Top Social

ভালোবাসার গল্পের সোনার দিনগুলো

ভালোবাসার গল্প 8: রক্তকরবী ফুল

শনিবার
মালীবাগের মোড়ে পৌছতেই ওর সঙ্গে দেখা।  দেখেই মনে হল স্কুলের ছাত্রী।  হাল্কা-পাতলা গড়ন, শাদা সালোয়ার-কামিজ গায়ে।  হাতে পাটের থলেভর্তি বইপত্র, বেণীও বেঁধেছে।  বেশ ঘন ও দীর্ঘ চুল।  তার শরীরের তুলনায় চুল বড় ও সুন্দর, ভুরুও কালো এবং ঘন।

আমিও ভালোবাসি কালো কেশবতী মেয়েদের।  জেব্রা ক্রসিং-এ পা দিতে দাঁড়িয়ে আছি, তিনদিক থেকে অনবরত গাড়ি আসছে, বাসস্ট্যাণ্ডে লোকারণ্য।  একটা বাস আসতে না আসতে ঝাঁপিয়ে পড়ছে সবাই।
মেয়েটি রাস্তা পার হওয়ার সময় অমিার পাশে এসে দাঁড়াল।  অড়ি চোখে তাকিয়ে আমি দাঁড়িয়ে আছি, এক লহমায় ওর ব্যক্তিত্বও লক্ষ্য করলাম।  




গাড়ি না থাকলে তবেই রাস্তা অতিক্রম করব--তখন মেয়েটিও রাস্তা পার হবে জানি।  স্কুলগামী মেয়েই বলব, নবম বা দশম শ্রেণীর ছাত্রী হয়তো--কলেজের কথা একবারও মনে আসে নি।  পাশে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটি ।  রাস্তা পার হওয়ার জন্যে পা তুলতেই ওর চোখে-মুখে ব্যক্তিত্ব আবার লক্ষ্য করলাম, আমার উঠতি পা মুহর্তের জন্যে থমকে গেল।  আমার পাশে পাশে পায়ে পায়ে হাঁটছে। 

রাস্তার মাঝামাঝি হলুদ দাগের ওপর আবার দাঁড়াতে হল, মােড়ের দিক থেকে খুব একটা লাল গাড়ি ছুটে আসছে।  সকালের সূর্য তখন অনেক খানি ওপরে উঠে এসেছে, কয়েক টুকরাে কোদালে মেঘ উঠেছে দক্ষিণ আকাশে।  মালীবাগ থেকে কাকরাইল পর্যন্ত প্রশস্ত সোজা রাস্তা।  দক্ষিণ আকাশের ফন্স ক্লসের দিকে মেঘ উঠেছে, তার পাশাপাশি অগস্ত্য তারাটি ওঠে।  সেদিকে তাকিয়ে হাটছি, পায়ে পায়ে ফুটপাতে গিয়ে দাঁড়ালাম।  সিগারেট থেকে আরেকটা সিগারেট ধরালাম। মেয়েটি একটু দূরে দাঁড়াল।  

বাসের পর বাস আসছে, অফিসগামী মানুষের অার শেষ নেই। পাশে দাঁড়ান লোকটার সঙ্গে কথা শুরু করলাম-- রিক্সা ধর্মঘটে সবার অবস্থা কাহিল।
 

তখন মেয়েটি কাছে এসে দাঁড়াল।  ফুটপাতের লোকটি আমার কথা সমর্থন করে পড়িমরি ৬ নম্বর বাসের দিকে দৌড়ে গেল। আমি মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললাম, আজ আর তােমার স্কুলে যাওয়া হল না।
 

সে হাসল।  আমি আবার বললাম, বাড়িতে বসে গল্প বই পড়ে গে, অথবা উপন্যাস।
 

সে হাসলা খুব সরল সহজ।  থলেটি দু হাতে সামনে এনে ধরল।  অামাকে প্রশ্ন করা, অাপনি কোথায় যাবেন ? বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়, আমি চাকরি করি।
 

আবার চুপ করে গেলাম।  একটা খালি রিক্সা দক্ষিণ দিক থেকে দিবিজয়ী বীরের মতো ছুটে এল, কিন্তু কেউ ওর দিকে এগিয়ে গেল না, কেউ কিছু জিজ্ঞেসও করল না।  সবাই জানে আজ ওদের ধর্মঘট, সে হয়তো কোথাও গিয়েছিল খুব ভোরে, অথবা সে-ই হয়তো রিক্সার মালিক, হয়তো এমনিই বেরিয়েছে রিক্সা নিয়ে।  

ঢাকা-ময়মনসিংহের একটা ললি বাস এল, ঝাপিয়ে উঠল অনেকে, বাস কণ্ডাকটরের মানা শুনল না কেউ--ফার্মগেট-মহাখালী-বনানী তো যেতে পারবে।  তারপর যা হোক ব্যবস্থা একা হবে।
 

মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে তেমনি।  অামার থেকে বয়সে ছোট তবুও দ্বিধাদ্বন্দ্বে ডুবে ওর নাম জিজ্ঞেস করা হল না।  আরাে কয়েকজন মহিলা দাড়িয়ে আছে বাসে ওঠার জন্যে ; এক জনের সিঁথিতে সিঁদুর, গোলগাল ফর্সা, নাদুস-নুদুস হাতকাটা ব্লাউজ পড়া এক মহিলা এসে দাঁড়াল ফুটপাতের নিচের রাস্তায়, একটা প্রাইভেট কার এসে দাঁড়াতেই কয়েকজন লোক হুমড়ি খেয়ে পড়ল, ড্রাইভারকে সমীহ করে বলল, কোন দিকে যাবেন ভাই, আমাদের নিয়ে যান। 

তখনি এক জন লোক এসে বলল, মৌচাকের মোড়ে রিক্সাওয়ালাদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়ে গেছে এক দফা।

ভোরে।

আহত হয়েছিল কেউ ?

না, মারাত্মক কিছু ঘটে নি শুনলাম। মেয়েটির কাছে গিয়ে জিঞ্জেস করলাম, কোন ক্লাশে পড়ো তুমি ? লালমাটিয়া কলেজে পড়ি।

আমি অবাক হয়ে বললাম, সত্যি।  আমি যে তোমাকে আবার অমিতা আমতা করে বললাম, কোন ইয়ারে ?

তৃতীয় বর্ষ।

এই দ্যাখো, তোমাকে ছোট মনে করে বসে আছি।  তারপর আমার বয়স ও গাম্ভীর্য সব ঝেড়ে-পুছে বললাম, মনে করো না কিছু, তুমি করে কখন বলছি, স্কুলের ছাত্রী বলে ধরে নিয়েছিলাম ।  আর্টস পড়ো।
না, কমার্স।  কমার্স ।  তুমি তো খুব শক্ত মেয়ে।  তোমার সঙ্গে সমীহ করে কথা বলা উচিত ছিল।  ঠিক তাই - সে হাসতে হাসতে এক চোট নিয়ে নিল।  মানছি, একশো বার।
 

আবার অনেকক্ষণ চুপচাপ, আরেকটা সিগারেট ধরলাম। শেষ হয়ে গেল। অফিসে যাব কিনা ভাবছি।  নয়টা বেজে গেল। বাসে ঝুলে গেলেও মগবাজারে গিয়ে অফিসের গাড়ি ধরতে পারব না।  আটটা পঞ্চাশে গাড়ি দাঁড়ায় সেখানে। এখন হেঁটে অফিসে যাওয়া ছাড়া আর উপায় নেই।  আবার ভাবলাম-না, আজ আর অফিস নয়।

ওকে প্রশ্ন করলাম, কোথায় থাকে, মালীবাগ?

শান্তিবাগ।  তুমি তো আমার প্রতিবেশী।  আমি মালীবাগ থাকি।

অামার শরীরে তখন শিহরণ খেলছে।  ওর চোখের ভাষা আর অনুরাগ আমার অগোচরে নেই।  এক রােমাঞ্চকর অনুভূতিতে ভেতরটা গলে গলে যাচ্ছে।  অনেকদিন পর বুকের ভেতর গনগনে আগুন জ্বলে উঠল।


সে আমাকে রমনা পার্কে নিয়ে গেল, সোরওয়াদি উদ্যানে। একেশিয়া গাছের নিচে দাঁড়িয়ে চিনিয়ে দিল গাছপালা, ফুল ও কয়েকটি পাখি।  একরকম ছোট ছােট ফুলের গাছ দেখাল।  ফুলগুলো ছােট দানার মতো, গোলাপী ফুলগুলো ঘাসের ওপর পড়ে বেগুনি হয়ে আছে। 

এভাবে কোনােদিন ফুল ও গাছপালার দিকে তাকাই নি আমি। চেরী জাতের একরকম ফুল গােলাপী ও বেগুনি হয়ে ফুটে আছে।

নাগকেশর গাছে নিচে দাঁড়িয়ে সে বলল, আপনি তাে দেখি কোনাে ফুলই চেনেন না। আমি বললাম, তােমাকে ঠিক চিনে নিতে পারব, হাজার ভিড়ের মাঝ থেকে বের করে নিতে পারব।

কি করে মনে রাখবেন ? আমার নামই তো জানেন না।

সত্যি! তোমার নাম কি?

না বলব না।  আমি মনে করিয়ে দিলাম তাই জিজ্ঞেস করলে।  নইলে আমার কোনো দরকার পড়ত না।
সে কিছুতেই নাম বল না বরং অামাকে তুমি সম্বোধন শুরু করল। বকফুল, কাঞ্চন, রাধাচূড়া, সপ্তপর্ণী গাছ চিনিয়ে দিল। শেরাটন হোটেলের পেছনের মােড়ের নাগলিঙ্গম গাছটি কাটার কাহিনী বলল। 


বলল, নটরডেম কলেজে আরো দুটি গাছ আছে, বলধা গার্ডেনে আছে অনেক দুষ্প্রাপ্য গাছ।  বাকল ছেড়ে তন্বী হয়ে ওঠা ইউক্যালিপটাস গাছটি দেখিয়ে আমাকে এক দুৰ্জের ইঙ্গিত দিল।  পাশাপাশি হাত ধরল আমার। ওর ছোট পেলব মুঠো খুলতে খুলতে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম—এত নরম হাত, এত সুন্দর অঙুিলে যে দুমড়ে ভেঙে দিতে ইচ্ছে করে। চুমো খেতে মন চায়।
তোমার নাম কি বলো?

আমার দিকে তাকিয়ে কি যেন দেখে নিল। তারপর বলল, আমি বলব না, তুমি কী করবে করো।
তাহলে নাম দেই তােমার। তোমার নাম, নিম।


ইস কী বিচ্ছিরি তেতো।  তারপর চুপ করে থেকে আবার বলল, ও নামে কে চিনবে অামাকে, আমাকে খুঁজে নেবে কি করে?

শান্তিবাগের রাস্তায় বসে থাকব, কলেজে ধর্ণা দেব, সকালে মালীবাগ মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকব।  খুব ছোট বয়সে অমি গ্রামের ছেলেদের নিয়ে দল গড়তাম, আমি হতাম নেতা, কেউ দলের শৃঙ্খলা না মানলে তাকে শাস্তি দিতাম, শাস্তির ভয়ে অনেকেই দল থেকে বেরিয়ে যেত। কিন্তু দলের শৃঙ্খলা রক্ষায় কখনো নরম হই নি।

রাখাে তােমার নেতাগিরি।  কই এখন কি করছ ? দুঃস্থ মানুষের সাহায্যে কি করো, ট্রাকে চাপা পড়ে ছাত্ররা মরল, তুমি কি করেছ তাদের জন্যে?


চুপ করে গেলাম আমি।  ওর প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই। প্রতিদিন কোথাও না কোথাও মিছিল হচ্ছে, মানুষ মরছে।


বসন্তের হাওয়ায় ফুল আছড়ে পড়ছে কপালে, কোকিল ডাকছে দূরে, ওর প্রশ্নগুলোও উদ্দীপনায় ভরা ঝলমলে তরুণের মতো। আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম।  ওকে যে মালীবাগের মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকব বলেছি তা কি সম্ভব? দু’ দিন পর অফিস সকাল সাড়ে সাতটায় হবে, তখন কোথায় থাকবে সে আর কোথায় আমি।

তখনই শাহবাগের দিকে হৈ-হল্পা শোনা গেল।  অামরা কান খাড়া করলাম।  নিম বলল, শুনতে পাচ্ছি, জঙ্গী মিছিলের শব্দ!  মিছিল ও আন্দোলনের নামে আমার বুক কেঁপে উঠল।  পত্রিকার পাতায় প্রতিদিন দেখি মিছিলের খবর, প্রতিদিন গোলাগুলি ও মৃত্যুর, সেই মৃত্যু নিয়ে আবার মিছিল...আবার প্রতিবাদ ও মিছিল...।

দেখতে দেখতে মিছিলের শব্দ উত্তাল হয়ে উঠল।  লোকজন ছােটাছুটি করছে, উদ্যানে ঢুকে পড়েছে মানুষ, রাস্তায় গাড়ি উধ্বশ্বাসে ছুটছে, অল্পক্ষণের মধ্যেই রাস্তা গাড়িশুন্য হয়ে পড়ল।  আমরা উদ্যোনের পশ্চিম দিকে তখন, ওর বইয়ের থলে অামার হাতে, উদ্যানে ঢুকে পড়া মিছিলের মানুষ আরো জঙ্গী হয়ে উঠেছে। 

নাগকেশর ও বকুল গাছের অড়ালে আড়ালে আমরা ছুটছি।  ওকে টেনে নিয়ে ছুটতে ছুটতে উদ্যানের পুকুর পাড়ে পৌছলাম।  একটু নিঃশ্বাস নেওয়ার সময় পেলাম, জঙ্গী জনতাকে অনেক পেছনে ফেলে এসেছি। ওর ঘামে ভেজা চোখ-মুখ তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে, এক মুহর্তে মনে হল পাকিস্তানি সৈন্যদের গুড়িয়ে দেওয়া কালীবাড়িটি ওখানে দাঁড়িয়ে আছে, আর সেই বিশাল কালীমূর্তি আমাকে জিভ বের করে গ্রাস করতে আসছে।  নিম ভয়ে অামার বুকের ভেতর সেঁধিয়ে অাছে।  চিৎকার করে সে বলল, তোমার বুকে মাথা রেখে আমি মরতে পারি, আরো জোরে চেপে ধরে আমাকে, আমাকে বুকের ভেতর পুরে নাও। 

আমার ভীষণ ভয় করছে।  মাথা ঝাড়া দিতেই সব ঠিকঠাক দেখতে পেলাম।  পুকুরের জল অনেক শুকিয়ে গেছে।  রাস্তার এক মেয়ে গোসল শেষ করে ভেজা কাপড়ে উদ্যান পাড়ি দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে, একটা কাক ও শালিক ঠোঁটে তুলে পানি খাচ্ছে।  নিম হাঁফাতে হাফাতে বলল, পালিয়ে যাচ্ছ তুমি ? তুমি না এক সময় পাড়ার ছেলেদের দলপতি ছিলে? কেউ দলের শৃঙ্খলা ভাঙলে তুমি না শাস্তি দিতে ?...

নিম, সে অনেক পুরােনো কাহিনী।  লোকজনের ঢেউ এসে পড়ল আমাদের গায়ে।  সে আমার হাত চেপে ধরে বলল, কোথায় পালাচ্ছি, অফিসে গিয়ে লুকোবে, আমাকে ফেলে পালাতে চাও?


তোমাকে ফেলে পালাব কেন ? চলাে চলো...

সে তখন থরথর কাঁপছে আর বলল, ঐ দ্যাখো ঢুকে পড়েছে।  আর পালাবার সময় নেই, দক্ষিণ দিক থেকেও ছুটে আসছে।  মুহর্তের মধ্যেই প্রলয় ঘটে গেল।  মানুষের চিৎকারে গাছপালা ও উদ্যানের পাখিদের ভাক চাপা পড়ে গেল, লাঠির আঘাতে এক একজন লুটিয়ে পড়ছে মাটিতে, বুম বুম শব্দ হল অদূরে কোথাও, বন্দুক ও লাঠি-পেটীয় রক্তের নহর ছুটল আর দেখতে দেখতে আমার চোখের সামনে অাহত লুণ্ঠিত নিম একটি রক্তকবরী গাছ হয়ে গেল।

নিশ্চিহ্ন সেই কালীবাড়ির ওপর রক্তকরবী গাছটি নিঃসঙ্গ দাঁড়িয়ে আছে এখন।  আমি প্রতিদিন অফিস থেকে ফেরার পথে অথবা অফিসে যাওয়ার সময় গাছটি দেখে যাই।  উদ্যানের তরুণ মালী সালাউদ্দীনকে বলে দিয়েছি, গ্রীষ্মকালে সে যেন গাছের গোড়ায় জল দেয়, যেন কোনাে রকম অযত্ন না হয়।


আমি অপেক্ষা করে আছি, কবে সে-গাছে ফুল ফুটবে।
২টি মন্তব্য on "ভালোবাসার গল্প 8: রক্তকরবী ফুল"