এই নিয়ে তিনবার হল। তিনবার তিনরকম ভাবে চেষ্টা করে তাপস বসে পড়েছে ছাদের মেঝেতে। ঘুড়ি ওড়েনি।
"তুমি ঘুড়ি ওড়াতে পারাে না?”
`না।'
‘এই যে বললে ঘুড়িটা উই উঁচুতে তুলে দেবে? দিচ্ছ না কেন? ও বাবা, ও বাবা - `
বিরক্ত তাপস এই সকালবেলা জীবনের হাজারাে অকৃতকার্যতার সঙ্গে আর একটার সংযােজন করে আরও বিরক্ত হল। একটা ঘুড়ি, উড়ল না।
ছেলেবেলায় দাদা ঘুড়ি ওড়াত। তাপস শুধুই লাটাই ধরে দাঁড়িয়ে থাকত। প্যাচ খেলার সময় ও শুধু বলত ভাে কাট্টা, ব্যস ওই পর্যন্তই। ঘুড়ি ওড়ানাে শেখা হয়নি। অবশ্য অনেক কিছুই শেখা হয়নি তাপসের। সর্বাণী খোঁচা দেয় দু বেলা--ফিউজ লাগাতে পারাে না, ছেলের খাতায় একটা ছবি আঁকতে পারে না। সাইকেল চালাওনি কোনও দিন। সাঁতার। ছি ছি বােলাে না কাউকে--
আর একবার চেষ্টা করার জন্য লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায় তাপস। ঘুড়িটাকে কল খাটিয়ে গেড়াে দিতে দিতে ও আবিষ্কার করল যে এই টেকনলজিটা বেশ কঠিন; এবং এটাও জানার জিনিস এবং এটাও সে জানে না। বুম্বা আবার লাটাই ধরেছে। ঘড়িটাকে ছাদ থেকে খানিকটা নীচে ঝুলিয়ে হেঁচকা টান মারে তাপস। ফরফর ফরত ফর। শব্দের পর শব্দ উঠল, বুম্বা সমানে চিৎকার করছে, উড়ে যাচ্ছে। বাবা, উড়ছে উড়ছে।
ঠক ।
একেবারে গােত্তা খেয়ে ছাদের মেঝেতে মুখ থুবড়ে পড়ল ঘুড়ি। পিতা-পুত্র নির্বাক হয়ে সেই পতনের দিকে তাকিয়ে রইল। পতনের পরেই বিলাপ। একেবারে মহাকাব্যের নিয়ম মেনে বুম্বা ভ্যা করে কেঁদে ফেলেছে।
তাপস চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। এখন পর্যন্ত জীবনের সমস্ত অকৃতকার্যতা যেন ম্লান হয়ে উঠেছে এই অপদার্থতার কাছে। ছােট্ট শিশুটাও তাকে বুঝে ফেলেছে।
ছাই-মাখা আকাশে জমাট বাঁধা মেঘ তখন একটু একটু করে ইলশেগুঁড়ি ছড়াতে শুরু করেছে। কয়েকটা বড় জলের ফোটা গায়ে পড়তে তাপস এই মহান সংগ্রামের আসন্ন সমাপ্তি অনুমান করে স্বস্তি পায়। লাটাইসুতাে ঘুড়ি আর বুম্বাকে বগলদাবা করে নীচে নামবার জন্য পা বাড়াতে বুম্বা আবার কান্না শুরু করল প্রবল বেগে। বৃষ্টির বেগ আর কান্নার বেগের অনুপাত হিসেব করতে গিয়ে তাপসকে আবার থমকে দাঁড়াতে হল। আর একবার শেষ চেষ্টা। ঘুড়ি নামিয়ে দিতে হল নীচে। প্রাণপণে হেঁচকা টান। ছাদের দেয়ালে মাথা ঠুকে কাগজ ছিড়ল ঘুড়ি উড়ল না।
এবার আর সময় নেই। বৃষ্টির ফোটাগুলাে বেশ বড় আকারে নেমে আসছে। তাপস আবার সব সাজিয়ে গুছিয়ে নীচে নামবার তােড়জোড় করতে গিয়ে চমকে উঠল। সামনে ফাকা, মাঠটার ওপারে হলুদবাড়ির দোতলায় অপর্ণা। বারান্দার গ্রিলটাকে আঁকড়ে ধরে হাে হাে করে হাসছে। হাত নেড়ে ইশারায় বলছে নেমে যাও, নেমে যাও, ঘুড়ি ওড়ানাে তােমার কম্ম নয়।
তাপস বৃষ্টির মাঝে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকে হলুদ বাড়ির গ্রিলের দিকে। অবিন্যস্ত মানিপ্ল্যান্টের ঝাঝরির মধ্যে অস্পষ্ট মুখ। অপর্ণা। মুখখানি বৃষ্টির জলে ঝাপসা হয়ে আসার আগেই সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামতে শুরু করে তাপস।
ও বাবা, আর উড়বে না ঘুড়ি? কেন? বৃষ্টি পড়ছে কেন? বৃষ্টিতে ঘুড়ি ওড়ে না?
কেন?
জানি না। তাপসের ধমকটা নিষ্ঠুরের মতাে শােনালেও কিছু করার নেই ওর । সিড়িগুলাে পেরােতে ঘুড়ি লাটাই বুম্বা ইত্যাদিরা সব মুছে মুছে যাচ্ছে। নিজেদের পায়ের শব্দ, প্রত্যেকটা দরজায় টিভি, টেপরেকর্ডার আর কাজের লোকদের হৈ হৈ রৈ রৈ মুহুর্তে-মুছে গিয়ে কানে একটানা বাজতে শুরু করেছে শুধু ঝেপে আসা বৃষ্টির এপিটাফ।
চোখের সামনে হলুদবাড়ি। গ্রিলটা আকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে থাকা মুখ। অপর্ণা। কতদিন পরে দেখল অপর্ণাকে? কবে এল? কখন এসে দাঁড়াল বাবান্দায়? সেই বারান্দা-চৌকো মােজাইক মানিপ্ল্যান্টের অগােছালাে বিন্যাস। গ্রিলে ষড়ভুজের ঘােট ঘােট ডিজাইন মাঝে মাঝেই অপর্ণার হাত, ঢুকে যেত ফোকর গুলােতে। একবার করাত দিয়ে গ্রিল কেটে হাত বার করতে হয়েছিল। জায়গাটা বােধহয় এখনও ফাঁকা রয়েছে।
অপর্ণা মানে জানাে?
হ্যা।
কী। বলব কেন? জানাে না বলবে কী-- অপর্ণা মুখ ভেংচে গম্ভীর গলায় বলল, অপর্ণা সেন, সিনেমা করে..
তাপস হাসতে হাসতে বসে পড়েছিল গ্রিলের কাছে ওই সােফাটায়। কিছুক্ষণ আগে বাংলা অভিধান ঘেঁটে জেনে নেওয়া শব্দটা হুবহু মুখস্থ করে নিয়েছিল সে। অপর্ণা অর্থাৎ যিনি তপস্যা কালেও পর্ণ অর্থাৎ পাতা পর্যন্ত আহার করেন নাই-সং: স্ত্রী,
আমাকে সং বললে তুমি। সং বললাম কোথায়! এই তাে বললে- তাপস শব্দ করে হেসে উঠে বােঝাবার চেষ্টা করল যে সং, মানে সংস্কৃত। অপর্ণা কথাটা সংস্কৃত শব্দ।
অপর্ণা ততক্ষণে ঝাপিয়ে পড়েছে তাপসের গায়ে। চুলের মুঠি ধরে হেঁচকা টান ‘আমাকে তুমি স্ত্রী বলেছ---
স্ত্রী!
তাপস আরও জোরে হাসতে হাসতে চুল ছাড়াবার চেষ্টা করে “আরে শব্দটা স্ত্রী লিঙ্গ...'
তাপসের চুল ছেড়ে অপর্ণা কোমরে দু হাত রেখে চোখ বড় করে জোর ধমক দেয়, ‘তুমি ফের মাস্টারি করছ আমার উপর। দেখবে, দেখবে, কে কী খায়..
আর ঠিক তখনই অপর্ণা চিৎকার করে উঠেছিল, ‘এ মা আমার হাত আটকে গেছে। কী হবে? তাপস আশ্চর্য হয়ে দেখল গ্রিলের ফোকরে আপর্ণার হাত আটকে গেছে।
বেশ জোরে বৃষ্টি নেমেছে। পিতা পুত্রের অকৃতকার্যতা বেশ খানিক্ষণ তারিয়ে তারিয়ে উপভােগ করার পর সর্বাণীর হাসি থামল। ঘুড়ি ওড়াতে জানাে না। পাঁচতলার ছাদে এত হাওয়া -উড়ল না !'
বিছানায় বসে চায়ে চুমুক দিতে দিতে তাপস মাথা নাড়ে---না গাে, ওটা যে এত কঠিন সাবজেক্ট এতদিন বুঝতেই পারিনি। ভাবলাম অত হাওয়ায় দু-চারটে টান মারলেই উঠে যাবে উপরে। বৃষ্টি কমলে আবার চেষ্টা কবা যাবে...
‘অনেক হয়েছে। ঘুড়ি লাটাই আলমারীর মাথায় সাজিয়ে রাখতে রাখতে সর্বাণী আবার হাসে।
বৃষ্টি কখন কমবে বাবা? তা তাে জানি না--- কেন জানাে না?
তাপস হাসতে গিয়েই থেমে যায়। ছােট্ট ছেলেটার প্রশ্ন করার ভঙ্গিটা হুবহু একরকম। আবার মনে পড়ে তাকে। বৃষ্টির এই আধখেচড়া ছাটে চায়ের মধ্যে দু এক ফোটা জল পড়তে জানলাটা বন্ধ করতে এগিয়ে যায় তাপস। ঘাটের জল তার মুখ চোখ ভিজিয়ে দেয়। বৃষ্টি বৃষ্টি...
"তুমি বৃষ্টিতে ভেজো?"
কেন? আশ্চর্য তো! বৃষ্টিতে কেউ ভেজে ? ঠাণ্ডা লাগে যে !
অপর্ণা ঠোট উল্টে ওদের ছাদের কিনারে দাঁড়িয়ে নীচের মানুষ দেখত। কাগজের পুটলি বানিয়ে ছুড়ে দিত নীচের হেঁটে যাওয়া লােকেদের মাথায়। বিশেষ করে টাক মাথা দেখলেই এমনটা করত--‘আমি টাক সহ্য করতে পারি না। তােমার টাক হলে আমি লাঠি দিয়ে মাথা ফাটিয়ে দেবাে--
রক্ত বেরােবে যে। বেরোক । রক্ত বেরলে কি হয়?
তাপস চা শেষ করে জানলার বাইরে ইচ্ছে করেই মুখ বাড়িয়ে রাখল। মুখে চোখে বৃষ্টির রোঁয়াগুলাে যথেচ্ছ ভাবে খেলে যাচ্ছে-বারান্দার ফাইবার গ্লাসের করােগেটেড শেডটার উপর জল পড়ে টিপ টপ টিপ টপ শব্দগুলাে এক তালে যেন বলে চলেছে অপর্ণা-অপর্ণা...
তাপস বিছানা ছেড়ে বাইরের বারান্দায় এসে দাঁড়াল। বর্ষার এই এলােমেলাে জল, কালাে চুলের মতাে মেঘ আর ঝমঝম শব্দ এই চল্লিশ ছুঁই ছুঁই মনটার ভেতর থেকে তেড়ে ফুড়ে বাইশ বছরের তাপসকে কে যেন কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখে বারান্দায়। ঝাপসা জলের পরদার মধ্য দিয়ে, তাপস দেখতে থাকে হলুদবাড়ির চিলেকোঠা।
চিলেকোঠায় লুকিয়ে থাকি চল! কেন? কেউ দেখতে পাবে না আমাদের... কেন?
আরে দূর বােকা, তুমি বড় বােকা, একেবারে হাঁদা-গঙ্গারাম।
ও মা তােমার গোঁফ উঠেছে! এ মা !
কুড়ি বছরের তাপস ষােলাে বছরের অপর্ণার হাত ধরে উঠে গিয়েছিল ওই চিলেকোঠাব ঘরে; একদিন বর্ষার এমনই দিনে। তারপর বৃষ্টি বৃষ্টি। ঘন কালাে আকাশে থরাে থরাে মেঘ। বিদ্যুতের চমকের সাথে কেঁপে কেঁপে ওঠা... চলাে বৃষ্টিতে ভিজি... কেন?
অপর্ণা রাগ করে একাই দাঁড়িয়েছিল ছাদের মেঝেতে বৃষ্টির জলে। ধীরে ধীরে যােলাে বছরের শরীর ফুটে উঠেছিল আবরণ ছাড়িয়ে। তাপস চিলেকোঠার দরজায় গড়িয়ে অবাক হয়ে দেখেছে। বিদ্যুতের চমক হার মেনেছিল এই চমকের কাছে।
ঠাণ্ডা লাগবে। লাগুক। ঠাণ্ডা লাগলে কী হয়? জ্বর হয়। জ্বর হলে কী হয়?
অপর্ণা, অপর্ণা। করােগেটেড শিটের উপর বৃষ্টির জল তখনও একনাগাড়ে শব্দ কবে চলেছে। শুনতে শুনতে একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়ে তাপস। মনের মধ্যে আনন্দ, বেদনা, ছেড়া ছেড়া ভাল লাগা। তারপর হেরে যাওয়া।
আমি পাস করেছি। এই যে আমি পাস করেছি ফাস্ট ডিভিশন।
তাপসের বুকের মধ্যে কেউ যেন লাফ মারল দুটো। ফার্স্ট ডিভিশন। তাপস আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিল। নিজে ও বরাবর সেকেন্ড ডিভিশন। অপর্ণা যেন সেই প্রথম একাই বড় মাপের লাফ দিল। একলাফে ছিটকে গেল অনেকটা।
বাবা, ও বাবা বৃষ্টি থামবে না?
তাপস আকাশের দিকে তাকিয়েছিল, মুখ ফিরিয়ে বুম্বার দিকে তাকিয়ে লজ্জা পায়। ছােট ছেলেটা উৎকণ্ঠা নিয়ে আকাশ দেখছে। কখন বৃষ্টি সরে যাবে-তার ঘুড়ি উড়বে। দুদিন ধরে সমানে বায়না করছে, ঘুড়ি, ঘুড়ি..
তাপস মাথা নাড়ে-থামবে, নিশ্চয়ই থামবে।
কখন? এই তাে একটু পরে। তখন আবার আমরা ছাদে যাব? তখন আবার ঘুড়ি উড়বে?
বুম্বার মুখের উজ্জ্বল হয়ে ওঠাটা পুরােপুরি দেখতে পায় না তাপস। তার আগেই তার দৃষ্টি চলে যায় আবার হলুদ বাড়ির চিলেকোঠার ছাদের অংশটায়। জোট বাঁধা কালাে মেঘ সেখানে থিথিক করছে। এই বৃষ্টি না থামাই ভাল। বৃষ্টি থামলেই তাকে আবার উঠে যেতে হবে ছাদে। আবার ঘুড়ি ওড়াতে গিয়ে না পারা। আবার অপর্ণার হাসি- পাশে বসে আছে তার স্বামী। ইঞ্জিনিয়ার। টিকলাে নাম। ছ'ফুট লম্বা। ঝকঝকে। সপ্রতিভ। প্রবাসী ভারতীয়। ওদের বিয়ের কয়েকদিন পরেই পরিচয় হয়েছিল তার সাথে তাপসের।
এই যে তাপসবাবু। আমি মশাই আপনাকেই খুঁজছি-- তাপস খানিকটা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে ভদ্রলােক হাে হাে করে হাসেন। অপ্রস্তুত তাপস একেবারে সংকুচিত হয়ে গিয়েছিল।
আপনি হলেন আমার মিসেসের একমাত্র বয়ফ্রেন্ড অ্যান্ড অ্যাজ সি ক্লেমস ইউ আর হার অপু ইন পথের পাঁচালি, অপু ইন অপরাজিত অ্যান্ড অপু ইন...
তাপস লজ্জায় একেবারে মাটিতে মিশে গিয়েছিল। লজ্জা পেয়ে ওর কান লাল হয়—
আপনি লজ্জা পাচ্ছেন কেন মশাই? এদেশের লােকেরা ফ্রেন্ডশিপ বােঝে না। একজন নারীও যে একটা পুরুষের যথার্থ বন্ধু হতে পারে, এটা কিন্তু আমি বিশ্বাস করি। আসুন আপনাদের এই পবিত্র বন্ধুত্বের দীর্ঘ স্বাস্থ্য কামনা করে যদিও এনিয়ে আমাদের মদ্যপান করা উচিত; তা এই নতুন শ্বশুরবাড়িতে সেটা তাে সম্ভব নয়-তাই আপাতত সিগারেট পান করি, আসুন।
ভদ্রলােক সিগারেট বাড়িয়ে ধরতে আরও সংকুচিত হয়ে ওঠে তাপস। তার তখন টিউশনির মাইনেতে বিড়ি খাওয়া শুরু হয়েছে, তাও লুকিয়ে।
ইতিমধ্যে অপর্ণা ঘরে ঢুকে পড়তে ভদ্রলােক উঠে দাঁড়ান এবং একমিনিট’ বলে বাইরে চলে যান।
অপর্ণা। লাল সিল্কের শাড়ি। লাল রাউজ। টকটকে ফরসা নাকে নতুন সিঁদুরের গুড়াে লুটোপুটি খাচ্ছে। হাসি খুশি। দারুণ মানিয়েছিল দুজনকে।
তাপস মাথা নামাতে নামাতে নিজের হেরে যাওয়া মেনে নিয়েছিল। সােফায় বসে রয়েছে অপর্ণা। তাপসের মনে হয়েছিল যেন কত দূরে বসে মুচকি মুচকি হাসছে। অথচ কয়েকদিন আগেও এই অপর্ণা ছিল কত সুলভ। সহজ। একদিন বর্ষার এমনি দিনে সারা কলকাতা ভাসিয়ে এসেছিল সেদিনের বৃষ্টি।
তাপস বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছিল। এমনি দিনে তার...... .......
কলেজের বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়েছিল অপর্ণা। তুমি এখানে? এই বৃষ্টিতে বেবিয়েছ কেন?'
তাপস উত্তর দেয়নি। অপর্ণা বইপত্রগুলাে তাড়াতাড়ি তাপসকে গছিয়ে রাস্তায় নেমে পড়তে তাপস বাঁধা দিয়েছিল, ‘একি। জল মাড়িয়ে রাস্তায় নাম কেন? দাঁড়াও, বাস আসুক'-
অপর্ণা ভ্রুক্ষেপ না করে নেমে গিয়েছিল প্রায় হাঁটু জলে। কাপড়টা অনেকটা তুলে হাঁটছিল ও। বাস-ট্রামের ঢেউয়ে দুলে দুলে উঠেছিল শরীর। অগত্যা তাপসকেও নামতে হয়েছিল। তারপর হাঁটতে হাঁটতে...
কোথায় যাবে? কোথাও না। তােমার সঙ্গে শুধু হাঁটব। যত দূর চোখ যাবে হাঁটব। না করবে না।
ঝপ ঝপ শব্দে জল কাটতে কাটতে আর ঢেউয়ে দুলতে দুলতে অপর্ণা নিজে অজান্তেই তাপসের হাত ধরে হাঁটছিল। একসময় জলপথ শেষ হয়ে ডাঙায আশ্রয় নিয়েছিল দুটি প্রাণী। পরদা দেওয়া রেস্টুরেন্টে গরম চায়ে মুখ পুড়ে যেতে চোখে জল এসেছিল অপর্ণার।
তাপসেব মনে হয়েছিল এই হল ঠিক মুহূর্ত। ঠিক এই সময় বলা উচিত। অপর্ণা তারপর চা খেল। চপ খেল। আঁচলে জল নিংড়ে নিতে নিতে ভেজা কাপড় ফ্যানের হাওয়ায় মেলে ধরল নির্দ্বিধায়। তাপস শুধু বসে বসে দেখল, বলা হল না কিছু। চোখের সামনে তখন ঘুরপাক খাচ্ছে নিজেদের টালির বাড়ি।
সকাল সন্ধে টিউশনি, আর প্রায় কাছ ঘেঁষে বড় হতে থাকা দুটি বােন। অপর্ণাদেব দোতলা বাড়ি, সাদা গাড়ি। মাঝখানে ব্যবধান। সমুদ্রের মতাে। সেই সমুদ্রের ঢেউ একটু একটু করে সাবাদিনের জমানাে প্রেম আব নিকষিত সাহসকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে একেবাবে স্থবির করে দিয়েছিল তাপসকে।
কী দেখছ? তাপস চোখ নামায়।
চা পাচ্ছ না? ঠাণ্ডা চা খাবে নাকি?
তাপস চুপ করে বেস্টুরেন্টের জানলাটাব বাইরে তাকাতে ধমক দেয় অপর্ণা। শােন, আমার বিয়ে। ছেলে বিদেশে থাকে। তােমার কিছু বলার আছে?
তাপস যেন হাতুড়ির আঘাত খেল মাথায়। মুহুর্তে ছােট চিলেকোঠায় আটকে থাকা শৈশব, স্কুল কলেজ ফালা ফালা করা যৌবনের উচ্ছ্বাস ভাসতে শুরু করল চোখে। বাইবে কেঁপে বৃষ্টি আসছে আবার তখন। আবাৰ জানলাটাব দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হেরে গিয়েছিল তাপস। মাথাটা ক্রমশ নীচের দিকে নেমে গিয়ে দুলেছে দু চাববার।
তারপর...তারপর কাকতালীয় ভাবে টালির বাড়িতে এই মালটিস্টোরিড বাড়ি। তাতে জমির মালিক হিসেবে দুটি কামবার একটি ফ্ল্যাট। সরকাবি কেরানি হবার জন্য মরণপণ।
বােনেদের বিয়ে...টিউশন জীবনের সমাপ্তি। একদিন অফিসফেরত লাল দিঘির ধারে বসে প্রথম মাইনের টাকা হাতে নিয়ে জলের ধারে চুপ করে বসে থেকে প্রশ্ন করেছিল তাপস, কাকে দেব? জলের মধ্যে টুপ টাপ শব্দ হয়ে উত্তর এসেছিল অপর্ণা, অপর্ণা—অনেক অনেক সাহস করে বলে ফেলতে চেয়েছিল সে, অপর্ণা আমি... অথচ তখন সে কত দূরে। তারপর?
তারপর আবার কি! জীবনের প্রয়ােজনে সর্বাণী। তারপর বুম্বা সংসার। একটু একটু করে ভুলে থাকা আপ্রাণ চেষ্টা, খানিকটা কৃতকার্যতা--
কমে গেছে। কমে গেছে, বাবা বৃষ্টি কমে গেছে! তাপস চমকে পিছনে তাকায়। বুম্বা চিৎকার করছে কমে গেছে, কমে গেছে, কমে গেছে--
তাপস আশ্চর্য হয়ে আকাশের দিকে মুখ ফিবিয়ে দেখে বৃষ্টি থেমেছে। কালাে আকাশের ফাঁক দিয়ে বােদ উঠে কবােগেটেড সিটগুলােকে আরও ঝকঝকে করে লছে। এতক্ষণ ওরা একনাগাড়ে বলে যাচ্ছিল অপর্ণা, অপর্ণা।
বুম্বা দৌড়ে ঘরে ঢুকে মায়েব কাছ থেকে ঘুড়ী লাটাই নিয়ে তাপসের জামা ধরে টানতে শুরু করেছে। তাপস হলুদ বাড়ির চিলেকোঠার উপবে জমে থাকা মেঘের টুকরােটা দেখছিল। ওখান থেকে এখুনি আবার বৃষ্টি নেমে আসুক। ভাসিয়ে দিক চরাচর ।হলে তাকে আবার ছাদে যেতে হয় না। নতুন করে অকৃতকার্য হতে হয় না।
আবার অপর্ণা হাসবে যে..
ছাদে জলে জলাকার। তাপস জলের সঙ্গে জ্বরের সম্পর্কটা ভাল করে বুম্বাকে বােঝাবার চেষ্টা করে হার মানল। ঘুড়ির যে অংশটা ছিড়ে গেছে সেখান থেকে হাওয়া পাস করে ঘুড়িকে উড়তে দেবে না, এমন একটা ভাল অজুহাত দেখিয়েও হেরে গেল।
বুম্বার হাতে আর একটি নতুন ঘুড়ি। ঘুড়িতে সুতাে বেঁধে অগত্যা আবার তাকে দাঁড়াতে হল ছাদেব কোণটায়। এবং সেই অপর্ণা। লাল শাড়ি। পাশে বসে তার স্বামী। তাপস মাথা নিচু করে নতুন ঘুড়িটাকে অনেকটা নামিয়ে দিল নীচের দিকে। হাতের খােচায় ও ওড়াবার জন্য টান মারতে ঘুড়িটা গােয়ার্তুমির চুড়ান্ত করে নাজেহাল করতে শুরু করল তাপসকে। বুম্বা আবার লাটাই ধরেছে। উৎসাহে ছটফট করছে ও। বাবার এই না পারার লজ্জাকে বুঝতে পারছে না সে।
উল্টোদিকের হলুদবাড়ির দর্শকরা যেন নড়ে চড়ে বসল। তাপসের যাবতীয় পরীক্ষা নেবার জন্য তৈরি তারা। লাজুক তাপস তাকাতে পারছে না ও দিকে।
সুতােয় খোঁচা মারতে মারতে তাপস আবিষ্কার কবল যে সমস্ত প্রকৃতি তার সঙ্গে বিরুদ্ধাচরণ করছে। মেঘ বৃষ্টি হাওযা --উত্তরদিকে ঐ হলুদ বাড়িটার সামনেই ওকে দাঁড়াতে বাধ্য করছে।
হাওয়া একটু ঘুরে গেলে ছাদের অন্য প্রান্তে দাঁড়ানাে যেত। এ ভাবে ওদের সামনে আসতে হত না।
ফর ফর শব্দে একটু খানি ঘুড়িটা উড়তে বুম্বা চিৎকার করে ওঠে, “বাবা, উড়ছে, উড়ছে। মুহুর্তের জন্য অন্যমন হয়ে যাওয়া তাপস অবাক হয়ে দেখল সত্যিই উল্টোদিক থেকে দমকা একটা হাওয়া ফর ফর করে উড়িয়ে উঁচতে নিয়ে যাচ্ছে ঘুড়িটাকে।
তাপস আশ্চর্য হয়ে দেখতে থাকে। বরাবরের মাথা নিচু করা ব্যক্তিত্বটা যেন একলাফে ঘুড়িটার সঙ্গে উঠে যেতে থাকে উপরের আকাশে।
বুম্বা খিল খিল করে হাসছে। ওদিকে হলুদবাড়ির গ্রিল থেকে ওরা স্বামী-স্ত্রী হাততালি দিচ্ছে জোরে ।
ঘুড়িটা বেশ উপরে উঠেছে।
তাপসের হাত থেকে সুতাে বেরিয়ে যাচ্ছে দ্রুত। সােজাসুজি বেশ খানিকটা উঠে এবার ডানদিকে হেলে যাচ্ছে। নিজে নিজেই। তাপস জানে না, কী করা উচিত। সুতােয় জোরে টান মারে সে। ঘুড়ি আবার সােজা হল, আবার হেলে যাচ্ছে বাঁ দিকে।
তাপস প্রাণপণে টান মারে সুতােয়।
ঘুড়ি বাঁ দিকে নামছে। নামছে। বুম্বা চিৎকার করছে। বাবা নেমে যাচ্ছে। নেমে যাচ্ছে। তুলে দাও, তুলে দাও বাবা! তাপস পাগলের মতাে সুতাে টানে।
অপদার্থ ঘুড়িটা এই যাবতীয় চেষ্টায় কোন ভ্রুক্ষেপ না করে ঝপ করে নেমে গেল। আর যাবি তাে যা একেবারে হলুদবাড়ির চিলেকোঠায়। কার্নিসে আটকে থেকে যেন মজা করতে থাকে ঘুড়ি।
তাপস হতাশ হয়ে তাকিয়ে থাকে ঘুড়িটার দিকে। একটা সরলরেখা তৈরি করে সুতাে স্থির হয়। বুম্বা ততক্ষণে আবার ভ্যা শব্দে কান্না জুড়েছে।
তাপস আবার তাকায় হলুদবাড়ির দোতলায়। ওরা হাে হাে করে হাসছে। অপর্ণা দু হাতে মুখ চেপে বসে পড়েছে। চোখ নামিয়ে তাপস দাঁড়িয়ে থাকে।
হাসাে। হেসে যাও অপর্ণা। ঠাট্টা করে যাও-- সাদাকালাে আকাশের দিকে মুখ তুলে তাপস ওই একই কথার পুনরাবৃত্তি করে। সেখানে তখন মেঘেরা হাওয়ায় হাওয়ায় উড়ে চলেছে। আলাে ঠিকরে বেরিয়ে আসছে, বাঃ বাঃ এই তাে চাই। যখন আলাে চেয়েছি তখন অন্ধকার এনে দিয়েছ, যখন মেঘ চাইলাম তখন... তােমার আর কি?
আজ ঠিক এই দিনটিতে বৃষ্টি দিয়ে চরাচরকে একেবারে ভাসিয়ে দিতে পারলে না? একটি চল্লিশ ছুঁতে আসা অকৃতকার্য লােক বেঁচে যেত তাহলে
আর উড়বে না ঘুড়ি?
ও বাবা আর উড়বে না? তাপস প্রবল ভাবে মাথা নাড়ে, না।
কেন?
কোনও দিন ওড়াইনি তাে। অভ্যেস নেই যে— ওই তাে উড়েছিল। ভুল করেছিল, ভুল করে উড়েছিল, তাই.. বুম্বার কান্না ভেজা চোখের দিকে তাকিয়ে তাপসের যেন গলা আটকে আসে।
ইচ্ছে করে সুতােটা ছিড়ে দৌড়ে নেমে যায় নীচে। অবশ্য শেষ পর্যন্ত তাই করতেই হবে। কতক্ষণ এভাবে দাড়িয়ে থাকা যায় সুতাে হাতে করে। যাবার আগে শেষবারের মতাে অকৃতজ্ঞ ঘুড়িটাকে দেখতে গিয়ে চমকে ওঠে তাপস।
ও কি! এ কি দেখছে ও। চিলেকোঠার সরু লােহার সিঁড়িটা বেয়ে লাল শাড়ি অপর্ণা তরতর করে উঠে যাচ্ছে উপরে। শ্যাওলা ধরা লােহা। যে কোনও মুহূর্তে পিছলে পড়ে যেতে পারে ও। তাপস চিৎকার করে বারণ করতে আপ্রাণ চেষ্টা করেও পারে না। বরাবর সে লাজুক। নীচের বারান্দায় গ্রিল ধরে তখনও যে অপর্ণার স্বামী দাঁড়িয়ে।
অপর্ণা উঠে গেছে। চিলেকোঠার মাথায় দাঁড়িয়ে দেখছে তাপসকে। তাপসের সমস্ত শরীর ঝিমঝিম করে ওঠে। চার পাঁচ ফুটের ছােট বর্গক্ষেত্রটি শ্যাওলায় একেবারে সবুজ শাড়ি পরে ওখানে কেউ ওঠে ! একটু এদিক ওদিক হলেই...
অপর্ণা কার্নিসের কোণ থেকে উবু হয়ে ঘুড়িটাকে ছাড়িয়ে নিয়ে যেতে তাপস ভয়ে চোখ বুজে ফেলে। আবার চিৎকার করে বলতে যায়, নেমে এসাে অপর্ণা।
হাতের সুতােয় টান পড়তে তাপস চোখ খােলে। ঘুড়ি অপর্ণার হাতে। দুই প্রান্ত ধরে ধীরে ধীরে মাথার উপর তুলে ধরেছে অপর্ণা। মন্ত্রমুগ্ধের মতাে তাকিয়ে থাকে তাপস। অপর্ণা ইচ্ছে করে সময় নেয়। যেন প্রস্তুত হবার জন্য তাপসকে অদৃশ্য ইশারায় বার্তা পাঠায়। তাপব হঠাৎ একটা ঝাকুনি দিয়ে উড়িয়ে দেয় ঘুড়িটা।
তাপস প্রাণপণে সুতাে টানছে। হু হু করে উপরে উঠে যাচ্ছে ঘুড়ি। উঁচু আকাশে। যথেষ্ট হাওয়ার রাজ্যে পৌঁছে একেবারে সুস্থির হয়। বাধ্য ছেলের মতাে দুলে দুলে উড়ছে ঘুড়ি। কখনও ডায়ে কখনও বাঁয়ে।
বুম্বা চিৎকার করছে, উড়ে গেছে। উড়ে গেছে। নীচে গ্রিল ধরে হাঁ করে ঘুড়িটাকে দেখছে অপর্ণার স্বামী।
তাপস একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে চিলেকোঠার ছাদে। সেখানে অপর্ণা দূরের আকাশের ঘুড়িটাকে দেখছে। লাল শাড়ির আঁচল উড়ে যাচ্ছে শরীর ছাড়িয়ে--
তাপস আশ্চর্য হয়ে দেখতে থাকে অপর্ণাকে।
কিছুই হারিয়ে যায়নি তাপসের। সব কিছুই সেই আকাশের মতাে। সেই বর্ষাব থরােথরাে মেঘ। সেই পাগল করা বৃষ্টি, সেই চিলেকোঠা আর তার অপর্ণা--
ঘুড়িটা পাগলের মতাে সুতাে টানছে তখন।
"তুমি ঘুড়ি ওড়াতে পারাে না?”
`না।'
‘এই যে বললে ঘুড়িটা উই উঁচুতে তুলে দেবে? দিচ্ছ না কেন? ও বাবা, ও বাবা - `
বিরক্ত তাপস এই সকালবেলা জীবনের হাজারাে অকৃতকার্যতার সঙ্গে আর একটার সংযােজন করে আরও বিরক্ত হল। একটা ঘুড়ি, উড়ল না।
ছেলেবেলায় দাদা ঘুড়ি ওড়াত। তাপস শুধুই লাটাই ধরে দাঁড়িয়ে থাকত। প্যাচ খেলার সময় ও শুধু বলত ভাে কাট্টা, ব্যস ওই পর্যন্তই। ঘুড়ি ওড়ানাে শেখা হয়নি। অবশ্য অনেক কিছুই শেখা হয়নি তাপসের। সর্বাণী খোঁচা দেয় দু বেলা--ফিউজ লাগাতে পারাে না, ছেলের খাতায় একটা ছবি আঁকতে পারে না। সাইকেল চালাওনি কোনও দিন। সাঁতার। ছি ছি বােলাে না কাউকে--
আর একবার চেষ্টা করার জন্য লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায় তাপস। ঘুড়িটাকে কল খাটিয়ে গেড়াে দিতে দিতে ও আবিষ্কার করল যে এই টেকনলজিটা বেশ কঠিন; এবং এটাও জানার জিনিস এবং এটাও সে জানে না। বুম্বা আবার লাটাই ধরেছে। ঘড়িটাকে ছাদ থেকে খানিকটা নীচে ঝুলিয়ে হেঁচকা টান মারে তাপস। ফরফর ফরত ফর। শব্দের পর শব্দ উঠল, বুম্বা সমানে চিৎকার করছে, উড়ে যাচ্ছে। বাবা, উড়ছে উড়ছে।
ঠক ।
একেবারে গােত্তা খেয়ে ছাদের মেঝেতে মুখ থুবড়ে পড়ল ঘুড়ি। পিতা-পুত্র নির্বাক হয়ে সেই পতনের দিকে তাকিয়ে রইল। পতনের পরেই বিলাপ। একেবারে মহাকাব্যের নিয়ম মেনে বুম্বা ভ্যা করে কেঁদে ফেলেছে।
তাপস চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। এখন পর্যন্ত জীবনের সমস্ত অকৃতকার্যতা যেন ম্লান হয়ে উঠেছে এই অপদার্থতার কাছে। ছােট্ট শিশুটাও তাকে বুঝে ফেলেছে।
ছাই-মাখা আকাশে জমাট বাঁধা মেঘ তখন একটু একটু করে ইলশেগুঁড়ি ছড়াতে শুরু করেছে। কয়েকটা বড় জলের ফোটা গায়ে পড়তে তাপস এই মহান সংগ্রামের আসন্ন সমাপ্তি অনুমান করে স্বস্তি পায়। লাটাইসুতাে ঘুড়ি আর বুম্বাকে বগলদাবা করে নীচে নামবার জন্য পা বাড়াতে বুম্বা আবার কান্না শুরু করল প্রবল বেগে। বৃষ্টির বেগ আর কান্নার বেগের অনুপাত হিসেব করতে গিয়ে তাপসকে আবার থমকে দাঁড়াতে হল। আর একবার শেষ চেষ্টা। ঘুড়ি নামিয়ে দিতে হল নীচে। প্রাণপণে হেঁচকা টান। ছাদের দেয়ালে মাথা ঠুকে কাগজ ছিড়ল ঘুড়ি উড়ল না।
এবার আর সময় নেই। বৃষ্টির ফোটাগুলাে বেশ বড় আকারে নেমে আসছে। তাপস আবার সব সাজিয়ে গুছিয়ে নীচে নামবার তােড়জোড় করতে গিয়ে চমকে উঠল। সামনে ফাকা, মাঠটার ওপারে হলুদবাড়ির দোতলায় অপর্ণা। বারান্দার গ্রিলটাকে আঁকড়ে ধরে হাে হাে করে হাসছে। হাত নেড়ে ইশারায় বলছে নেমে যাও, নেমে যাও, ঘুড়ি ওড়ানাে তােমার কম্ম নয়।
তাপস বৃষ্টির মাঝে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকে হলুদ বাড়ির গ্রিলের দিকে। অবিন্যস্ত মানিপ্ল্যান্টের ঝাঝরির মধ্যে অস্পষ্ট মুখ। অপর্ণা। মুখখানি বৃষ্টির জলে ঝাপসা হয়ে আসার আগেই সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামতে শুরু করে তাপস।
ও বাবা, আর উড়বে না ঘুড়ি? কেন? বৃষ্টি পড়ছে কেন? বৃষ্টিতে ঘুড়ি ওড়ে না?
কেন?
জানি না। তাপসের ধমকটা নিষ্ঠুরের মতাে শােনালেও কিছু করার নেই ওর । সিড়িগুলাে পেরােতে ঘুড়ি লাটাই বুম্বা ইত্যাদিরা সব মুছে মুছে যাচ্ছে। নিজেদের পায়ের শব্দ, প্রত্যেকটা দরজায় টিভি, টেপরেকর্ডার আর কাজের লোকদের হৈ হৈ রৈ রৈ মুহুর্তে-মুছে গিয়ে কানে একটানা বাজতে শুরু করেছে শুধু ঝেপে আসা বৃষ্টির এপিটাফ।
চোখের সামনে হলুদবাড়ি। গ্রিলটা আকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে থাকা মুখ। অপর্ণা। কতদিন পরে দেখল অপর্ণাকে? কবে এল? কখন এসে দাঁড়াল বাবান্দায়? সেই বারান্দা-চৌকো মােজাইক মানিপ্ল্যান্টের অগােছালাে বিন্যাস। গ্রিলে ষড়ভুজের ঘােট ঘােট ডিজাইন মাঝে মাঝেই অপর্ণার হাত, ঢুকে যেত ফোকর গুলােতে। একবার করাত দিয়ে গ্রিল কেটে হাত বার করতে হয়েছিল। জায়গাটা বােধহয় এখনও ফাঁকা রয়েছে।
অপর্ণা মানে জানাে?
হ্যা।
কী। বলব কেন? জানাে না বলবে কী-- অপর্ণা মুখ ভেংচে গম্ভীর গলায় বলল, অপর্ণা সেন, সিনেমা করে..
তাপস হাসতে হাসতে বসে পড়েছিল গ্রিলের কাছে ওই সােফাটায়। কিছুক্ষণ আগে বাংলা অভিধান ঘেঁটে জেনে নেওয়া শব্দটা হুবহু মুখস্থ করে নিয়েছিল সে। অপর্ণা অর্থাৎ যিনি তপস্যা কালেও পর্ণ অর্থাৎ পাতা পর্যন্ত আহার করেন নাই-সং: স্ত্রী,
আমাকে সং বললে তুমি। সং বললাম কোথায়! এই তাে বললে- তাপস শব্দ করে হেসে উঠে বােঝাবার চেষ্টা করল যে সং, মানে সংস্কৃত। অপর্ণা কথাটা সংস্কৃত শব্দ।
অপর্ণা ততক্ষণে ঝাপিয়ে পড়েছে তাপসের গায়ে। চুলের মুঠি ধরে হেঁচকা টান ‘আমাকে তুমি স্ত্রী বলেছ---
স্ত্রী!
তাপস আরও জোরে হাসতে হাসতে চুল ছাড়াবার চেষ্টা করে “আরে শব্দটা স্ত্রী লিঙ্গ...'
তাপসের চুল ছেড়ে অপর্ণা কোমরে দু হাত রেখে চোখ বড় করে জোর ধমক দেয়, ‘তুমি ফের মাস্টারি করছ আমার উপর। দেখবে, দেখবে, কে কী খায়..
আর ঠিক তখনই অপর্ণা চিৎকার করে উঠেছিল, ‘এ মা আমার হাত আটকে গেছে। কী হবে? তাপস আশ্চর্য হয়ে দেখল গ্রিলের ফোকরে আপর্ণার হাত আটকে গেছে।
বেশ জোরে বৃষ্টি নেমেছে। পিতা পুত্রের অকৃতকার্যতা বেশ খানিক্ষণ তারিয়ে তারিয়ে উপভােগ করার পর সর্বাণীর হাসি থামল। ঘুড়ি ওড়াতে জানাে না। পাঁচতলার ছাদে এত হাওয়া -উড়ল না !'
বিছানায় বসে চায়ে চুমুক দিতে দিতে তাপস মাথা নাড়ে---না গাে, ওটা যে এত কঠিন সাবজেক্ট এতদিন বুঝতেই পারিনি। ভাবলাম অত হাওয়ায় দু-চারটে টান মারলেই উঠে যাবে উপরে। বৃষ্টি কমলে আবার চেষ্টা কবা যাবে...
‘অনেক হয়েছে। ঘুড়ি লাটাই আলমারীর মাথায় সাজিয়ে রাখতে রাখতে সর্বাণী আবার হাসে।
বৃষ্টি কখন কমবে বাবা? তা তাে জানি না--- কেন জানাে না?
তাপস হাসতে গিয়েই থেমে যায়। ছােট্ট ছেলেটার প্রশ্ন করার ভঙ্গিটা হুবহু একরকম। আবার মনে পড়ে তাকে। বৃষ্টির এই আধখেচড়া ছাটে চায়ের মধ্যে দু এক ফোটা জল পড়তে জানলাটা বন্ধ করতে এগিয়ে যায় তাপস। ঘাটের জল তার মুখ চোখ ভিজিয়ে দেয়। বৃষ্টি বৃষ্টি...
"তুমি বৃষ্টিতে ভেজো?"
কেন? আশ্চর্য তো! বৃষ্টিতে কেউ ভেজে ? ঠাণ্ডা লাগে যে !
অপর্ণা ঠোট উল্টে ওদের ছাদের কিনারে দাঁড়িয়ে নীচের মানুষ দেখত। কাগজের পুটলি বানিয়ে ছুড়ে দিত নীচের হেঁটে যাওয়া লােকেদের মাথায়। বিশেষ করে টাক মাথা দেখলেই এমনটা করত--‘আমি টাক সহ্য করতে পারি না। তােমার টাক হলে আমি লাঠি দিয়ে মাথা ফাটিয়ে দেবাে--
রক্ত বেরােবে যে। বেরোক । রক্ত বেরলে কি হয়?
তাপস চা শেষ করে জানলার বাইরে ইচ্ছে করেই মুখ বাড়িয়ে রাখল। মুখে চোখে বৃষ্টির রোঁয়াগুলাে যথেচ্ছ ভাবে খেলে যাচ্ছে-বারান্দার ফাইবার গ্লাসের করােগেটেড শেডটার উপর জল পড়ে টিপ টপ টিপ টপ শব্দগুলাে এক তালে যেন বলে চলেছে অপর্ণা-অপর্ণা...
তাপস বিছানা ছেড়ে বাইরের বারান্দায় এসে দাঁড়াল। বর্ষার এই এলােমেলাে জল, কালাে চুলের মতাে মেঘ আর ঝমঝম শব্দ এই চল্লিশ ছুঁই ছুঁই মনটার ভেতর থেকে তেড়ে ফুড়ে বাইশ বছরের তাপসকে কে যেন কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখে বারান্দায়। ঝাপসা জলের পরদার মধ্য দিয়ে, তাপস দেখতে থাকে হলুদবাড়ির চিলেকোঠা।
চিলেকোঠায় লুকিয়ে থাকি চল! কেন? কেউ দেখতে পাবে না আমাদের... কেন?
আরে দূর বােকা, তুমি বড় বােকা, একেবারে হাঁদা-গঙ্গারাম।
ও মা তােমার গোঁফ উঠেছে! এ মা !
কুড়ি বছরের তাপস ষােলাে বছরের অপর্ণার হাত ধরে উঠে গিয়েছিল ওই চিলেকোঠাব ঘরে; একদিন বর্ষার এমনই দিনে। তারপর বৃষ্টি বৃষ্টি। ঘন কালাে আকাশে থরাে থরাে মেঘ। বিদ্যুতের চমকের সাথে কেঁপে কেঁপে ওঠা... চলাে বৃষ্টিতে ভিজি... কেন?
অপর্ণা রাগ করে একাই দাঁড়িয়েছিল ছাদের মেঝেতে বৃষ্টির জলে। ধীরে ধীরে যােলাে বছরের শরীর ফুটে উঠেছিল আবরণ ছাড়িয়ে। তাপস চিলেকোঠার দরজায় গড়িয়ে অবাক হয়ে দেখেছে। বিদ্যুতের চমক হার মেনেছিল এই চমকের কাছে।
ঠাণ্ডা লাগবে। লাগুক। ঠাণ্ডা লাগলে কী হয়? জ্বর হয়। জ্বর হলে কী হয়?
অপর্ণা, অপর্ণা। করােগেটেড শিটের উপর বৃষ্টির জল তখনও একনাগাড়ে শব্দ কবে চলেছে। শুনতে শুনতে একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়ে তাপস। মনের মধ্যে আনন্দ, বেদনা, ছেড়া ছেড়া ভাল লাগা। তারপর হেরে যাওয়া।
আমি পাস করেছি। এই যে আমি পাস করেছি ফাস্ট ডিভিশন।
তাপসের বুকের মধ্যে কেউ যেন লাফ মারল দুটো। ফার্স্ট ডিভিশন। তাপস আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিল। নিজে ও বরাবর সেকেন্ড ডিভিশন। অপর্ণা যেন সেই প্রথম একাই বড় মাপের লাফ দিল। একলাফে ছিটকে গেল অনেকটা।
বাবা, ও বাবা বৃষ্টি থামবে না?
তাপস আকাশের দিকে তাকিয়েছিল, মুখ ফিরিয়ে বুম্বার দিকে তাকিয়ে লজ্জা পায়। ছােট ছেলেটা উৎকণ্ঠা নিয়ে আকাশ দেখছে। কখন বৃষ্টি সরে যাবে-তার ঘুড়ি উড়বে। দুদিন ধরে সমানে বায়না করছে, ঘুড়ি, ঘুড়ি..
তাপস মাথা নাড়ে-থামবে, নিশ্চয়ই থামবে।
কখন? এই তাে একটু পরে। তখন আবার আমরা ছাদে যাব? তখন আবার ঘুড়ি উড়বে?
বুম্বার মুখের উজ্জ্বল হয়ে ওঠাটা পুরােপুরি দেখতে পায় না তাপস। তার আগেই তার দৃষ্টি চলে যায় আবার হলুদ বাড়ির চিলেকোঠার ছাদের অংশটায়। জোট বাঁধা কালাে মেঘ সেখানে থিথিক করছে। এই বৃষ্টি না থামাই ভাল। বৃষ্টি থামলেই তাকে আবার উঠে যেতে হবে ছাদে। আবার ঘুড়ি ওড়াতে গিয়ে না পারা। আবার অপর্ণার হাসি- পাশে বসে আছে তার স্বামী। ইঞ্জিনিয়ার। টিকলাে নাম। ছ'ফুট লম্বা। ঝকঝকে। সপ্রতিভ। প্রবাসী ভারতীয়। ওদের বিয়ের কয়েকদিন পরেই পরিচয় হয়েছিল তার সাথে তাপসের।
এই যে তাপসবাবু। আমি মশাই আপনাকেই খুঁজছি-- তাপস খানিকটা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে ভদ্রলােক হাে হাে করে হাসেন। অপ্রস্তুত তাপস একেবারে সংকুচিত হয়ে গিয়েছিল।
আপনি হলেন আমার মিসেসের একমাত্র বয়ফ্রেন্ড অ্যান্ড অ্যাজ সি ক্লেমস ইউ আর হার অপু ইন পথের পাঁচালি, অপু ইন অপরাজিত অ্যান্ড অপু ইন...
তাপস লজ্জায় একেবারে মাটিতে মিশে গিয়েছিল। লজ্জা পেয়ে ওর কান লাল হয়—
আপনি লজ্জা পাচ্ছেন কেন মশাই? এদেশের লােকেরা ফ্রেন্ডশিপ বােঝে না। একজন নারীও যে একটা পুরুষের যথার্থ বন্ধু হতে পারে, এটা কিন্তু আমি বিশ্বাস করি। আসুন আপনাদের এই পবিত্র বন্ধুত্বের দীর্ঘ স্বাস্থ্য কামনা করে যদিও এনিয়ে আমাদের মদ্যপান করা উচিত; তা এই নতুন শ্বশুরবাড়িতে সেটা তাে সম্ভব নয়-তাই আপাতত সিগারেট পান করি, আসুন।
ভদ্রলােক সিগারেট বাড়িয়ে ধরতে আরও সংকুচিত হয়ে ওঠে তাপস। তার তখন টিউশনির মাইনেতে বিড়ি খাওয়া শুরু হয়েছে, তাও লুকিয়ে।
ইতিমধ্যে অপর্ণা ঘরে ঢুকে পড়তে ভদ্রলােক উঠে দাঁড়ান এবং একমিনিট’ বলে বাইরে চলে যান।
অপর্ণা। লাল সিল্কের শাড়ি। লাল রাউজ। টকটকে ফরসা নাকে নতুন সিঁদুরের গুড়াে লুটোপুটি খাচ্ছে। হাসি খুশি। দারুণ মানিয়েছিল দুজনকে।
তাপস মাথা নামাতে নামাতে নিজের হেরে যাওয়া মেনে নিয়েছিল। সােফায় বসে রয়েছে অপর্ণা। তাপসের মনে হয়েছিল যেন কত দূরে বসে মুচকি মুচকি হাসছে। অথচ কয়েকদিন আগেও এই অপর্ণা ছিল কত সুলভ। সহজ। একদিন বর্ষার এমনি দিনে সারা কলকাতা ভাসিয়ে এসেছিল সেদিনের বৃষ্টি।
তাপস বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছিল। এমনি দিনে তার...... .......
কলেজের বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়েছিল অপর্ণা। তুমি এখানে? এই বৃষ্টিতে বেবিয়েছ কেন?'
তাপস উত্তর দেয়নি। অপর্ণা বইপত্রগুলাে তাড়াতাড়ি তাপসকে গছিয়ে রাস্তায় নেমে পড়তে তাপস বাঁধা দিয়েছিল, ‘একি। জল মাড়িয়ে রাস্তায় নাম কেন? দাঁড়াও, বাস আসুক'-
অপর্ণা ভ্রুক্ষেপ না করে নেমে গিয়েছিল প্রায় হাঁটু জলে। কাপড়টা অনেকটা তুলে হাঁটছিল ও। বাস-ট্রামের ঢেউয়ে দুলে দুলে উঠেছিল শরীর। অগত্যা তাপসকেও নামতে হয়েছিল। তারপর হাঁটতে হাঁটতে...
কোথায় যাবে? কোথাও না। তােমার সঙ্গে শুধু হাঁটব। যত দূর চোখ যাবে হাঁটব। না করবে না।
ঝপ ঝপ শব্দে জল কাটতে কাটতে আর ঢেউয়ে দুলতে দুলতে অপর্ণা নিজে অজান্তেই তাপসের হাত ধরে হাঁটছিল। একসময় জলপথ শেষ হয়ে ডাঙায আশ্রয় নিয়েছিল দুটি প্রাণী। পরদা দেওয়া রেস্টুরেন্টে গরম চায়ে মুখ পুড়ে যেতে চোখে জল এসেছিল অপর্ণার।
তাপসেব মনে হয়েছিল এই হল ঠিক মুহূর্ত। ঠিক এই সময় বলা উচিত। অপর্ণা তারপর চা খেল। চপ খেল। আঁচলে জল নিংড়ে নিতে নিতে ভেজা কাপড় ফ্যানের হাওয়ায় মেলে ধরল নির্দ্বিধায়। তাপস শুধু বসে বসে দেখল, বলা হল না কিছু। চোখের সামনে তখন ঘুরপাক খাচ্ছে নিজেদের টালির বাড়ি।
সকাল সন্ধে টিউশনি, আর প্রায় কাছ ঘেঁষে বড় হতে থাকা দুটি বােন। অপর্ণাদেব দোতলা বাড়ি, সাদা গাড়ি। মাঝখানে ব্যবধান। সমুদ্রের মতাে। সেই সমুদ্রের ঢেউ একটু একটু করে সাবাদিনের জমানাে প্রেম আব নিকষিত সাহসকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে একেবাবে স্থবির করে দিয়েছিল তাপসকে।
কী দেখছ? তাপস চোখ নামায়।
চা পাচ্ছ না? ঠাণ্ডা চা খাবে নাকি?
তাপস চুপ করে বেস্টুরেন্টের জানলাটাব বাইরে তাকাতে ধমক দেয় অপর্ণা। শােন, আমার বিয়ে। ছেলে বিদেশে থাকে। তােমার কিছু বলার আছে?
তাপস যেন হাতুড়ির আঘাত খেল মাথায়। মুহুর্তে ছােট চিলেকোঠায় আটকে থাকা শৈশব, স্কুল কলেজ ফালা ফালা করা যৌবনের উচ্ছ্বাস ভাসতে শুরু করল চোখে। বাইবে কেঁপে বৃষ্টি আসছে আবার তখন। আবাৰ জানলাটাব দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হেরে গিয়েছিল তাপস। মাথাটা ক্রমশ নীচের দিকে নেমে গিয়ে দুলেছে দু চাববার।
তারপর...তারপর কাকতালীয় ভাবে টালির বাড়িতে এই মালটিস্টোরিড বাড়ি। তাতে জমির মালিক হিসেবে দুটি কামবার একটি ফ্ল্যাট। সরকাবি কেরানি হবার জন্য মরণপণ।
বােনেদের বিয়ে...টিউশন জীবনের সমাপ্তি। একদিন অফিসফেরত লাল দিঘির ধারে বসে প্রথম মাইনের টাকা হাতে নিয়ে জলের ধারে চুপ করে বসে থেকে প্রশ্ন করেছিল তাপস, কাকে দেব? জলের মধ্যে টুপ টাপ শব্দ হয়ে উত্তর এসেছিল অপর্ণা, অপর্ণা—অনেক অনেক সাহস করে বলে ফেলতে চেয়েছিল সে, অপর্ণা আমি... অথচ তখন সে কত দূরে। তারপর?
তারপর আবার কি! জীবনের প্রয়ােজনে সর্বাণী। তারপর বুম্বা সংসার। একটু একটু করে ভুলে থাকা আপ্রাণ চেষ্টা, খানিকটা কৃতকার্যতা--
কমে গেছে। কমে গেছে, বাবা বৃষ্টি কমে গেছে! তাপস চমকে পিছনে তাকায়। বুম্বা চিৎকার করছে কমে গেছে, কমে গেছে, কমে গেছে--
তাপস আশ্চর্য হয়ে আকাশের দিকে মুখ ফিবিয়ে দেখে বৃষ্টি থেমেছে। কালাে আকাশের ফাঁক দিয়ে বােদ উঠে কবােগেটেড সিটগুলােকে আরও ঝকঝকে করে লছে। এতক্ষণ ওরা একনাগাড়ে বলে যাচ্ছিল অপর্ণা, অপর্ণা।
বুম্বা দৌড়ে ঘরে ঢুকে মায়েব কাছ থেকে ঘুড়ী লাটাই নিয়ে তাপসের জামা ধরে টানতে শুরু করেছে। তাপস হলুদ বাড়ির চিলেকোঠার উপবে জমে থাকা মেঘের টুকরােটা দেখছিল। ওখান থেকে এখুনি আবার বৃষ্টি নেমে আসুক। ভাসিয়ে দিক চরাচর ।হলে তাকে আবার ছাদে যেতে হয় না। নতুন করে অকৃতকার্য হতে হয় না।
আবার অপর্ণা হাসবে যে..
ছাদে জলে জলাকার। তাপস জলের সঙ্গে জ্বরের সম্পর্কটা ভাল করে বুম্বাকে বােঝাবার চেষ্টা করে হার মানল। ঘুড়ির যে অংশটা ছিড়ে গেছে সেখান থেকে হাওয়া পাস করে ঘুড়িকে উড়তে দেবে না, এমন একটা ভাল অজুহাত দেখিয়েও হেরে গেল।
বুম্বার হাতে আর একটি নতুন ঘুড়ি। ঘুড়িতে সুতাে বেঁধে অগত্যা আবার তাকে দাঁড়াতে হল ছাদেব কোণটায়। এবং সেই অপর্ণা। লাল শাড়ি। পাশে বসে তার স্বামী। তাপস মাথা নিচু করে নতুন ঘুড়িটাকে অনেকটা নামিয়ে দিল নীচের দিকে। হাতের খােচায় ও ওড়াবার জন্য টান মারতে ঘুড়িটা গােয়ার্তুমির চুড়ান্ত করে নাজেহাল করতে শুরু করল তাপসকে। বুম্বা আবার লাটাই ধরেছে। উৎসাহে ছটফট করছে ও। বাবার এই না পারার লজ্জাকে বুঝতে পারছে না সে।
উল্টোদিকের হলুদবাড়ির দর্শকরা যেন নড়ে চড়ে বসল। তাপসের যাবতীয় পরীক্ষা নেবার জন্য তৈরি তারা। লাজুক তাপস তাকাতে পারছে না ও দিকে।
সুতােয় খোঁচা মারতে মারতে তাপস আবিষ্কার কবল যে সমস্ত প্রকৃতি তার সঙ্গে বিরুদ্ধাচরণ করছে। মেঘ বৃষ্টি হাওযা --উত্তরদিকে ঐ হলুদ বাড়িটার সামনেই ওকে দাঁড়াতে বাধ্য করছে।
হাওয়া একটু ঘুরে গেলে ছাদের অন্য প্রান্তে দাঁড়ানাে যেত। এ ভাবে ওদের সামনে আসতে হত না।
ফর ফর শব্দে একটু খানি ঘুড়িটা উড়তে বুম্বা চিৎকার করে ওঠে, “বাবা, উড়ছে, উড়ছে। মুহুর্তের জন্য অন্যমন হয়ে যাওয়া তাপস অবাক হয়ে দেখল সত্যিই উল্টোদিক থেকে দমকা একটা হাওয়া ফর ফর করে উড়িয়ে উঁচতে নিয়ে যাচ্ছে ঘুড়িটাকে।
তাপস আশ্চর্য হয়ে দেখতে থাকে। বরাবরের মাথা নিচু করা ব্যক্তিত্বটা যেন একলাফে ঘুড়িটার সঙ্গে উঠে যেতে থাকে উপরের আকাশে।
বুম্বা খিল খিল করে হাসছে। ওদিকে হলুদবাড়ির গ্রিল থেকে ওরা স্বামী-স্ত্রী হাততালি দিচ্ছে জোরে ।
ঘুড়িটা বেশ উপরে উঠেছে।
তাপসের হাত থেকে সুতাে বেরিয়ে যাচ্ছে দ্রুত। সােজাসুজি বেশ খানিকটা উঠে এবার ডানদিকে হেলে যাচ্ছে। নিজে নিজেই। তাপস জানে না, কী করা উচিত। সুতােয় জোরে টান মারে সে। ঘুড়ি আবার সােজা হল, আবার হেলে যাচ্ছে বাঁ দিকে।
তাপস প্রাণপণে টান মারে সুতােয়।
ঘুড়ি বাঁ দিকে নামছে। নামছে। বুম্বা চিৎকার করছে। বাবা নেমে যাচ্ছে। নেমে যাচ্ছে। তুলে দাও, তুলে দাও বাবা! তাপস পাগলের মতাে সুতাে টানে।
অপদার্থ ঘুড়িটা এই যাবতীয় চেষ্টায় কোন ভ্রুক্ষেপ না করে ঝপ করে নেমে গেল। আর যাবি তাে যা একেবারে হলুদবাড়ির চিলেকোঠায়। কার্নিসে আটকে থেকে যেন মজা করতে থাকে ঘুড়ি।
তাপস হতাশ হয়ে তাকিয়ে থাকে ঘুড়িটার দিকে। একটা সরলরেখা তৈরি করে সুতাে স্থির হয়। বুম্বা ততক্ষণে আবার ভ্যা শব্দে কান্না জুড়েছে।
তাপস আবার তাকায় হলুদবাড়ির দোতলায়। ওরা হাে হাে করে হাসছে। অপর্ণা দু হাতে মুখ চেপে বসে পড়েছে। চোখ নামিয়ে তাপস দাঁড়িয়ে থাকে।
হাসাে। হেসে যাও অপর্ণা। ঠাট্টা করে যাও-- সাদাকালাে আকাশের দিকে মুখ তুলে তাপস ওই একই কথার পুনরাবৃত্তি করে। সেখানে তখন মেঘেরা হাওয়ায় হাওয়ায় উড়ে চলেছে। আলাে ঠিকরে বেরিয়ে আসছে, বাঃ বাঃ এই তাে চাই। যখন আলাে চেয়েছি তখন অন্ধকার এনে দিয়েছ, যখন মেঘ চাইলাম তখন... তােমার আর কি?
আজ ঠিক এই দিনটিতে বৃষ্টি দিয়ে চরাচরকে একেবারে ভাসিয়ে দিতে পারলে না? একটি চল্লিশ ছুঁতে আসা অকৃতকার্য লােক বেঁচে যেত তাহলে
আর উড়বে না ঘুড়ি?
ও বাবা আর উড়বে না? তাপস প্রবল ভাবে মাথা নাড়ে, না।
কেন?
কোনও দিন ওড়াইনি তাে। অভ্যেস নেই যে— ওই তাে উড়েছিল। ভুল করেছিল, ভুল করে উড়েছিল, তাই.. বুম্বার কান্না ভেজা চোখের দিকে তাকিয়ে তাপসের যেন গলা আটকে আসে।
ইচ্ছে করে সুতােটা ছিড়ে দৌড়ে নেমে যায় নীচে। অবশ্য শেষ পর্যন্ত তাই করতেই হবে। কতক্ষণ এভাবে দাড়িয়ে থাকা যায় সুতাে হাতে করে। যাবার আগে শেষবারের মতাে অকৃতজ্ঞ ঘুড়িটাকে দেখতে গিয়ে চমকে ওঠে তাপস।
ও কি! এ কি দেখছে ও। চিলেকোঠার সরু লােহার সিঁড়িটা বেয়ে লাল শাড়ি অপর্ণা তরতর করে উঠে যাচ্ছে উপরে। শ্যাওলা ধরা লােহা। যে কোনও মুহূর্তে পিছলে পড়ে যেতে পারে ও। তাপস চিৎকার করে বারণ করতে আপ্রাণ চেষ্টা করেও পারে না। বরাবর সে লাজুক। নীচের বারান্দায় গ্রিল ধরে তখনও যে অপর্ণার স্বামী দাঁড়িয়ে।
অপর্ণা উঠে গেছে। চিলেকোঠার মাথায় দাঁড়িয়ে দেখছে তাপসকে। তাপসের সমস্ত শরীর ঝিমঝিম করে ওঠে। চার পাঁচ ফুটের ছােট বর্গক্ষেত্রটি শ্যাওলায় একেবারে সবুজ শাড়ি পরে ওখানে কেউ ওঠে ! একটু এদিক ওদিক হলেই...
অপর্ণা কার্নিসের কোণ থেকে উবু হয়ে ঘুড়িটাকে ছাড়িয়ে নিয়ে যেতে তাপস ভয়ে চোখ বুজে ফেলে। আবার চিৎকার করে বলতে যায়, নেমে এসাে অপর্ণা।
হাতের সুতােয় টান পড়তে তাপস চোখ খােলে। ঘুড়ি অপর্ণার হাতে। দুই প্রান্ত ধরে ধীরে ধীরে মাথার উপর তুলে ধরেছে অপর্ণা। মন্ত্রমুগ্ধের মতাে তাকিয়ে থাকে তাপস। অপর্ণা ইচ্ছে করে সময় নেয়। যেন প্রস্তুত হবার জন্য তাপসকে অদৃশ্য ইশারায় বার্তা পাঠায়। তাপব হঠাৎ একটা ঝাকুনি দিয়ে উড়িয়ে দেয় ঘুড়িটা।
তাপস প্রাণপণে সুতাে টানছে। হু হু করে উপরে উঠে যাচ্ছে ঘুড়ি। উঁচু আকাশে। যথেষ্ট হাওয়ার রাজ্যে পৌঁছে একেবারে সুস্থির হয়। বাধ্য ছেলের মতাে দুলে দুলে উড়ছে ঘুড়ি। কখনও ডায়ে কখনও বাঁয়ে।
বুম্বা চিৎকার করছে, উড়ে গেছে। উড়ে গেছে। নীচে গ্রিল ধরে হাঁ করে ঘুড়িটাকে দেখছে অপর্ণার স্বামী।
তাপস একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে চিলেকোঠার ছাদে। সেখানে অপর্ণা দূরের আকাশের ঘুড়িটাকে দেখছে। লাল শাড়ির আঁচল উড়ে যাচ্ছে শরীর ছাড়িয়ে--
তাপস আশ্চর্য হয়ে দেখতে থাকে অপর্ণাকে।
কিছুই হারিয়ে যায়নি তাপসের। সব কিছুই সেই আকাশের মতাে। সেই বর্ষাব থরােথরাে মেঘ। সেই পাগল করা বৃষ্টি, সেই চিলেকোঠা আর তার অপর্ণা--
ঘুড়িটা পাগলের মতাে সুতাে টানছে তখন।
Post Comment
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন