আস্তে আস্তে উঠে আসছে বড় ঘরের সামনের চাল ছাড়িয়ে উঠেছে নতুন পেয়ারা গাছটি। ফলের গাছ বলে আর কাটা হল না। চোখের সামনে বেশ ডাগর হয়ে সে নিজেকে মেলে ধরেছে। নতুন বলে পাতাগুলো বেশ পুষ্ট ও বড়। আমার যত্ন তো আছেই। সারা শীতকালটা ওর গোড়ায় পানি দিয়েছি, আদর -ভালোবাসা দিয়েছি।
গাছেরা যদি তা বুঝতে পেরে থাকে তাহলে সে অনেক পেয়েছে। আমার বিশ্বাস গাছও ভালোবাসা বোঝে, নইলে অত তরতর করে বাড়ল কি করে ? মনে হয় কাছে গেলে সে পাতার হাত দিয়ে আমাকে ডাকে, গা দুলিয়ে আনন্দ প্রকাশ করে, পুনপুন করে কথা বলে, হা, ঠোঁট উল্টিয়ে অভিমানও প্রকাশ করে। একেবারে যেন একটি ভালোবাসার গল্প..
আর সন্ধে হতে না হতেই পাতারা বেশ উর্ধ্বমুখী হয়ে যায়, আবার সূর্য ওঠার একটু পরেই দিনের কাজের জন্য তৈরি হয়ে স্বাভাবিক হয়ে যায়। হ্যা, অমি ওর স্বভাব-চরিত্র বুঝে নিয়েছি।
এবার আমার পরিচয় দেই। আমার নাম অদিল। মা অদর করে বকুল নামেও ডাকে। বাবা হঠাৎ করে অসুখে পড়ে শয্যাশায়ী। মা সারাদিন সংসারের কাজে ব্যস্ত। আমি বি. এ. পড়ছি। ১৯৭১ সাল।
জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি গেল উত্তাল আন্দোলনে আর মার্চ মাস শেষ হতেই ছোট ভাই না বলে না কয়ে মুক্তিযুদ্ধে চলে গেল। সাদী আমার পিঠোপিঠি এবং একমাত্র ভাই। বাবা সম্ভবত ওর কারণেই শয্যাশায়ী, প্রেসারে ভুগছে। মা মাঝে-মধ্যে সাদীর কথা বলে। সব কথার শেষে বলে, প্রিয়জনের জন্য মানুষকে অপেক্ষা করতে হয়। আমিও অপেক্ষা করছি।
সেদিন আমি জানালার এক কোণে দাঁড়িয়ে মায়ের বলা অপেক্ষা করার কথা নিয়ে ভাবছি। হঠাৎ মনে হল পেয়ারা গাছটি পাতার হাতছানিতে আমাকে ডাকছে। বলল, চালের ছন ও আমার পাতার ফাঁকে একটি বড় পেয়ারা আছে, ওটা তুমি খুঁজে নাও। দ্যাখো কেমন ডাসা হয়ে উঠেছে আর সোনালী রঙটিও দেখার মত।
অমনি খুজে-পেতে পেয়ে হাততালি দিয়ে মাকে ডাক দিলাম, মা,দ্যাখো দ্যাখো , একটি পেয়ারা। আমার গাছের প্রথম ফল। মা রান্নাঘর থেকে দরজা দিয়ে মুখ বের করে দেখল। কী দেখল আমি জানি না। মুখে হাসি মেখে শুধু বলল, পাড়তে পারবি? পেকেছে ?
সঙ্গে সঙ্গে বললাম, পারব, নিশ্চয়ই পারব। ডাশা হয়েছে। মা ঘরে চলে গেল। কড়াই ও খন্তির শব্দ শুনতে শুনতে আমিও পেয়ারা গাছে উঠছি। যে ডালে পেয়ারী সে ডালটি অমার ভার সইতে পারল না বলে নেমে পড়লাম। ঠিক সে সময় এল সাজুর ছোট ভাই তপু। ওর বয়স দশ কি এগারো। চিরচঞ্চল ছেলে। ওকে বলতেই তরতর করে গাছে উঠে গেল। ওপর থেকে মাথা কাত করে বলল, একটা কাঠি বা কিছু দাও, আর উঠতে পারছি না। আমার ভার সইতে পারছে না। কী সুন্দর পেয়ারা !
উঠোন থেকে বাঁশের একটা কাঠি তুলে দিলাম। সে পেড়ে দিল । পেয়ারা নিয়ে খুশি হয়ে ছুটলাম মায়ের কাছে। মা বলল, বেশ বড় তো, সুন্দর গন্ধ।
খাঁটি সোনা রঙ ও মিষ্টি গন্ধ ছাড়ছে। মা রুটি মলতে মলতে বলল, কেটে ভাগ করে খেয়ে নে, তোর বাবাকেও দিস। দৌড়ে বাবার কাছে গেলাম। বাবা আধো ঘুমে, অধো জাগরণে। প্রেসারের ঘোরে বাবা এভাবে শুয়ে থাকে। বাবাকে ডাকলাম, বাবা, ও বাবা, পেয়ারা খাবে? নতুন গাছে ধরেছে।
তন্দ্রা থেকে জেগে বলল, এক টুকরো দে। তারপর পেয়ারাটি দেখতে দেখতে বলল, আমাদের ঘাটের পাশের গাছেও প্রথম প্রথম এত বড় পেয়ারা হতো। ঠিক সে সময় মাকে ডাকতে ডাকতে ঘরে ঢুকল সাজু।
আমি দরজা পেরিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে উকি মেরে সাজুকে দেখতে পেলাম। তপু ততক্ষণে উধাও হয়ে গেছে। ভাবছি সন্ধের ঠিক আগ মুহর্তে পেয়ারাটি কাটব কিনা, বাবাকে অসময়ে খেতে দেব কিনা।
অবেলায় পেয়ারা খাওয়া ঠিক নয় বাবাই শিখিয়েছে। কিন্তু নতুন গাছের পেয়ারা বলে ধৈর্য ধরতে পারছি না। সাজুর ডাকে মা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে সাড়া দিল। কাছে ডাকল। আমি ইশারা করার আগেই সাজু আমাকে এক চোখে মুহুর্তের মধ্যে অনেক কথা জানিয়ে দিল। মা আমাকে ডেকে বলল, সাজুকেও পেয়ারা দিস ।
আমি তাড়াতাড়ি পেয়ারা কাটার ছোরা ও দুটো প্লেট নিলাম। সাজুকে খেতে দিতে পারব। কেটে দু ভাগ করতেই দেখি ভেতরটা চমৎকার লাল। সাজু আমার পড়ার ঘরে এল। আধখানা পেয়ারা ওর হাতে দিয়ে বাকি আধখানা বাবাকে দিতে চালমি। মা ডাক দিয়ে সাজুকে বলল, রাতে আমাদের সঙ্গে খেয়ো। সঙ্গে সঙ্গে সে বিনম্র ও দৃঢ় গলায় জরুরী কাজ আছে বলে জানিয়ে দিল। বাবার ঘরে যেতে যেতে আমি শুনলাম।
আমার বুক তখন জোরে জোরে ধুকপুক করছে। সাজু থাকবে না ? খেয়ে গেলে কথা বলার সুযোগ পেতাম। সে যুদ্ধে যাচ্ছে। সন্ধের অন্ধকার নামার সঙ্গে সঙ্গে সে চলে যাবে। আবার কবে আসবে, কবে দেখা হবে জানি না। বাবার কাছে যেতে যেতে কল্পনায় আমি দেখছি পুরাণোক্ত বীরের মত সে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে, আমি তাকে টিপ পরিয়ে দিচ্ছি, তার হাতে অস্ত্র তুলে দিচ্ছি, তূণে একটি একটি করে বাছাই করা তীর সাজিয়ে দিচ্ছি...। সাজু আমার দিকে পরিপূর্ণ চোখ মেলে তাকাচ্ছে। আমার ইচ্ছে পূরণ হচ্ছে, আমাকে চুমু খাচ্ছে ...।
বাবার কাছ থেকে ফিরে এসে দেখি সাজু মাকে বলে চলে যাবার জন্যে তৈরি হচ্ছে। তার একটুও সময় নেই. মা ঘরের দাওয়ায় দাঁড়িয়ে আছে । ছুটে গেলাম দরজায়। উঠোনে নামতে নামতে সাজু বাড়ী পেরিয়ে রাস্তার মুখে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। উদভ্রান্ত চুলে ফিরে তাকিয়ে সে বলল, বকুল, আমার এক মুহর্তও সময় নেই, বিশ্বাস করো, মাত্র কয়েক মিনিটের সময় নিয়ে এসেছি। ইউসুফ আমার জন্যে অপেক্ষা করছে। আমি গেলেই নৌকো ছাড়বে।
অমাদের মাথার ওপর নাগকেশর ও অশোকের ছায়া-আঁধার। অস্থির হয়ে সে আবার বলল, সাবধানে থেকো বকুল, শুধু তোমাকে এক পলক দেখার জন্যে ছুটে এসেছি, কোনো কথাই বলা হল না, হাতে একটুও সময় নেই।
বলেই সে আমাকে গভীর ও মধুর আবেগে বুকে চেপে ক্ষণস্থায়ী একটি চুমু খেয়ে ছুটে চলে গেল। ঐটুকু সময়ের মধ্যে আমি অবশ হয়ে গেলাম, আমি ঐ অল্পক্ষণে লক্ষ লক্ষ বছর স্বপ্নে ঘুরে এলাম কিন্তু কোনো কথাই মুখে জোগালো না।
উঠোনের খোলামেলা জায়গায় এসে দেখলাম মা আমার পড়ার ঘরে ঢুকছে। বসন্তের আমেজ ছাপিয়ে শীতের কনকনে হাওয়া নামল হঠাৎ। আস্তে আস্তে আমিও মায়ের পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। মা পেছন ফিরে পেয়ারার প্লেটখানা আমার হাতে তুলে দিলকিছু না বলে। সাজু আধখানা খেয়ে বাকি আধখানা রেখে গেছে।
ভাবলাম মা বুঝি নিজের হাতে ওটা ফেলতে চায় না বলেই আমাকে দিল। মনে মনে লজ্জা পেলাম এবং সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল বাবার রাখা খাবার মা কত সহজে ও স্বাভাবিকভাবে খেয়ে নেয় সে-কথা।
মা হয়তো তা ভেবে প্লেটটা আমার হাতে দিয়েছে। সুখের কান্না তখন আমার গলা ছেপে বেরিয়ে আসতে চাইছে এবং আমার সুখের জগৎটাকে একান্ত করে অনুভব করার জন্যে মায়ের কাছ থেকে নিজেকে লুকোতে চাইছি। মা বুঝতে পেরেই হয়তো বলল, আমি যাই, তোর বাবাকে খাবার দিয়ে আসি।
অসুস্থ হওয়া অব্দি বাবা সন্ধের পর পরই খেয়ে নেয় । মা-ই সব সময় খেতে দেয়। আমি সাজুর কথা ভেবে মায়ের মুখের দিকে তাকালাম। পৃথিবীতে একমাত্র মায়ের কাছেই সব কথা বলি আমি। এজন্য মাকে সবকিছু খুলে না বললেও অনেক কিছু বুঝে নিতে পারে। মা এক ঝলক হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
টকটকে লাল পেয়ারার ওপর সাজুর দাঁতের ছাপ বসে আছে। আমি ভালো করে দেখতে লাগলাম সে এক কামড়ে খেয়েছে নাকি দু কামড় দিয়েছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস আধখানা পেয়ারা সে আমার জন্যেই রেখে গেছে। আস্তে আস্তে ওতে কামড় দিলাম আমি। সঙ্গে সঙ্গে ওর চুমুর কথা মনে পড়ল।
পেয়ারার এক রকম মিষ্টি-কষায় স্বাদ জিব ভরে তুলল। মা ও সাজুর কথা এবং সেই সুখদুঃখ নিয়ে চিবুতে লাগলাম। খেতে খেতে বাবার ঘরে গেলাম উকি দিতে। বাবাও একটুখানি পেয়ারা মায়ের জন্যে রেখে দিয়েছে। আমার বুক ভরে উঠল।
বাকি পেয়ারাটুকু খেতে খেতে মনে হল যুদ্ধ থেকে সাজুর ফিরে আসা পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করতে পারব।
মা তখন বাবার জন্যে রুটি ও তরকারী নিয়ে অমির পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। মধুর হাসি মুখে নিয়ে মা বলল, চুরি করে কী দেখতে এসেছিস?
গাছেরা যদি তা বুঝতে পেরে থাকে তাহলে সে অনেক পেয়েছে। আমার বিশ্বাস গাছও ভালোবাসা বোঝে, নইলে অত তরতর করে বাড়ল কি করে ? মনে হয় কাছে গেলে সে পাতার হাত দিয়ে আমাকে ডাকে, গা দুলিয়ে আনন্দ প্রকাশ করে, পুনপুন করে কথা বলে, হা, ঠোঁট উল্টিয়ে অভিমানও প্রকাশ করে। একেবারে যেন একটি ভালোবাসার গল্প..
আর সন্ধে হতে না হতেই পাতারা বেশ উর্ধ্বমুখী হয়ে যায়, আবার সূর্য ওঠার একটু পরেই দিনের কাজের জন্য তৈরি হয়ে স্বাভাবিক হয়ে যায়। হ্যা, অমি ওর স্বভাব-চরিত্র বুঝে নিয়েছি।
এবার আমার পরিচয় দেই। আমার নাম অদিল। মা অদর করে বকুল নামেও ডাকে। বাবা হঠাৎ করে অসুখে পড়ে শয্যাশায়ী। মা সারাদিন সংসারের কাজে ব্যস্ত। আমি বি. এ. পড়ছি। ১৯৭১ সাল।
জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি গেল উত্তাল আন্দোলনে আর মার্চ মাস শেষ হতেই ছোট ভাই না বলে না কয়ে মুক্তিযুদ্ধে চলে গেল। সাদী আমার পিঠোপিঠি এবং একমাত্র ভাই। বাবা সম্ভবত ওর কারণেই শয্যাশায়ী, প্রেসারে ভুগছে। মা মাঝে-মধ্যে সাদীর কথা বলে। সব কথার শেষে বলে, প্রিয়জনের জন্য মানুষকে অপেক্ষা করতে হয়। আমিও অপেক্ষা করছি।
সেদিন আমি জানালার এক কোণে দাঁড়িয়ে মায়ের বলা অপেক্ষা করার কথা নিয়ে ভাবছি। হঠাৎ মনে হল পেয়ারা গাছটি পাতার হাতছানিতে আমাকে ডাকছে। বলল, চালের ছন ও আমার পাতার ফাঁকে একটি বড় পেয়ারা আছে, ওটা তুমি খুঁজে নাও। দ্যাখো কেমন ডাসা হয়ে উঠেছে আর সোনালী রঙটিও দেখার মত।
অমনি খুজে-পেতে পেয়ে হাততালি দিয়ে মাকে ডাক দিলাম, মা,দ্যাখো দ্যাখো , একটি পেয়ারা। আমার গাছের প্রথম ফল। মা রান্নাঘর থেকে দরজা দিয়ে মুখ বের করে দেখল। কী দেখল আমি জানি না। মুখে হাসি মেখে শুধু বলল, পাড়তে পারবি? পেকেছে ?
সঙ্গে সঙ্গে বললাম, পারব, নিশ্চয়ই পারব। ডাশা হয়েছে। মা ঘরে চলে গেল। কড়াই ও খন্তির শব্দ শুনতে শুনতে আমিও পেয়ারা গাছে উঠছি। যে ডালে পেয়ারী সে ডালটি অমার ভার সইতে পারল না বলে নেমে পড়লাম। ঠিক সে সময় এল সাজুর ছোট ভাই তপু। ওর বয়স দশ কি এগারো। চিরচঞ্চল ছেলে। ওকে বলতেই তরতর করে গাছে উঠে গেল। ওপর থেকে মাথা কাত করে বলল, একটা কাঠি বা কিছু দাও, আর উঠতে পারছি না। আমার ভার সইতে পারছে না। কী সুন্দর পেয়ারা !
উঠোন থেকে বাঁশের একটা কাঠি তুলে দিলাম। সে পেড়ে দিল । পেয়ারা নিয়ে খুশি হয়ে ছুটলাম মায়ের কাছে। মা বলল, বেশ বড় তো, সুন্দর গন্ধ।
খাঁটি সোনা রঙ ও মিষ্টি গন্ধ ছাড়ছে। মা রুটি মলতে মলতে বলল, কেটে ভাগ করে খেয়ে নে, তোর বাবাকেও দিস। দৌড়ে বাবার কাছে গেলাম। বাবা আধো ঘুমে, অধো জাগরণে। প্রেসারের ঘোরে বাবা এভাবে শুয়ে থাকে। বাবাকে ডাকলাম, বাবা, ও বাবা, পেয়ারা খাবে? নতুন গাছে ধরেছে।
তন্দ্রা থেকে জেগে বলল, এক টুকরো দে। তারপর পেয়ারাটি দেখতে দেখতে বলল, আমাদের ঘাটের পাশের গাছেও প্রথম প্রথম এত বড় পেয়ারা হতো। ঠিক সে সময় মাকে ডাকতে ডাকতে ঘরে ঢুকল সাজু।
আমি দরজা পেরিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে উকি মেরে সাজুকে দেখতে পেলাম। তপু ততক্ষণে উধাও হয়ে গেছে। ভাবছি সন্ধের ঠিক আগ মুহর্তে পেয়ারাটি কাটব কিনা, বাবাকে অসময়ে খেতে দেব কিনা।
অবেলায় পেয়ারা খাওয়া ঠিক নয় বাবাই শিখিয়েছে। কিন্তু নতুন গাছের পেয়ারা বলে ধৈর্য ধরতে পারছি না। সাজুর ডাকে মা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে সাড়া দিল। কাছে ডাকল। আমি ইশারা করার আগেই সাজু আমাকে এক চোখে মুহুর্তের মধ্যে অনেক কথা জানিয়ে দিল। মা আমাকে ডেকে বলল, সাজুকেও পেয়ারা দিস ।
আমি তাড়াতাড়ি পেয়ারা কাটার ছোরা ও দুটো প্লেট নিলাম। সাজুকে খেতে দিতে পারব। কেটে দু ভাগ করতেই দেখি ভেতরটা চমৎকার লাল। সাজু আমার পড়ার ঘরে এল। আধখানা পেয়ারা ওর হাতে দিয়ে বাকি আধখানা বাবাকে দিতে চালমি। মা ডাক দিয়ে সাজুকে বলল, রাতে আমাদের সঙ্গে খেয়ো। সঙ্গে সঙ্গে সে বিনম্র ও দৃঢ় গলায় জরুরী কাজ আছে বলে জানিয়ে দিল। বাবার ঘরে যেতে যেতে আমি শুনলাম।
আমার বুক তখন জোরে জোরে ধুকপুক করছে। সাজু থাকবে না ? খেয়ে গেলে কথা বলার সুযোগ পেতাম। সে যুদ্ধে যাচ্ছে। সন্ধের অন্ধকার নামার সঙ্গে সঙ্গে সে চলে যাবে। আবার কবে আসবে, কবে দেখা হবে জানি না। বাবার কাছে যেতে যেতে কল্পনায় আমি দেখছি পুরাণোক্ত বীরের মত সে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে, আমি তাকে টিপ পরিয়ে দিচ্ছি, তার হাতে অস্ত্র তুলে দিচ্ছি, তূণে একটি একটি করে বাছাই করা তীর সাজিয়ে দিচ্ছি...। সাজু আমার দিকে পরিপূর্ণ চোখ মেলে তাকাচ্ছে। আমার ইচ্ছে পূরণ হচ্ছে, আমাকে চুমু খাচ্ছে ...।
বাবার কাছ থেকে ফিরে এসে দেখি সাজু মাকে বলে চলে যাবার জন্যে তৈরি হচ্ছে। তার একটুও সময় নেই. মা ঘরের দাওয়ায় দাঁড়িয়ে আছে । ছুটে গেলাম দরজায়। উঠোনে নামতে নামতে সাজু বাড়ী পেরিয়ে রাস্তার মুখে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। উদভ্রান্ত চুলে ফিরে তাকিয়ে সে বলল, বকুল, আমার এক মুহর্তও সময় নেই, বিশ্বাস করো, মাত্র কয়েক মিনিটের সময় নিয়ে এসেছি। ইউসুফ আমার জন্যে অপেক্ষা করছে। আমি গেলেই নৌকো ছাড়বে।
অমাদের মাথার ওপর নাগকেশর ও অশোকের ছায়া-আঁধার। অস্থির হয়ে সে আবার বলল, সাবধানে থেকো বকুল, শুধু তোমাকে এক পলক দেখার জন্যে ছুটে এসেছি, কোনো কথাই বলা হল না, হাতে একটুও সময় নেই।
বলেই সে আমাকে গভীর ও মধুর আবেগে বুকে চেপে ক্ষণস্থায়ী একটি চুমু খেয়ে ছুটে চলে গেল। ঐটুকু সময়ের মধ্যে আমি অবশ হয়ে গেলাম, আমি ঐ অল্পক্ষণে লক্ষ লক্ষ বছর স্বপ্নে ঘুরে এলাম কিন্তু কোনো কথাই মুখে জোগালো না।
উঠোনের খোলামেলা জায়গায় এসে দেখলাম মা আমার পড়ার ঘরে ঢুকছে। বসন্তের আমেজ ছাপিয়ে শীতের কনকনে হাওয়া নামল হঠাৎ। আস্তে আস্তে আমিও মায়ের পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। মা পেছন ফিরে পেয়ারার প্লেটখানা আমার হাতে তুলে দিলকিছু না বলে। সাজু আধখানা খেয়ে বাকি আধখানা রেখে গেছে।
ভাবলাম মা বুঝি নিজের হাতে ওটা ফেলতে চায় না বলেই আমাকে দিল। মনে মনে লজ্জা পেলাম এবং সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল বাবার রাখা খাবার মা কত সহজে ও স্বাভাবিকভাবে খেয়ে নেয় সে-কথা।
মা হয়তো তা ভেবে প্লেটটা আমার হাতে দিয়েছে। সুখের কান্না তখন আমার গলা ছেপে বেরিয়ে আসতে চাইছে এবং আমার সুখের জগৎটাকে একান্ত করে অনুভব করার জন্যে মায়ের কাছ থেকে নিজেকে লুকোতে চাইছি। মা বুঝতে পেরেই হয়তো বলল, আমি যাই, তোর বাবাকে খাবার দিয়ে আসি।
অসুস্থ হওয়া অব্দি বাবা সন্ধের পর পরই খেয়ে নেয় । মা-ই সব সময় খেতে দেয়। আমি সাজুর কথা ভেবে মায়ের মুখের দিকে তাকালাম। পৃথিবীতে একমাত্র মায়ের কাছেই সব কথা বলি আমি। এজন্য মাকে সবকিছু খুলে না বললেও অনেক কিছু বুঝে নিতে পারে। মা এক ঝলক হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
টকটকে লাল পেয়ারার ওপর সাজুর দাঁতের ছাপ বসে আছে। আমি ভালো করে দেখতে লাগলাম সে এক কামড়ে খেয়েছে নাকি দু কামড় দিয়েছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস আধখানা পেয়ারা সে আমার জন্যেই রেখে গেছে। আস্তে আস্তে ওতে কামড় দিলাম আমি। সঙ্গে সঙ্গে ওর চুমুর কথা মনে পড়ল।
পেয়ারার এক রকম মিষ্টি-কষায় স্বাদ জিব ভরে তুলল। মা ও সাজুর কথা এবং সেই সুখদুঃখ নিয়ে চিবুতে লাগলাম। খেতে খেতে বাবার ঘরে গেলাম উকি দিতে। বাবাও একটুখানি পেয়ারা মায়ের জন্যে রেখে দিয়েছে। আমার বুক ভরে উঠল।
বাকি পেয়ারাটুকু খেতে খেতে মনে হল যুদ্ধ থেকে সাজুর ফিরে আসা পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করতে পারব।
মা তখন বাবার জন্যে রুটি ও তরকারী নিয়ে অমির পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। মধুর হাসি মুখে নিয়ে মা বলল, চুরি করে কী দেখতে এসেছিস?
আরো নতুন নতুন valobasar Golpo পড়তে ভিজিট করুন
উত্তরমুছুনWWW.VALOBASARGOLPO2.XYZ