে এভাবে টাকা চাইছে কেন? কোনো কারণ খুঁজে না পেয়ে তাড়াতাড়ি পকেট থেকে টাকা বের করলাম। সঙ্গে শচীর দেওয়া রুমালও বেরিয়ে এল। রুমালটা যে কী করে টাকার পকেটে এল বুঝতে পারলাম না, কারণ ওটা থাকার কথা পেছনের বাঁ পকেটে। যাক গে ; শচী দেখেও না দেখার ভান করে রইল। তামি খুচরো টাকাগুলো রেখে একটা নোট ওর হাতে তুলে দিলাম।
শচী শুধু বলল, এভাবে টাকা চাইলাম বলে অামাকে খুব ছোট ভাবছেন না তো? আমি বলতে পারতাম, না নিলে নিজেকে খুব ছোট মনে করব।
সে অবাব বলল, অত দরকার নেই। খুচরোগুলাে দিলেই চলবে। হঠাৎ দরকার হয় পড়ল।
তবুও কিছুতেই মেলাতে পারলাম না ওর টাকা চাওয়ার ব্যাপারটা। ওর সম্পর্কে কোনো সিদ্ধান্তেই পৌছুঁতে পারলাম না। আরও কিছুক্ষণ থাকার পর শচী প্রায় অদেশের মতো বলল, আপনি আর দেরি করবেন না। সন্ধে হয়ে এল, আপনার যাওয়া উচিত। তারপর তুলতুলকে আদর করে গোমড়া মুখে আমাকে বিদায় দিল।
বাসে প্রায় তিরিশ মাইল যেতে হবে। সেটাও খুব দূরত্ব কিছু নয়। চেনা-জানা পথ। রাতবিরেতে কত আসা-যাওয়া করি। কিন্তু তুলতুল আমাকে জানিয়ে দিল সে কোথাও যেতে রাজী নয়। একটু ধমক দিলাম। দড়ি ধরে আচ্ছা করে কিছুক্ষণ শূন্যে ঝুলিয়ে রাখলাম। কিন্তু ভেতরে ভেতরে আমি অনেকখানি দুর্বল হয়ে গেলাম। বাসে উঠে বসার সঙ্গে সঙ্গে সবকিছু দিনের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল।
অাকাশে চাঁদ উঠেছে। নদীর ওপর বালুচরে লুটোপুটি খেলছে। শচীর প্রতিটি কথার অর্থ আমার কাছে গভীর অর্থবহ হয়ে উঠতে লাগল। সে বােধহয় বোঝাতে চেয়েছে রুমালটিই আমাদের মধ্যেকার বিপিত্তির কারণ। তার জন্যেই টাকা নিয়ে মিটমাট করতে চাইছে। নামমাত্র হলেও কিছু মূল্য নিতে চেয়েছে। পাঁচ পয়সা চাইলে আমি বুঝতে পারতাম। এক টাকা চাইলেও বুঝতাম। কিন্তু শচী বোধহয় বুঝতে দিতে চায় না যে রুমালের জন্যেই আমাদের মধ্যে শত্রতা দানা বেঁধে উঠছে।
আমিও ভালোবাসি কথাটা বলতে পারছি না, সেও বলতে পারছে না হয়তো। আমারই প্রথম প্রকাশ করা উচিত বৈকি। আমি কিনা নির্বোধের মতো নিজের হাতে নিজে সব তছনছ করে চলেছি। তবুও আমি বলতে পারি নি। সেবার সে দশ দিন ছিল আমাদের গ্রামে। সেদিন বাবুর সঙ্গে দেখা না করাতে সে অপমানিত বােধ করে এবং রাগ করে আমার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দেয়। ওর কথা হল শচীকেও আমি অপমান করেছি। সাধারণ সৌজন্যবোধটুকুও আমার মধ্যে নেই। ভালোবাসা ছাড়াও তো মানুষের ভদ্রতাবোধ থাকে। শচী, বাবু ও বাবুর বউ—সকলকে আমি অপমান করেছি। বাবুর এই ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গেল।
সে-রাতে আমি আর শহরে যাইনি। আমি আবার সিদ্ধান্ত পল্টিালাম। পাঁচ মাইল হেঁটে শচীদের গ্রামে পৌছুলাম। শচীর ভাই তরুণের সঙ্গে ওদের বাড়িতে গেলাম। শচীর মা-বাবা খুশি হল। অনেক রাত পর্যন্ত তরুণের সঙ্গে নানা গল্প করলাম। তুলতুলের নানা খেলা ও বুদ্ধিমত্তার প্রমাণ দিলাম। ঘর থেকে বেরিয়ে ধরে নিয়ে এল মাছ ও ইদুর। লুকোচুরি খেলল টেবিল ও চেয়ারে বসে। বইয়ের ফাঁকে উকি মারল চমৎকার ভঙ্গি করে। শচীর পিঠোপিঠি ছােট তরুণ। ওরা ভাইবোনে চমৎকার বন্ধুত্ব।
আমিও আর লুকোচুরি না করে বললাম শচীর সঙ্গে দেখা হয়েছে।
তরুণ অবাক হয়ে বলল, শচী বাবুভাই আপনাকে ছেড়ে দিল। বললাম, তুলতুলকে ছেড়ে দিতে এসেছি। কেন? আপনার কষ্ট হবে না?
হ্যা, কষ্ট হবে। ওর সঙ্গে দীর্ঘ ছয় মাস ধরে অন্তরঙ্গতা। তবুও ছেড়ে দিতে হবে। একা একা আমার সঙ্গে থেকে ও-বেচারী তার জীবন ও জগৎ থেকে একেবারে আলাদা হয়ে যাচ্ছে। সে প্রকৃতির সন্তান, প্রকৃতির সন্তানকে প্রকৃতির মাঝে ফিরিয়ে দিতে এসেছি।
তরুণ বলল, যে কোনোখানে ছেড়ে দিলেই তো হয়।
তা হয়। তবুও ভাবছি ওর পাড়ায় ওকে ছেড়ে দেব। নিজের পাড়া, নিজের গ্রাম ও নিজের দেশ অনেক বড়।
ভোরে উঠেই তরুণ ও অমি নদী পেরিয়ে কাশবনে গেলাম। শরতের আলো হাওয়ায় কাশবন দুলছে। মাথার ওপর নীল আকাশ ও নদীর চুলেছল ঢেউয়ের শব্দ। কিন্তু আমার সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেল। ওর গলার রশি খুলে দিলাম। যেতে বললাম। ওর বাড়ি-ঘর, প্রেম ভালােবাসা ও আত্মীয়-স্বজনের কথা বললাম। আমার সঙ্গে থাকা মানে জীবন বরবাদ।
বললাম, তুলতুল, তুই মুক্ত। তোর সঙ্গী সাথী খুঁজেনে। তোর মধুময় জীবন সামনে পড়ে অাছে। যা তুলতুল, আমার ভালোবাসা নিয়ে চলে যা। আমাকে অবাক করে, হতাশ করে সে আমার পাশে ঘুরঘুর করতে লাগল। দু পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে নিঃশ্বাস টেনে টেনে কি যেন বুঝতে চেষ্টা করল। চারদিকে তাকাল। রশিটা ছুড়ে ফেলে দিলাম। আবার বললাম, তুলতুলরে অাজ থেকে তুই স্বাধীন, তোর পাড়া-পড়শিদের মাঝে ফিরে যা ।
তুলতুল গেল না। আবার বললাম, আমার পিছে পিছে ঘুরে বেড়াতে হবে না। যা যা।
সে যায় না। দু পায়ে দাঁড়ায়, এদিক-ওদিক তাকায়, ঘাস শোকে, আমার দিকে তাকায়। আবার বললাম, তুলতুল, তুই কি স্বাধীনতা চাস না? যেদিকে দু চোখ যায় চলে যা।
না, ওর কোনো ভাবান্তর নেই।
যাওয়ার আগ্রহ নেই। ধমক দিলাম। সে চমকে লাফিয়ে প্যান্টের পা বেয়ে উঠতে চাইল। নিচে নেমে আমার দিকে তাকাল করুণ চোখে। হ্যাঁ, আমি ওর অনেক কিছু বুঝি। রাগ, আনন্দ ও বিষাদ আঁচ করতে পারি।
তুলতুল স্বাধীন সিদ্ধান্ত নিয়ে আমার সঙ্গে রয়ে গেল। আমার ও আর কিছু করার নেই। এমনিতেই তো আমি ওকে ছেড়ে দেব বলে হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিয়েছি। শচী ওর গ্রামে ফিরলে আমাকে নিয়ে যাতে ভাবে,তার পথ করে দিলাম। শচী বুঝুক, শচী আরও বেশি আমাকে ভালোবাসুক আমি ওর ভালোবাসা আদায় করে নিতে চাই ওকে মূগ্ধ করে। তরুণের সঙ্গে শুদের বাড়িতে ফিরলাম। নদী পার হতে সাম্পানে উঠলাম। তুলতুল পিছু পিছু এল। সাম্পানে উঠে তরুণের কোলে উঠল। শরতের মেঘ মাথার ওপর দিয়ে ভেসে চলল অলস হওয়ায়।
তিন মাইল হাঁটার পর সন্ধ্যে নামল। শচীর ভাবনা এত আচ্ছন্ন করে রখিল অথচ কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারি না - বাড়ি ফিরব নাকি শহরে চলে যাব। এতদিন যাকে ভুলতে চেয়েছি, যার সঙ্গে মনে মনে লড়াই করেছি, যার কথা না ভাবতে চেষ্টা করেছি, এমনকি গতকাল এরকম অবজ্ঞা করেছি সে আজ সমস্ত ভাবনায়। শচীকে একবার দেখতে খুব ইচ্ছে করছে। শুধু দেখা, আর কিছু না। দু চোখ ভরে একবার দেখা আর কিছুই চাই না। কিছুই চাই না ভাবতেই বুক কেঁপে উঠল। চাঁদের আকাশ ও আকাশের চাঁদ ডেকে ডেকে কী যেন বলল।
তুলতুল ক্লান্ত হয়ে কাঁধে উঠে বসল। কাঁধ থেকে মুখ বাড়িয়ে চুমু দিল। আমি অাদর ফিরিয়ে দিলাম।
রাস্তায় উঠে বাস ধরলাম। হোস্টেলে পৌঁছে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। উদভ্রান্তের মতো দশটা দিন কেটে গেল। প্রাচীন কালে বর্ষার শেষে শরতে রাজারা দিবিজয়ে বের হত। প্রবাসীরা ঘরে ফিরত। আমিও তুলতুলকে নিয়ে বাড়ির পথে বের হলাম।
বললাম, মা, ঘরে কে এল ? মা ডাক দিল, মিশি এদিকে আয়। মিশি ছুটে এল এবং আমাকে দেখে থমকে দাঁড়াল। হাসতে হাসতে সে বলল, ডেকেছেন পিসিমা। মা তাড়াতাড়ি বলল, প্রণাম কর। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তোর মামাতো বোন হয়। বেড়াতে এসেছে।
মিশিও তাড়াতাড়ি বলল, তুমি চিনতে পারলে না? সে বছর তোমার সঙ্গে দেখা হল, আমাদের গ্রামে ...।
মা একথা ওকথা বলে, চিনিয়ে দিল। আমি ভাবলাম, কেন হঠাৎ এভাবে বেড়াতে এল। সে শহরে পড়াশুনা করে। হোস্টেলে থাকে। শচীর ভাবনা চকিতে আবার দোলা দিয়ে গেল। মিশি বলল, তোমার ‘শিমুলরা বলেছে’ লেখাটি পড়েছি। শিমুল যে মানুষের এত উপকারী বন্ধু আগে জানতাম না। বসন্তের এত কথা অাছে অাগে এভাবে কোনো দিন ভাবি নি।
মা বলল, লেখাটি আর একটা সংক্ষিপ্ত হলে ভালাে হত। আর গাছ ভালোবেসে হলেও যদি দেশলাইয়ের কাঠি কম খরচ করতিস বুঝতাম তুই প্রকৃতি-প্রেমিক। এত সিগারেট খাওয়া ভালো না।
ছোট দু বােন এসে বলল, তােমার তুলতুল কই? মিশিদিকে দেখাই।
এতক্ষণ তুলতুলের কথা ভুলে ছিলাম। সেও এই ফাঁকে কোথায় যে পালাল। তুলতুল তুলতুল বলে ডাকতেই সে ঘরে ঢুকল, সতর্ক পায়ে থমকে দাড়াল। লাফিয়ে আমার কোলে উঠল। মিশি চোখ বড় বড় করে ধরতে গেল। তুলতুলও কেন জানি না হাঁ করে কামড়াবার জন্য রুখে দাঁড়াল। মিশি ভয় পেয়ে তিন হাত পিছিয়ে গেল। আমি তুলতুলের মাথায় হাত রেখে বললাম, অমন করে না। অতিথিকে চিনে রাখ। মা ওর কাছে, পরিচয় করে নে।
মা ঠিক করে নিয়েছে পরীক্ষার পরেই আমার সঙ্গে মিশির বিয়ে দেবে। মায়ের ধারণা ছেলেদের পড়াশোনা শেষেই বিয়ে হওয়া দরকার আর মেয়েদের পড়তে পড়তে বিয়ে হয়ে গেলে সবচেয়ে ভালো। বাবা ব্যবসা নিয়ে গ্রাম থেকে শহরে ছোটাছুটি করে। তাই আমার পরীক্ষা হয়ে গেলেই বিয়ে দিয়ে সংসারী করে তুলবে, বাবার ব্যবসায় ঢুকিয়ে দেবে।
আমি জানি না কিসে কি হয়ে যায়। মিশি আস্তে আস্তে আমার মনে ছায়া ফেলতে থাকে। শচীকে আরও বেশি মনে পড়ে। সেই এক সন্ধেয় মিশি আমাকে নদীর ধারে নিয়ে যায়। শরতের ভরা শান্ত নদী। জোয়ার এসে কল ভরে দিয়েছে। একটা একটা করে সাম্পান কেঁদে কেঁদে উজান চলে যায়। কেন যে সাম্পানওয়ালা পানি দিয়ে শব্দটা বন্ধ করে না।
দড়ির আঙটা পানিতে ভিজিয়ে দিলেই দাড়ের শব্দ ওঠা বন্ধ হয়ে যায়। তার বুক মােচড়ানো দাঁড়ের শব্দ সবসময় এরকম কষ্ট দেয় আমাকে। তুলতুল কোল থেকে নামে না। মিশি তাকে যতই অদর করতে চায় সে ততই ফুসে ওঠে; যেন বলে, চাই না তোমার ভালোবাসা। আমি তুলতুলের কান মলে দিয়ে ধমক দেই। তবুও তার শিক্ষা হয় না।
মিশির পক্ষে বেশি ওকালতি করতে যেতেই আমাকে কামড়াতে উদ্ধত হল। আমিও বুঝে নিলাম ওদের মধ্যে ভাব হবে না। মিশিও আমার কোলের দিকে হাত বাড়ান বন্ধ করে। চুপ মেরে গেল। তারপর এক সময় রেগে বলল, ওটাকে তাড়াবে নাকি আমি চলে যাব। তুলতুলেও কোল থেকে নামে না। সে যেন অামাদের মাঝখানে বেড়া তুলে আগলে রাখতে চায় আমাকে। মিশি হঠাৎ আমার বাঁ হাতখানা নিয়ে আবেগ প্রকাশ করল। আস্তে আস্তে আমাকে ওর কাছে টানতে লাগল, অমনি শচী আমার কানে কানে বলল, ভালোবাসা কেমন ? তুমি কাকে ভালোবাসো?
সঙ্গে সঙ্গে তুলতুল জোর প্রতিবাদ জানিয়ে আমার কোল থেকে নেমে নদীর কুল বেয়ে বিলের মাঝে হারিয়ে গেল। আমি এক বার ভাকলাম, তুলতুল, তুলতুল কোথায় গেলি? কাছে আয় কথা শোন।
তুলতুল এল না। মিশি আমার দিকে তাকিয়ে বলল, অাপদ দুর হয়েছে ভালোই হয়েছে। এবার বলো তুমি আমাকে ভালোবাসো?
মনের মধ্যে তখন শচী। আমার মাথায় তুলতুল। মিশি আবার বলল, কি! অপদ বললাম বলে রাগ করলে ? ওকে তুমি খুব ভালোবাসাে জানি। কিন্তু ও যে আমাকে সহ্যই করতে পারে না।
অামি দাঁড়িয়ে আমতা আমতা করতে লাগলাম। তুলতুলের জন্যে চিন্তিত হয়ে পড়লাম। মিশি বুঝে হোক না বুঝে হােক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অামাকে চুমু খেল। আমি গলে যেতে যেতে আবার তুলতুলের কথা ভাবলাম, কল্পনায় শচী এসে আবার বলল, ভালোবাসা কেমন তাহলে? ভালোবাসলে সুখ কোথায় থাকে, ভালােবাসা কোথায় থাকে?
আমি আবার চঞ্চল হয়ে উঠলাম। রাতের আঁধার ও অাকাশের তারারা পাহারা দিয়ে আমাদের ঘরে ফেরত পাঠাল। সাম্পানের বুক-ফাটা চিৎকার অনেক দূর থেকে বলে চলল—ভালোবাসা কেমন তাহলে, ভালোবাসা কোথায় থাকে... ঘরে পৌঁছে দেখি তুলতুল নেই। সারা বাড়ি তন্ন তন্ন করে খুজলাম, রাতদুপুর অব্দি জেগে রইলাম। ঘরের দরজা-জানালা খোলা রাখলাম। আবার বিছানা ছেড়ে উঠলাম। দরজা বন্ধ করলাম, আবার দরজা খুলে উঠোনে গিয়ে ডাকলাম। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম।কালপুরুষ মাঝ আকাশে মুগুর হাতে অলিদিবরণকে থামিয়ে দিয়ে বীরের মতো দাঁড়িয়ে আছে । আলদিবরণ সুন্দরী সুরাইয়াকে ধরার জন্যে তাড়া করছে আর কালপুরুষ তাদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে।
মা বলল, আসবে না। খুব বকবক করেছিস কি? আজকাল তুই যা খিটখিটে হয়েছিস। বোন অলতা ও সুন্নাত বলল, এতদিন পর তুলতুল এভাবে চলে গেল কেন? তুমি কি বকেছ? মিশি বলল, গেছে ভালােই হয়েছে। যা রাগ দেখায় আমাকে।
সকাল ও দুপুর ছটফট করে কাটল। মিশিকে আমি কী করে বোঝাই যে তুলতুল আমার কত খানি। ভিটে খুঁজলাম। বিল, নদীর কুল হন্যে হয়ে ঘুরলাম। ভিটের যেখানে আমরা খেলতাম সেখানে বসে বসে ওকে ডাকলাম, মনে মনে কাঁদলাম। সে আমার মেজাজ মর্জি বুঝত। অামার অসুখ করলে গায়ে-পিঠে চুলবুল করে এক রকম আরাম ঢেলে দিত। পড়তে পড়তে ক্লান্ত হয়ে পড়লে সে নিজে লাফিয়েঝাঁপিয়ে আমাকে অনিন্দ দিত অথবা আমাকেও ওরকম করতে ইঙ্গিত দিত। হ্যাঁ, আমি তা করতাম। আসলে ওর স্বভাবের মাঝে আমিই নানা ইঙ্গিত খুজে নিতাম হয়তো। ওর খাওয়া-দাওয়া, রুচি, মাঝে মাঝে মটকা মেরে শুয়ে থাকা - সব মনে পড়তে লাগল। মিশি এসে নানা ভাবে আমাকে ভােলাতে চেষ্টা করে।
অলতা ও সুলতা আমাকে বুঝতে পরে, তারাও পাড়া ঘরে খুজল। মা ডেকে সান্ত্বনা দেয়। ঘুরে-ফিরে তুলতুলের স্মৃতিরা সামনে চলে আসে।
শচীকে সে খুব আপন করে নিয়েছিল। এক দিনেই শচীর মনও জয় করে, ওর সঙ্গে সঙ্গে তাই শচী ঘুরে-ফিরে আসে। শচী যেন বলে, ভালোবাসা কেমন, তুমি কাকে ভালোবাসাে?
বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নামে। মিশি বলল, তুমি কি একটা বেজির জন্যে সব কিছু ছেড়ে দেবে? চলো নদীর কূলে যাই। কি নিয়ে যাবে না?
আমি হা-না কোনো জবাব দিতে পারলাম না। অন্য কথা বলে চুপ করে গেলাম। অলিতা ও সুলতা আমার মতো ভেবে ভেবে কোনো কূল করতে পারে না। মিশির প্রতিও ওরা অবহেলা শুরু করল। ওদের ধারণা মিশিই তুলতুলের পালিয়ে যাওয়ার কারণ, প্রথম থেকেই মিশি ওকে সহ্য করতে পারছে না। তুলতুলও প্রথম দেখায় মিশিকে ভালো, বাসতে পারে নি।
সন্ধে নামতেই দক্ষিণ থেকে জোর হাওয়া ছুটল। ভরা নদী থেকে সাম্পানের শব্দ আসে। দুর থেকে ভালো লাগে, কাছ থেকে শুনতেই বেশি কর্কশ লাগে। পুব আকাশ কৃত্তিকা তারাগুচ্ছ উকি মেরে তাকায়। ঠিক তথনই তুলতুলকে নিয়ে উঠোনে এসে দাঁড়াল শচী ও তরুণ। শচীর কোলে তুলতুল। শুনেই বোনরা ছুটে এল। মা বেরিয়ে এল, মিশি এসে দাঁড়াল। কিন্তু তুলতুল শচীর কোল থেকে আমার কোলে এল না। আমার সামনে দাঁড়িয়ে শচী বলল, তুমি কি তুলতুলকে অামার কাছে পাঠিয়েছ ? ভোররাতে আমার বিছানায় উঠে এমন চিৎকার চেঁচামেচি জুড়ে দিল যে ভাবলাম তোমার কোনো বিপদ-আপদ হয় নি তো? তরুণ বলল, সকালে আসতে পারি নি মা-বাবা ঘরে ছিল না বলে।
আলতা ও সুলতা বলল, এত দূরে ও গেল কি করে? মা হয়তো ভাবল তুলতুল শচীর কাছে কেন গেল। তুলতুল শচীর কোলে বসে কিকি কিকি কিকি করে সেই প্রথম থেকেই বকবক করছে।
আরো নতুন নতুন valobasar Golpo পড়তে ভিজিট করুন
উত্তরমুছুনWWW.VALOBASARGOLPO2.XYZ