ভাই...
পৃথিবীতে আমার কেউ ছিল না বললে ভুল করা হবে, বলবাে আমি কারুর ছিলাম ।
স্বভাব ছিল আমার চুপ করে থাকা সব সময় ইচ্ছে হতাে নিভৃত কোণে থাকতে তাই মনের মত ছিল, ছাদ, সিড়ির তলের অপরিসর ক্ষুদ্র ঘরটি ; একটু ভীতুও ছিলাম কারুর সঙ্গে মিশতে চাইতাম না। শুধু নিজের কল্পনার মধ্যে—সেখানেই আমার সকল ইন্দ্রিয়ের বাসনা তৃপ্ত হতাে—চোখের সামনে একটা শান্তির ছবি ঘুরে বেড়াত।
একদা এমনি চুপ করে বসে আছি, সিড়ির তলার ঘরে—টীপ টপ করে বৃষ্টি পড়ছে—
এমন সময় দেখি—আসছে একটী মেয়ে। কি তার রূপকালাে চোখদুটী কতাে ভাবে ভরা—গভীর—কৌতুকের—স্বপ্নমাখা। তার গতিভঙ্গিতে যেন সুধা ঝরে পড়ছে ; যেন এ কোন বিখ্যাত বাঙলী শিল্পীর ছবি রসে রেখা রঙে রঙিণ...
ওকে দেখে কেমন একটি বেদনা অনুভব করলাম, সে বেদনা দুঃখে নয়, পরিপূর্ণ আনন্দের, যে আনন্দ ছিল কল্পনায়—গভীর ভাবে ওর দিকে আমার চোখ তাকিয়ে ছিল, মন তখন খুঁজে বেড়াচ্ছিল আমার মধ্যে—একটা কিছু খুঁজে ! হেসে মেয়েটি জানালার কাছে এলাে।
সে কি হাসি যেন আমি কত কালের চেনা, কত কাছের মানুষ—সে হাসির মধ্যে সহানুভূতি ছিল, কৌতুক ছিল, অনিমেষে চেয়েছিলাম তার দিকে, বুক আমার স্পন্দিত হয়ে উঠলাে।
•••মধু নেবে—
আগেই বলেছি আমি ভাল কথা বলতে পারি না, তায় ভীতু, আমার স্বর রােধ হয়ে গেলাে...চেয়ে আছি ওর দিকে ‘মধু যেন হৃদয় হতে উথিত হলাে। তার গা প্রায় অনাবৃত, সেই ফতুয়ার মত জামা, যৌবনের পরিপূর্ণতার সঙ্কেত—তারপর নাভির থেকে নেমেছে ঘাঘরা পা পর্যন্ত, কানে রূপাের কান, নাকে নাক চাবি, চন্দ্রচূড় ধরনের গহনা মাথায়, সব মিলিয়ে ছিল অপরূপবললামনা।
--মধু নােব না বাবু-মিষ্টি ! বলে অঙ্গ তার এমন একটি দোলা দিল, আমার মনে হলাে দেহে ভুলে মধু কিনি— বললে নেবে না বাবু ? না•••
পরমবিস্ময়ে উচ্চারণ করলে, “না” বলে এমন ভঙ্গি করলে যেন সে stage এ অভিনয় করছে, তারপর ধীরে চলে গেল, আমি তখন গভীরতার মধ্যে, সে সময় যখন কেটে গেল তখন শুনতে পেলাম, স্লান ডাক—“মধু মিষ্টি কি সুন্দর, আমার কি ওর ভাল লাগলাে ? ওকে দেখে মনে হল রামির কথা, এ দুই নয়নে নিমেয় দিয়েছ কেবা ।
বাড়ীতে আর কেউ হয়তাে দেখে থাকবে—যে সে এসেছিল আমাদের দোরে—কথা চলছিল তাদের চরিত্র নিয়ে, আমি ভয় পেলাম, ভাল ছেলে বলে নাম আমার তৎক্ষণাৎ বললাম ওরা ভয়ানক পাজি হয় আর চোর—দুটোই বড়দি বলে হ্যাঁ, আমি জানি বলে তার নূতন শ্বশুর বাড়ীর গল্প সুরু করে দিলে ।
নিখুঁত ভাবে বর্ণিত হলাে তাদের চরিত্র, আমার মন তখন খুঁজে বেড়াচ্ছে—সে কোথায় ! লক্ষ পথে তারই সন্ধানে মন আকুল ভাবে খুঁজে বেড়াচ্ছে।
দিন সাতেক পর, যখন আমি তাকে অন্তরের শক্তি দিয়ে ভাবতে চেষ্টা করছিলাম, খুঁজে বেড়ােচ্ছিলাম, হাতে ছাতা, পরণে আমার বষতি, ভিজে সপসপ করছে, দেখি—মধুওয়ালি নিরুদ্বিগ্ন চিত্তে বাড়ীর বারান্দায় বসে ; গালে হাত দিয়ে আনমনে কি ভাবছে। এ যে যক্ষপ্রিয়া !—তার আয়ত চোখ পথের দিকে নিবদ্ধ কার পদচিহ্ন খুঁজছে—ঠোঁটে তার ক্ষীণ সুস্মিতরেখা।
ওকে দেখে আমি অব্যক্ত আনন্দে জেগে উঠলাম—কে বলে উঠেছিল—অবশেষে তােমায় পেয়েছে।
আনন্দের পরিমান ভয়ে মুখ পাংশুবর্ণ হয়ে এলােলজ্জায় দৃষ্টি অন্ধ । আনমনে সুন্দরী আমার দিকে চাইলে---চেয়ে রইলাম আমি অনিমেষে।সেই কৌতুকের হাসিটি—মনের ভিতর থেকে বলে উঠলাে—কেমন আছাে—আমায় ভােলােনি... বললে, বাবু কেমন আছাে.. ভাল—তুমি কেমন আছাে ভাল কথা খুঁজছিলাম কি বলবাে ! এমন সময় বললে, বসাে•••
মনের ভেতর যে কথা ভাবি, কেমন করে তার কাজ হয়ে যায় ভেবেই পাই না। হয়তাে ভেবেছিলাম ওর পাশে স্থানটী কবে পাবাে। যেই বললে, বসাে—প্রায় ওর কাছেই বসে পড়লাম । ও একটু সরে বসল, দেখে লজ্জার সীমা রইল নাদাঁড়াতেও পারি না, চুপ করে থাকার পর বললাম, বিশ্রী বৃষ্টি না ? নিশ্চয়, কিন্তু তােমাদের আর কি ক্ষতি...
ক্ষতি নয় কি রকম ? -সাংঘাতিক! দেখতাে রাস্তা চলবার যাে নেই, অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছি, আর ভাল লাগে না...
এইটুকু ! আর আমার বাড়ী হয়তাে ভেসে গেছে। ভেসে গেছে...! দেশে কি ?
দেশে না, এখানেওই রেল লাইনের ধারে, হয়তাে বিছানাবলে একটু হেসে বললে, বিছানা আর কি এই মাদুর-টাদুর ইত্যাদি সব ভিজে গেছে...
কল্পনায় আমি দেখতে পেলাম, একটী শান্তির নীড় সবুজ মাঠের পরে,—চিরবসন্ত বাসা বেঁধেছে যেথা, শান্ত সুন্দর। আকাশের পানে, কল্পনার দিকে চেয়ে আনমনে বললাম, কতদূর
খুব কাছেই—ভুরু কুঁচকে বললে ।
আমায় নিয়ে যাবে ? এই কাতর প্রার্থনা নিজেকেই লজ্জা দিলাে। ও তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে বললে, নিশ্চয় তারপর কি জানি কি মনে হলাে, বললে, কিন্তু কেন ?
কি বলি—বললাম, কেন আর—এমনই। এমনি ! আমার দেখতে ইচ্ছে হয় দেখতে ইচ্ছে হয় আমার বাড়ী ! বল্লে সরল ভাবে সে হেসে উঠলাে। আমি জেদ ধরে বললাম, চল যাই.. বৃষ্টি পড়ছে যে -
তাহলে তুমি আমার বাতিটা পর তােমার বষাতি—হেসে বললে, পাগল—তাহলে মধুর কলসী— আমি নেবােপাগল—বলে, সকৌতুক হাসলাে.......তারপর দুজনে উঠে চলতে সুরু করলাম। আমি ওর মাথায় ছাতাটা ধরে চলেছি। রাস্তার লােকেরা আমাদের দেখে ঠিক হাসতে পারলে না, একটু অবাক,আশ্চর্য হয়েই রইল ।
একজন ভদ্ৰযুবক এমন ভাবে ছাতা আড়াল করে সামান্য একটি মেয়ের সঙ্গে যাচ্ছে দেখে, রীতিমত তাদের মধ্যে বিস্ময় ও কৌতুকের সঞ্চার করলে, তাদের অস্বস্তিতে আমিও ঈষৎ অস্বস্তি বােধ করছিলাম। কিন্তু আনন্দে—এসব ভূক্ষেপ করলাম না।
তােমার নাম কি ? আমার ? অবাক হয়ে হাসলে--
হাঁ
কলাবতী।
ওর বাড়ী—পৌছলাম। বৃষ্টি তখন থেমে গিয়েছিল, পােলের ঢালু জমির ওপর কয়েকটা হােগলার চালা তিনহাত উঁচু হবে—তার কিছু ওপর দিয়ে রেল লাইন চলে গিয়েছে । কলাবতী বললে, কোনটা আমার বাড়ী বলতাে ?
ওইটা— অবাক হয়ে বললে, তুমি কি করে জানলে ! আমি পারি— কলাবতী বললে দাঁড়াও
•বলে হােগলার চালের ভিতর মাথা গলিয়ে দিয়ে,—মধুর কলসীটা রেখে এলাে। তারপর আর সব মেয়েদের দেশী ভাষায় কি বললে—তারা তখন আমার দিকে অন্য চোখে চাইলাে। আমার কেমন লজ্জা করতে লাগলাে-কলাবতী একটী জীর্ণ মােড়া দিলে, আমি সন্তর্পণে তার উপর উদ্বিগ্ন চিত্তে বসলাম কারণ কে জানে যদি মােড়াটা বিশ্বাসঘাতকতা করে, ভাবলাম একটা সিগারেট ধরাবাে কিনা ? সহসা দেখলাম পাশেই একটী হুঁকো, বললাম, কলাবতী তামাক।
আমাদের কে ? তাতে কি...
আমার জন্যে ভাল করে কোটী ধুয়ে, তামাক সেজে আমায় দিলে,-অনভ্যাস, কাশী চেপে রাখলাম একজন মেয়ে আঙিনাটী পরিষ্কার করলে, যথাসম্ভব করে.
কলাবতী বললে, এই আমার বাড়ী..ঈষৎ লজ্জায় তার হাত দুটো ইতস্তত দুলতে লাগলাে।
বললাম, চমৎকার চমৎকার ! চমৎকার...অপূৰ্ব্ব... অপূৰ্ব আবেগে আমার চোখ দুটী বুজে এলাে। কলাবতীর আমি তখন কিছুই জানি
—আমার চিন্তা আবেগময় অপেক্ষা না মানে । মনে হলাে, সবচেয়ে বড় মানুষ, এই কলাবতী, কি নির্লিপ্ত যতটুকু এর প্রয়ােজন—তার চাইতে নিজেকে একতিল হারায়নি—কতটুকু ওর প্রয়ােজন—কি রিক্ত—কতখানি পূর্ণ ; চারিদিকে সম্পূর্ণতার ছোঁয়াবনগন্ধ—পরিপূর্ণ সবুজ, স্বাধীন। ট্রেনলাইন কোথায় চলে গেছে...সিগনাল পােষ্ট—তারপরে একটী শিমুলগাছ, তার লীলানমনীয় শাখা, আরও দূরে কালাে বনরেখা—তারপর উদার আকাশে অস্তমিত সূৰ্য্য—তারই পাশে জীর্ণ, খণ্ড ক্ষুব্ধ, দীর্ণ মেঘ-প্রান্তে প্রান্তে রক্ত লেখা।
মনে হলাে সুর কল্যাণ ধ্বনিত হয়ে উঠছে । মনে হল, আমার কল্পনায় যেন ছিল এই ছবিটী, এই সৌন্দর্য্য এছাড়া জগতে আমি কিছু চাইনি, শুধু এই । কলাবতী, তার পারিপার্শ্বিক ছবিটী এই চরম পূর্ণতার । মনে হলাে লক্ষ শত যুগের মানুষ যা কল্পনা করেছে, যা চিন্তা করেছে তা এই কলাবতীর জীবন যাত্রার মধ্যে আমি দেখতে পেলাম ; দেখার আগেভাগে। দেখলাম হৃদয় নিয়ে বাঁচা আর কিছু নয় । হৃদয়। নিয়ে বাঁচা, প্রতি অনুতে পরমাণুতে..তার আত্মায় আমি বিমুগ্ধ হয়েছিলাম ।দেখলাম ইট সাজিয়ে উনুন হলাে, অন্য মেয়েটী মুখ নীচু করে ফুঁ দিয়ে প্রয়াস পাচ্ছিল আগুন জ্বালবার জ্বাললে আগুন—তাতে গাঢ় মসীলিপ্ত হাঁড়ি চাপালে ।
জিজ্ঞেস করলাম, ওতে কি হবে ? কলাবতী বললে, ওতে ! ওতে চা হবে... চা !•• তুমি..তুমি চা খাবে...? যদি দয়া কর— দয়া আবার কি...কিন্তু আমরা কেউ থালায় ঘটিতে খাবাে যে... আমিও তাই খাবাে...
আমার রকম সকম দেখে ও একটী হাসির ফোয়ারা হয়ে উঠলাে। বুঝলাম—ভেবেছে কি বিরাট আস্ত পাগল...জীবনে সে কখনও দেখেনি— আর আর মেয়েরা, তারা দৃষ্টি দিয়ে, ভঙ্গি দিয়ে শ্রদ্ধা জানাচ্ছিল, হৃদয় পেতে অতিথি সৎকার করছিল আর সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন দৃষ্টি দিয়ে
আমায় বুঝবার চেষ্টা করছিল। কলাবতীকে বললাম, বাপু এ মােড়া থাক আমি মাটিতে বসি ।।ওরা ত্রস্ত তটস্থ হয়ে অনেক খোঁজার পর খুঁজে আনলে সব চেয়ে যেটী ভাল—জীর্ণ মাদুরটী পাতলে । আমার ইচ্ছে হচ্ছিল লুটীয়ে পড়ি—হৃদয় অকারণে ঝঙ্কৃত হয়ে উঠছিল—অপূৰ্ব অনৈসর্গিক আনন্দের তীব্রতায়...
আমি বসলাম, আমার পাশে একটী ছােট মেয়ে, তারই পাশে একটী বুড়ী, আর সামনে কলাবতী । অন্য তরুণী যত্নে চা প্রস্তুত করছিল। বুড়ী বললে, আমার মত নাকি তার একটী ছেলে আছে, তার বয়েস হবে এক কুড়ি এক কি দুই, কাজ করে আসামে..
তরুণী বললে, অনেকদিন পরে দুধ দিয়ে চা হচ্ছে...
চা এলাে...সসম্মানে চায়ে চুমুক দিতেই নাড়ি বিদ্রোহ করে উঠলাে বমি, এলাে—কি বিশ্রী-রাম রাম তবু হেসে বললাম, চমৎকার..
কলাবতী হাসিবিগলিত বদনে বললে, সব কিছু চমৎকার নিশ্চয়...
খবর নিলাম ওদের আজ কি রান্না হবে । শুনে মনে হলাে ওদের আজ পরম উৎসব। তারপর কলাবতীর সবামী এলাে, তার নাম জীবদয়াল - কাল, সুপুরুষ আমার আগমনে সে খুব খুশী হয়েছে। তার সঙ্গে নানান গল্প হলাে; সে লাইনে কাজ করে । রাত হয়েছে সেটা স্মরণ করিয়ে দিয়ে কলাবতী বললে, বাবু এখন বাড়ী যাও....
কথাটা কানে বাজলাে—ক্ষেপে উঠলাম, ভেবে নেওয়া কারণে, মনে হয়েছিল তারা আমার এই উপস্থিতিটা পছন্দ করছে না..হ্যাঁ যাচ্ছি...
আমি উঠে ধীরে ধীরে পা ফেলে চলতে সুরু করলাম পা ফেলার সূচনায় একবার ঘাড় ফিরিয়ে ওদের দিকে চেয়ে দেখলাম—ওরা হাসাহাসি করছে । চকিতে মনে হলাে, হাসির কেন্দ্র বােধ হয় আমি ! বিশ্রী ভাবে ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলাম, যে সৌন্দৰ্য্য দেখেছিলাম, পৌঁছেছিলাম যে স্তরে নিমেষেই তা কদৰ্য্য রূপ নিলে । নিমেষেই মিথ্যে মনে হলাে তাকে, সেই রূপকে, যে কল্পনা মূর্ত হয়ে উঠেছিল বাস্তবতায় ; নিজের গণ্ডি খানি—ক্ষুদ্রতাকে পেরিয়ে সীমাহীনের মধ্যে পৌঁছে ছিল। ভেবে নেওয়া কারণে প্রকটিত হয়ে উঠলাে ওদের ইতরতা। নিজেকে খানিক ভুলের বশে অপমান করার জন্য ক্ষোভ হলাে।
বাড়ী ফিরে এসে বড় চঞ্চল হয়ে পড়লাম, ইচ্ছে হলাে ধ্বংস করি, ভেঙ্গে ফেলি সব কিছুকে, থাকবে না কিছু টুটে যা সব...নিজের স্তরকে ভাল করে বুঝে দেখলাম ওরা আছে অনেক নীচে। আমার জীবন যাত্রার পন্থা কোথায়—আর ওরা কোথায়...অনেক ব্যবধান...ঠিক করলাম আর যাবাে না, যত মনে হয় ওঁরা হীন—দেখি আর কিছু নয়, বাহিরের রূপটা চোখকে ঘৃণা করবার ইন্ধন যোেগাতে লাগলাে ।একবার মনে হলাে ওই যে দুঘণ্টা ওখানে অতিবাহিত করলাম, তখন আমার চোখের বিলাস ছিল না, তখন কি আমি ছিলাম স্বপ্নে ?
তবে কোন মাদকতায়—কেমন করে সে সময় কাটিয়েছিলাম ! কোথা থেকে অহেতুক, অপ্রয়ােজনীয় অভিমান এসে, ঢেকে ফেললে মন, ভাবলাম, আর যাবাে না; এমনি সে অভিমান, যেন আমি কলাবতীর কত গােপনে, কত কাছের মানুষনিজেকে অন্য ভাবে তৈরী করে নিলাম, সাজপােষাক থিয়েটারে আর সিগারেটে..এরই মধ্যে একদিন সন্ধ্যায় তখন আমি বাড়ীর পথে,ভাবলাম, আমার সঙ্গে কলাবতীর পার্থক্য অনেকখানি..শুধু অনুভবেই তা বুঝা যায় ও যেখানে, আমি তার অনেক পিছিয়ে !
আমি আছি কিছু ভাবনায় আর ভাবনাহীনতায় বেশী, গতদিনকে নিয়ে চলেছি, অতিক্রম করে চলেছি আজ--আর ওই ভাবনা বেশী কিংবা নিভাবনায়...সমতার যায়গায় বাঁচবাে কি করে—কেমন করে পৌছবাে সেখানে যেখানে স্ব’ বলে কথা নেই ?
মনে হলাে, ওরা করছে জীবন যাপন আর আমি জীবন ধারণ—আমি আছি জ্ঞানীহনতার প্রথমে আর ও আছে জ্ঞানের প্রথমেদিন সাতেক পর..বসে আছি নির্জন কক্ষে, মন ছিল কবিতার বইয়ে, এমন সময় দেখি সে, দীর্ঘ আরত লােচন দুটী মেলে চেয়ে আছে চকিত চিত্তে বলে ফেললাম, এই যে...তারপর কথা বলতে গিয়ে ওষ্ঠ শুধু কাঁপতে লাগলাে জীর্ণ পাতার মত, কিছুক্ষণ বাদে বললাম, কেমন আছাে ? তারপর হঠাৎ কি মনে করে ? এমনি..কই আমার বাড়ীতাে আর যাও না ? তুমি তাে আমায় ডাকনি...
ডাকলে কি যেতে নেই... মনে হয়েছিল ! ভেবেছিলাম--তুমি আসবে... কি করে ভাবলে ? এইবার হেসে ফেললে । বললাম—আজ যাবাে হ্যাঁ...সত্যি করে বলতাে কোথায় যাচ্ছিলে ?
ওষুধ আনতে ওষুধ !কেন ?—মনে হলাে, স্বামীর বােধ হয় অসুখ, শুধালাম,-অসুখ কার ? সুবচনীয়ার।
আপনার অচেতনে ভেবেছিলাম ওর স্বামী বুঝি বা কালের কোলে ! আনন্দ নিভে গেলাে। বললাম, চল আমি ডাক্তারি জানি— তুমি যে দেখছি সব জানাে ।
জানলে যে তােমার বিপদে পড়তে হবে, চলাে। দুজনে আবার চলতে সুরু করলাম। আর ওর পাশাপাশি যেতে কেমন সঙ্কোচ দোষ হলাে। ওকে-দেওয়া বােধ গুলাে তখন আমায় মুহূর্তে মুহূর্তে লজ্জিত করে তুলছিল । মনে হলাে, কলাবতী ও যেন একটু এড়িয়ে চলেছে,—সেদিনের মত সে আর সে সরল নয়, এ কথা ভেবে কেন কি জানি ঈষৎ সুখ পেলাম।সুবচনীয়ার অসুখ বিশেষ কিছু নয়। কলাবতীকে একান্তে ডেকে বললাম,“ভীষণ ব্যাধি ! তবে, আমি আছি ভয়ের কারণ নেই—তােমরা প্রত্যেকে একটু সাবধান থেকে বুঝলে ?—ওর মুখ দেখে মনে হলাে আমার কথা, সাবধানে বাণী ওকে যেন স্পর্শ করেনি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম,“চলাে কলাবতী ওষুধ নিয়ে আসবে ?
চলাে। চলাে, লাইনের উপর দিয়ে যাই তাড়াতাড়ি হবে-
আবার আমরা দুজন । দুজনে চলেছি লাইনের উপর দিয়ে, কখনও পাশের সঙ্কীর্ণ পায়ে চলা পথে—তারই মাঝে মাঝে, আমি মাঝে মাঝে চঞ্চল হয়ে পড়ছিলাম, পথ-পাশে ফোটা বনফুল ছিড়তে ছিড়তে চলেছি কানে ভেসে আসছিল কলাবতীর গতিভঙ্গি আর তার সহজ আভরণের শব্দ ; অন্যমনে যেতে যেতে আচমকা আর পায়ে—একটী কাঁটা ফুটে গেলাে। পাশের--কালভার্টের উপর বসে পড়লাম । কাতরকণ্ঠে কলাবতী শুধালে—লেগেছে খুব ?
—তবে বলে কাঁটা তুলবার চেষ্টা করতে লাগলাম—আমার রকম দেখে ও হেসে বললে—ওটা আমার কাজ বলে, সস্নেহে আমার পাখানি নিয়ে সেবা সুনিপুন হাত দিয়ে বার করতে লাগলাে। কাঁটা তােলার সময় ওর মুখের পানে চেয়ে দেখি, ব্যথায় বিধুর—ওর মুখের পরে ছায়া পড়েছে ভৈরবীর নিখাদের, অন্তরে আছে যে অভিমানী সকরুণ সুর, তারই। হঠাৎ তখন কোথা হতে এল আমি অদম্য স্পৃহা, কোন মতে নিজেকে সংযত রাখতে চেষ্টা করলাম—অন্য কথা ভেবে, মনে এলাে ওর কাছে আমার জেনে নেবার যা ছিল ।
দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললে—হাঁটতে পারবে? যদিও হাঁটতে হয়তাে কোন অসুবিধে হতাে না তবু বললাম ব্যথাটা একটু কমে যাক...
পীতসবুজ মাঠ অতিদূর ব্যাপি বিস্তৃত। পশ্চিম গগন দিগন্ত:তখন সূৰ্য্যহারা, রয়ে গেছে শেষের রক্তলেখাটী —যেন পরাজিতের হাসি । জিজ্ঞেস করলাম কলাবতী তােমরা বেশ সুখে আছছা না ?
সুখ... ? হ্যাঁ...সুখ... সে কি...?
আশ্চর্য হয়ে বললাম—সুখ তুমি জানােনা ! অর্থাৎ আমি বলতে চাইছি, আনন্দ বুঝিয়ে বললা— আনন্দ তুমি বােঝ না ? সত্যি আমি কিছুই বুঝতে পারছি না, বিশ্বাস কর ।
আমি যা হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করে ছিলাম, তা কেমন করে ওকে বােঝাবােখানিকটা অভাবের সমস্যার পূরণকে যে আমি সুখ বলি না, সত্যকার আনন্দ—যা আমি বুঝেও বুঝি ; মনে হল আমি কাকে কি জিজ্ঞেস করছি। তােমার মনে কোন সাধ খুসি কিছু নেই, কোন কামনা নেই ? কোন বাসনা নেই– নেই— কিছু না—
অদ্ভুত ঠেকলাে। তবে কোন আনন্দ নিয়ে ও বেঁচে আছে, এই বিংশ শতাব্দীর লােভ যার নেই তাকে মানুষ বলেই গন্য করা যায় না, বাঁচার যে তার কোন ক্রমেই অধিকার নেই!—কেমন ভাবে ও বেঁচে আছে ? ও কি পৌচেছে উৰ্দ্ধতম চেতনায় ! বাসনা নেই,কামনা নেই এ কেমন কথা, অসম্ভব নয় কি? একবার মনে হলাে হয়তাে ওর উর্দ্ধতন কোন মহান পুরুষ, যা আমার প্রশ্ন, তা নিয়ে সাধনা করেছিলেন কলাবতী আজ তা পরিপূর্ণ ভাবে উপভােগ করছে—ভুলেছে শুধু কথাটীআনন্দ ওর স্বভাব। বললাম চলাে। বাড়ীতে এসে ওকে হােমিওপ্যাথি ওষুধের গুলি দিয়ে বললাম পাঁচটা করে দিও.. কলাবতী চলে গেল।
ওদের আচার ব্যবহার দেখে বিমূঢ় হয়ে গিয়েছিলাম সে দিন সুবচনীয়াকে দেখতে গিয়ে শুনলাম, সেই বৃদ্ধা যার ছেলে সুদূর আসামে কাজ করতাে—সে আর নেই। বৃদ্ধা মােটেই বিচলিত হল না, আরাম করে তামাকটি সেজে নিয়ে আরাম করে টানতে টানতে কাঁদতে লাগলাে । তা কান্না নয়—যেন গান—গানের শৈশব ।
বিগত দু হাজার বৎসর পূর্বের সুর তার মধ্যে রনরনিয়ে উঠছে-বৃদ্ধার মাতৃত্ব ছিল গভীর, মাতৃত্ব পুরুষ শুধু কাদের ভিতর বােঝায় তা ছিল তার অন্তরে । শােক বলে কিছু নেই একটু খানি সংস্কার, প্রথমে আমার খুব হাসি পেয়েছিল কিন্তু সাহস সহায় হয়নি—সুবচণীয়ার অসুখ সারলাে—আমার সম্মান বর্ধিত হলাে ; সে আমায় ডাগদার সাব বলে ডাকে, একদা সুবিধে বুঝে তাকে প্রশ্ন করলাম ; আনন্দ কি জানাে ? সে উত্তর করলে, “না।” এরা সত্যি কোন স্তরের ; এরা কি প্রথম যুগের ! না যে মানুষ আছে কল্পনায়,যদি প্রথম মনগত যুগের হবে তাহলে সে লােভ কোথায়—সে অমানরিকতা কোথায় ? কলাবতী এসে বললে, তােমার যে নেমন্তন্ন...। আমার !
হঠাৎ...
ও সুবচনীয়াকে ডাকলে, সুবচনীয়া বললে, আমাদের রীতি, যে অসুখ সারাবে—তাকে আদর করে খাওয়াতে হয় ।
কবে ? কাল। নিমন্ত্রণের দিন, মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে—দূরে আকাশ ঝাপসা হয়ে আছে, আমি বেছে বেছে ঘেঁড়া জামাখানি পরলাম.হয়তাে অগােচরে ভেবেছিলাম—পার্থক্যটা এখানেই কিন্তু জানতাম আসল বিভেদ মনােগত ।পৌছলাম ওখানে, প্রায় আটটার সময় বৃষ্টি থামলাে রান্না চাপলাে তখন। আমি জীবদয়াল নাগেশ্বর। (সুবচনীয়ার স্বামি) বসে বসে গল্প করতে লাগলাম।
এরা যন্ত্রযুগের কলাবতী কি সুবচনীয়ার মত কালচার এদের নেই ; গল্প হলাে নিত্যনৈমিত্তিক জীবন সংগ্রামের ; ক্রমে বিরক্ত হয়ে উঠছিলাম—ওরা বললে, বাবু - মাপ কর—রাত্তির এগারােটায় খাওয়া হলাে। জীবদয়াল আর নাগেশ্বর গেল কাজে—আমি বাড়ী ফিরতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু পারলাম না—মনে হলাে যেন আমি আমার নিজের স্থান অধিকার ছেড়ে চলে যাচ্ছি—কোথায় ? অনতি পরেই ফিরে এলাম। ফিরে এসে লজ্জার সীমা রইল না, তবুও আস্তে আস্তে সুবচনীয়াকে ডেকে শুধলাম, বলতে পারাে কেন এসেছি ?
পারি—তুমি আসনি, তােমায় টেনে এনেছে—তুমি কলাবতীকে ভাল বাসাে না ? কি জানি ? সত্যি আমি জানতাম না যে কলাবতীকে আমি ভালবাসি কিনা ?—তাকে ভালবাসি, —তার জীবন যাত্রার পন্থাটী ভালবাসি ? সুবচনীয়া বললে—ওকে ডেকে দেবাে ?
তখন আমি নিশ্চল নির্বাক। বললে “দাঁড়াও” আমি মানা করতে পারলাম না—ঘন অন্ধকারের মধ্যে আপনাকে হারিয়ে দাঁড়িয়ে আছি, সুবচনীয়া ফিরে এসে বললে—যাও ডাকছে।দ্বিধাহীন, শঙ্কাবিহীন—নির্লজ্জের মত আমি প্রায় গুড়ি মেরে পাতার চালের মধ্যে প্রবেশ করে দেখি দেবী কলাবতী—একটী সুপ্ত কুকুরকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে শুয়ে আছে। ঘনময় পুরােন—বিশ্রী বাষ্প।
বললে—এত রাতে। ক্ষমা করাে । 'হেঁসে বললে—অর্থাৎ আমার উচিত হয়নি এত রাতে আসা।। রাত !বলে তারপর নির্বিকার ভাবে বললে—রাত হয়েছে তাতে কি ক্ষতি ! মানুষ মানুষের কাছে আসবে তাও কি দিন ক্ষণ মেনে ?
এ তােমার ভুল ধারণা কিন্তু—চুপ করে থেকে শুধালে—কেন এলে।কি জানি—কেন যে এলাম তা জানি না।
—কি একটী কথা আমার বলার ছিল, অথচ তা আমার তেমনি করে জানা ছিল না, যে কথাটী বলা যায় গানে, জানা যায় যােগে, তুমি আর আমি এক । আমি শুধু তারই খানিক আভাস দিতে পারি, করুণ কাতরভাবে চেয়ে। স্তব্ধ হয়েছিলাম। হােগলার চালের একটুখানি কেটে জানলা হয়েছে, সেই অবকাশ দিয়ে দেখা যায় শরীময় শূন্যতা। প্রকাশ হয়ে পড়েছে—মেঘব্যথিত তিমিরলজ্জিত তারাভরা খানিক আকাশ। শ্রবণের পথে অনন্ত গানের ধ্বনি—মনে এলাে অনন্ত চেতনা
বললে—সত্যি তুমি জানাে না কেন এসেছাে ?
আধ্যাত্মিক প্রশ্নের মত শােনালাে, বললাম—আমার জানা উচিত ছিল ক্ষমা করাে ।
ছিঃ বারবার ও কথা বলাে না। অনতিপরে বললে,—কিন্তু আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি এই ভেবে যে, তােমার পৃথিবী ছেড়ে, আত্মীয় ছেড়ে, সকল কিছু ছেড়ে হঠাৎ এমনি একটী নিভৃত কোণে মন পড়লাে কেমন করে ?
এটা নিতান্ত স্বাভাবিক কলাবতী তােমার সব কিছু বড় ভাল লেগেছে..হয়তাে যা খুঁজছি। তা পেয়েছি--- কি খুঁজে পেলে ? সুন্দরকে। কি সৌন্দর্য্য তুমি এর থেকে পেলে ?
সব চেয়ে যা সুন্দর, যা ছিল আমার স্বপনে, আমি যাকে অনুভব করেছি হৃদয়ে, রক্তে, ইন্দ্রিয়ের সঙ্গীতে...আমি আনন্দ পেয়েছি...
পাগল ।
হতে পারি যদি তােমার জীবন পাই। আমি মানুষ আমি সম্পূর্ণ হবাে । তুমি নেহাৎ শিশু হয়তাে কিন্তু তুমি আমায় ঠেকিয়ে রাখছে ? আমি আদর্শ চাই, উৰ্দ্ধতম অবস্থা আমার চাই...সত্যি তুমি পাগল..বলে মা যেমন সস্নেহে শিশুর মাথায় হাত বুলিয়ে দেন, ভগবান যেমন পাপীকে তেমনি করে ও আমার মাথায় হাত বুলােত বুলােতে শুধালে—
—তুমি আমায় ভালবাসাে...।
কি জানি, ঠিক বলতে পারি না কলাবতী:-ওই ইতস্ততার মধ্যে আমিও রয়েছি..কিন্তু তােমার পন্থা আমার ভাল লেগেছে, আমি ভালবেসেছি তােমার এই অনাড়ম্বর, সুন্দর স্বাধীন জীবন আমায় স্পর্শ করেছে—ইতরতা দীনতা দানবিকতা নেই, তুমি জীবন পেয়েছাে, তুমি জীবন যাপন করছে—আমি জীবন ধারণ করছি, জান তােমার পন্থাই আমার পন্থা, তােমার জীবনই আমার—এই ভাবে বাঁচতে আমি চাই..এই সমতা আমি চাই তুমি যেমন আনন্দ কি, সুখ কি জান না—আমি ওই না জানার আনন্দ পেতে চাই বলে তার হাত দুটী জড়িয়ে ধরলাম, মরণােম্মুখ যেমন করে তৃণকে অবলম্বন করে--দুজনের নিশ্বাসের দেওয়া নেওয়ায় অনেক লক্ষ গান হলাে রচনা, দুজনের পানে চেয়ে রাত প্রায় কাটলাে।
ফুল ফোটার বাতাস বইছে, ভৈরবী সুরের রেখাবের মাঝে, রাত্র তখন ক্ষণ বিশ্রামে মগ্ন, দুরে সবে-দেখা-দেওয়া আলাে । আমি বিদায় নিলাম ; বললে, পাগল হয়াে না।
সুবচনীয়া তার স্বামীর কাছে বলেছিল আমার ব্যাপারনাগেশ্বর যন্ত্রযুগের মানুষ ; বললে, বাবু জীবদয়ালকে কিছু টাকা দিন—
কি জানি কেন বললাম, কত ? বললে, যা ইচ্ছে আপনার । দিলাম টাকা। যে ভাবনা বাসা বেঁধেছিল—আজকের পৃথিবী থেকে আরাম পাবার জন্যে প্রকাশ পেলাে তা সৌন্দর্য্যের মধ্যে—চাঁদের মধ্যে কলঙ্কের মত—
জীবদয়াল সহসা উধাও হলাে—আমি বিস্মিত হয়ে ভাবলাম এ কি ? কলাবতী কাঁদতে লাগলাে—আমি তাকে স্বান্ত্বনা দিতে লাগলাম।লােকে শেষে ভাবলে, আমার দৃষ্টি ছিল দেহগত কলাবতীর উপর। ধিক্কারে চিত্ত আমার ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলাে। আমি যা ভাবিনি তাই হলাে—আমি চেয়েছিলাম একটুখানি স্থান-হীন অভিসন্ধি, অভিপ্রায়ের কণাটুকু তাে ছিল না মনে।
এ জীবন আমার ভাল লাগে।নি—এই প্রতি মুহূর্তের জন্যে ভাবা জীবন, এর মধ্যে কোন আর্টের লেশ মাত্র নেই—যে মানুষ হবে সে কখনই এ অন্যায় মানতে পারবে না। তারপর বুঝলাম আমি সময় মানিনি—আর একদিন, ওদের পথের পথিক হবাে ভেবে ভেঁড়া জামা পরেছিলাম। স্বপ্ন ভেঙ্গে গেল, কলাবতীকে বললাম, দেশে যাও।
আমার চাওয়া পূর্ণ হবে অনাগত—আশার মানুষের মধ্যে তাদের শিল্পের সৌকুমাৰ্যে—সঙ্গিতে, চিত্রে, কাব্যে। ওরা সবাই গেল—পেছনে পড়ে রইলাে হােগলার ঘর।
সব ছন্নছাড়া হয়ে গেল—শুধু একটুখানি বুদ্ধিতে। কোথায় গেল জীবন যাপন আর জীবন ধারণ ! কলাবতী বললে, চললাম—পাগল হয়াে না।
ট্রেন ছাড়লাে শূন্যময় হয়ে গেলাে হাওড়া স্টেশন—ধীরে ধীরে গঙ্গার ধারে এসে দাঁড়ালাম—গঙ্গার দিকে চেয়ে দেখি তীব্র তার স্রোতের গতি—চোখে সইল না। ক্লান্তজনের মত এ পথ সে পথ করে এলাম সেই হােগলার ঘরের কাছে-দুরন্ত ফাঁকা—উপরে রেল লাইন দূরে লাল আলাে।
আমি আস্তে আস্তে কলাবতীর ঘরে ঢুকে ভিজে জমীর উপর—জুমী আঁকড়ে শুয়ে পড়লাম—মাটীর মধ্যে জড়িয়েছিল পুরোনো দিনের ইতিহাস—আমি গভীর ভাবে অনুভব করলাম-মনে পড়লাে জীবন ধারণ আর জীবন যাপন—আর একদা বরষার দুপুরের—একা ঘরে বসে শােনা-মধুময় ‘মধু ডাকটি। কান পেতে শুনলাম মাটীর মধ্যে প্রবাহিত অনন্ত চেতনা..
পৃথিবীতে আমার কেউ ছিল না বললে ভুল করা হবে, বলবাে আমি কারুর ছিলাম ।
স্বভাব ছিল আমার চুপ করে থাকা সব সময় ইচ্ছে হতাে নিভৃত কোণে থাকতে তাই মনের মত ছিল, ছাদ, সিড়ির তলের অপরিসর ক্ষুদ্র ঘরটি ; একটু ভীতুও ছিলাম কারুর সঙ্গে মিশতে চাইতাম না। শুধু নিজের কল্পনার মধ্যে—সেখানেই আমার সকল ইন্দ্রিয়ের বাসনা তৃপ্ত হতাে—চোখের সামনে একটা শান্তির ছবি ঘুরে বেড়াত।
একদা এমনি চুপ করে বসে আছি, সিড়ির তলার ঘরে—টীপ টপ করে বৃষ্টি পড়ছে—
এমন সময় দেখি—আসছে একটী মেয়ে। কি তার রূপকালাে চোখদুটী কতাে ভাবে ভরা—গভীর—কৌতুকের—স্বপ্নমাখা। তার গতিভঙ্গিতে যেন সুধা ঝরে পড়ছে ; যেন এ কোন বিখ্যাত বাঙলী শিল্পীর ছবি রসে রেখা রঙে রঙিণ...
ওকে দেখে কেমন একটি বেদনা অনুভব করলাম, সে বেদনা দুঃখে নয়, পরিপূর্ণ আনন্দের, যে আনন্দ ছিল কল্পনায়—গভীর ভাবে ওর দিকে আমার চোখ তাকিয়ে ছিল, মন তখন খুঁজে বেড়াচ্ছিল আমার মধ্যে—একটা কিছু খুঁজে ! হেসে মেয়েটি জানালার কাছে এলাে।
সে কি হাসি যেন আমি কত কালের চেনা, কত কাছের মানুষ—সে হাসির মধ্যে সহানুভূতি ছিল, কৌতুক ছিল, অনিমেষে চেয়েছিলাম তার দিকে, বুক আমার স্পন্দিত হয়ে উঠলাে।
•••মধু নেবে—
আগেই বলেছি আমি ভাল কথা বলতে পারি না, তায় ভীতু, আমার স্বর রােধ হয়ে গেলাে...চেয়ে আছি ওর দিকে ‘মধু যেন হৃদয় হতে উথিত হলাে। তার গা প্রায় অনাবৃত, সেই ফতুয়ার মত জামা, যৌবনের পরিপূর্ণতার সঙ্কেত—তারপর নাভির থেকে নেমেছে ঘাঘরা পা পর্যন্ত, কানে রূপাের কান, নাকে নাক চাবি, চন্দ্রচূড় ধরনের গহনা মাথায়, সব মিলিয়ে ছিল অপরূপবললামনা।
--মধু নােব না বাবু-মিষ্টি ! বলে অঙ্গ তার এমন একটি দোলা দিল, আমার মনে হলাে দেহে ভুলে মধু কিনি— বললে নেবে না বাবু ? না•••
পরমবিস্ময়ে উচ্চারণ করলে, “না” বলে এমন ভঙ্গি করলে যেন সে stage এ অভিনয় করছে, তারপর ধীরে চলে গেল, আমি তখন গভীরতার মধ্যে, সে সময় যখন কেটে গেল তখন শুনতে পেলাম, স্লান ডাক—“মধু মিষ্টি কি সুন্দর, আমার কি ওর ভাল লাগলাে ? ওকে দেখে মনে হল রামির কথা, এ দুই নয়নে নিমেয় দিয়েছ কেবা ।
বাড়ীতে আর কেউ হয়তাে দেখে থাকবে—যে সে এসেছিল আমাদের দোরে—কথা চলছিল তাদের চরিত্র নিয়ে, আমি ভয় পেলাম, ভাল ছেলে বলে নাম আমার তৎক্ষণাৎ বললাম ওরা ভয়ানক পাজি হয় আর চোর—দুটোই বড়দি বলে হ্যাঁ, আমি জানি বলে তার নূতন শ্বশুর বাড়ীর গল্প সুরু করে দিলে ।
নিখুঁত ভাবে বর্ণিত হলাে তাদের চরিত্র, আমার মন তখন খুঁজে বেড়াচ্ছে—সে কোথায় ! লক্ষ পথে তারই সন্ধানে মন আকুল ভাবে খুঁজে বেড়াচ্ছে।
দিন সাতেক পর, যখন আমি তাকে অন্তরের শক্তি দিয়ে ভাবতে চেষ্টা করছিলাম, খুঁজে বেড়ােচ্ছিলাম, হাতে ছাতা, পরণে আমার বষতি, ভিজে সপসপ করছে, দেখি—মধুওয়ালি নিরুদ্বিগ্ন চিত্তে বাড়ীর বারান্দায় বসে ; গালে হাত দিয়ে আনমনে কি ভাবছে। এ যে যক্ষপ্রিয়া !—তার আয়ত চোখ পথের দিকে নিবদ্ধ কার পদচিহ্ন খুঁজছে—ঠোঁটে তার ক্ষীণ সুস্মিতরেখা।
ওকে দেখে আমি অব্যক্ত আনন্দে জেগে উঠলাম—কে বলে উঠেছিল—অবশেষে তােমায় পেয়েছে।
আনন্দের পরিমান ভয়ে মুখ পাংশুবর্ণ হয়ে এলােলজ্জায় দৃষ্টি অন্ধ । আনমনে সুন্দরী আমার দিকে চাইলে---চেয়ে রইলাম আমি অনিমেষে।সেই কৌতুকের হাসিটি—মনের ভিতর থেকে বলে উঠলাে—কেমন আছাে—আমায় ভােলােনি... বললে, বাবু কেমন আছাে.. ভাল—তুমি কেমন আছাে ভাল কথা খুঁজছিলাম কি বলবাে ! এমন সময় বললে, বসাে•••
মনের ভেতর যে কথা ভাবি, কেমন করে তার কাজ হয়ে যায় ভেবেই পাই না। হয়তাে ভেবেছিলাম ওর পাশে স্থানটী কবে পাবাে। যেই বললে, বসাে—প্রায় ওর কাছেই বসে পড়লাম । ও একটু সরে বসল, দেখে লজ্জার সীমা রইল নাদাঁড়াতেও পারি না, চুপ করে থাকার পর বললাম, বিশ্রী বৃষ্টি না ? নিশ্চয়, কিন্তু তােমাদের আর কি ক্ষতি...
ক্ষতি নয় কি রকম ? -সাংঘাতিক! দেখতাে রাস্তা চলবার যাে নেই, অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছি, আর ভাল লাগে না...
এইটুকু ! আর আমার বাড়ী হয়তাে ভেসে গেছে। ভেসে গেছে...! দেশে কি ?
দেশে না, এখানেওই রেল লাইনের ধারে, হয়তাে বিছানাবলে একটু হেসে বললে, বিছানা আর কি এই মাদুর-টাদুর ইত্যাদি সব ভিজে গেছে...
কল্পনায় আমি দেখতে পেলাম, একটী শান্তির নীড় সবুজ মাঠের পরে,—চিরবসন্ত বাসা বেঁধেছে যেথা, শান্ত সুন্দর। আকাশের পানে, কল্পনার দিকে চেয়ে আনমনে বললাম, কতদূর
খুব কাছেই—ভুরু কুঁচকে বললে ।
আমায় নিয়ে যাবে ? এই কাতর প্রার্থনা নিজেকেই লজ্জা দিলাে। ও তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে বললে, নিশ্চয় তারপর কি জানি কি মনে হলাে, বললে, কিন্তু কেন ?
কি বলি—বললাম, কেন আর—এমনই। এমনি ! আমার দেখতে ইচ্ছে হয় দেখতে ইচ্ছে হয় আমার বাড়ী ! বল্লে সরল ভাবে সে হেসে উঠলাে। আমি জেদ ধরে বললাম, চল যাই.. বৃষ্টি পড়ছে যে -
তাহলে তুমি আমার বাতিটা পর তােমার বষাতি—হেসে বললে, পাগল—তাহলে মধুর কলসী— আমি নেবােপাগল—বলে, সকৌতুক হাসলাে.......তারপর দুজনে উঠে চলতে সুরু করলাম। আমি ওর মাথায় ছাতাটা ধরে চলেছি। রাস্তার লােকেরা আমাদের দেখে ঠিক হাসতে পারলে না, একটু অবাক,আশ্চর্য হয়েই রইল ।
একজন ভদ্ৰযুবক এমন ভাবে ছাতা আড়াল করে সামান্য একটি মেয়ের সঙ্গে যাচ্ছে দেখে, রীতিমত তাদের মধ্যে বিস্ময় ও কৌতুকের সঞ্চার করলে, তাদের অস্বস্তিতে আমিও ঈষৎ অস্বস্তি বােধ করছিলাম। কিন্তু আনন্দে—এসব ভূক্ষেপ করলাম না।
তােমার নাম কি ? আমার ? অবাক হয়ে হাসলে--
হাঁ
কলাবতী।
ওর বাড়ী—পৌছলাম। বৃষ্টি তখন থেমে গিয়েছিল, পােলের ঢালু জমির ওপর কয়েকটা হােগলার চালা তিনহাত উঁচু হবে—তার কিছু ওপর দিয়ে রেল লাইন চলে গিয়েছে । কলাবতী বললে, কোনটা আমার বাড়ী বলতাে ?
ওইটা— অবাক হয়ে বললে, তুমি কি করে জানলে ! আমি পারি— কলাবতী বললে দাঁড়াও
•বলে হােগলার চালের ভিতর মাথা গলিয়ে দিয়ে,—মধুর কলসীটা রেখে এলাে। তারপর আর সব মেয়েদের দেশী ভাষায় কি বললে—তারা তখন আমার দিকে অন্য চোখে চাইলাে। আমার কেমন লজ্জা করতে লাগলাে-কলাবতী একটী জীর্ণ মােড়া দিলে, আমি সন্তর্পণে তার উপর উদ্বিগ্ন চিত্তে বসলাম কারণ কে জানে যদি মােড়াটা বিশ্বাসঘাতকতা করে, ভাবলাম একটা সিগারেট ধরাবাে কিনা ? সহসা দেখলাম পাশেই একটী হুঁকো, বললাম, কলাবতী তামাক।
আমাদের কে ? তাতে কি...
আমার জন্যে ভাল করে কোটী ধুয়ে, তামাক সেজে আমায় দিলে,-অনভ্যাস, কাশী চেপে রাখলাম একজন মেয়ে আঙিনাটী পরিষ্কার করলে, যথাসম্ভব করে.
কলাবতী বললে, এই আমার বাড়ী..ঈষৎ লজ্জায় তার হাত দুটো ইতস্তত দুলতে লাগলাে।
বললাম, চমৎকার চমৎকার ! চমৎকার...অপূৰ্ব্ব... অপূৰ্ব আবেগে আমার চোখ দুটী বুজে এলাে। কলাবতীর আমি তখন কিছুই জানি
—আমার চিন্তা আবেগময় অপেক্ষা না মানে । মনে হলাে, সবচেয়ে বড় মানুষ, এই কলাবতী, কি নির্লিপ্ত যতটুকু এর প্রয়ােজন—তার চাইতে নিজেকে একতিল হারায়নি—কতটুকু ওর প্রয়ােজন—কি রিক্ত—কতখানি পূর্ণ ; চারিদিকে সম্পূর্ণতার ছোঁয়াবনগন্ধ—পরিপূর্ণ সবুজ, স্বাধীন। ট্রেনলাইন কোথায় চলে গেছে...সিগনাল পােষ্ট—তারপরে একটী শিমুলগাছ, তার লীলানমনীয় শাখা, আরও দূরে কালাে বনরেখা—তারপর উদার আকাশে অস্তমিত সূৰ্য্য—তারই পাশে জীর্ণ, খণ্ড ক্ষুব্ধ, দীর্ণ মেঘ-প্রান্তে প্রান্তে রক্ত লেখা।
মনে হলাে সুর কল্যাণ ধ্বনিত হয়ে উঠছে । মনে হল, আমার কল্পনায় যেন ছিল এই ছবিটী, এই সৌন্দর্য্য এছাড়া জগতে আমি কিছু চাইনি, শুধু এই । কলাবতী, তার পারিপার্শ্বিক ছবিটী এই চরম পূর্ণতার । মনে হলাে লক্ষ শত যুগের মানুষ যা কল্পনা করেছে, যা চিন্তা করেছে তা এই কলাবতীর জীবন যাত্রার মধ্যে আমি দেখতে পেলাম ; দেখার আগেভাগে। দেখলাম হৃদয় নিয়ে বাঁচা আর কিছু নয় । হৃদয়। নিয়ে বাঁচা, প্রতি অনুতে পরমাণুতে..তার আত্মায় আমি বিমুগ্ধ হয়েছিলাম ।দেখলাম ইট সাজিয়ে উনুন হলাে, অন্য মেয়েটী মুখ নীচু করে ফুঁ দিয়ে প্রয়াস পাচ্ছিল আগুন জ্বালবার জ্বাললে আগুন—তাতে গাঢ় মসীলিপ্ত হাঁড়ি চাপালে ।
জিজ্ঞেস করলাম, ওতে কি হবে ? কলাবতী বললে, ওতে ! ওতে চা হবে... চা !•• তুমি..তুমি চা খাবে...? যদি দয়া কর— দয়া আবার কি...কিন্তু আমরা কেউ থালায় ঘটিতে খাবাে যে... আমিও তাই খাবাে...
আমার রকম সকম দেখে ও একটী হাসির ফোয়ারা হয়ে উঠলাে। বুঝলাম—ভেবেছে কি বিরাট আস্ত পাগল...জীবনে সে কখনও দেখেনি— আর আর মেয়েরা, তারা দৃষ্টি দিয়ে, ভঙ্গি দিয়ে শ্রদ্ধা জানাচ্ছিল, হৃদয় পেতে অতিথি সৎকার করছিল আর সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন দৃষ্টি দিয়ে
আমায় বুঝবার চেষ্টা করছিল। কলাবতীকে বললাম, বাপু এ মােড়া থাক আমি মাটিতে বসি ।।ওরা ত্রস্ত তটস্থ হয়ে অনেক খোঁজার পর খুঁজে আনলে সব চেয়ে যেটী ভাল—জীর্ণ মাদুরটী পাতলে । আমার ইচ্ছে হচ্ছিল লুটীয়ে পড়ি—হৃদয় অকারণে ঝঙ্কৃত হয়ে উঠছিল—অপূৰ্ব অনৈসর্গিক আনন্দের তীব্রতায়...
আমি বসলাম, আমার পাশে একটী ছােট মেয়ে, তারই পাশে একটী বুড়ী, আর সামনে কলাবতী । অন্য তরুণী যত্নে চা প্রস্তুত করছিল। বুড়ী বললে, আমার মত নাকি তার একটী ছেলে আছে, তার বয়েস হবে এক কুড়ি এক কি দুই, কাজ করে আসামে..
তরুণী বললে, অনেকদিন পরে দুধ দিয়ে চা হচ্ছে...
চা এলাে...সসম্মানে চায়ে চুমুক দিতেই নাড়ি বিদ্রোহ করে উঠলাে বমি, এলাে—কি বিশ্রী-রাম রাম তবু হেসে বললাম, চমৎকার..
কলাবতী হাসিবিগলিত বদনে বললে, সব কিছু চমৎকার নিশ্চয়...
খবর নিলাম ওদের আজ কি রান্না হবে । শুনে মনে হলাে ওদের আজ পরম উৎসব। তারপর কলাবতীর সবামী এলাে, তার নাম জীবদয়াল - কাল, সুপুরুষ আমার আগমনে সে খুব খুশী হয়েছে। তার সঙ্গে নানান গল্প হলাে; সে লাইনে কাজ করে । রাত হয়েছে সেটা স্মরণ করিয়ে দিয়ে কলাবতী বললে, বাবু এখন বাড়ী যাও....
কথাটা কানে বাজলাে—ক্ষেপে উঠলাম, ভেবে নেওয়া কারণে, মনে হয়েছিল তারা আমার এই উপস্থিতিটা পছন্দ করছে না..হ্যাঁ যাচ্ছি...
আমি উঠে ধীরে ধীরে পা ফেলে চলতে সুরু করলাম পা ফেলার সূচনায় একবার ঘাড় ফিরিয়ে ওদের দিকে চেয়ে দেখলাম—ওরা হাসাহাসি করছে । চকিতে মনে হলাে, হাসির কেন্দ্র বােধ হয় আমি ! বিশ্রী ভাবে ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলাম, যে সৌন্দৰ্য্য দেখেছিলাম, পৌঁছেছিলাম যে স্তরে নিমেষেই তা কদৰ্য্য রূপ নিলে । নিমেষেই মিথ্যে মনে হলাে তাকে, সেই রূপকে, যে কল্পনা মূর্ত হয়ে উঠেছিল বাস্তবতায় ; নিজের গণ্ডি খানি—ক্ষুদ্রতাকে পেরিয়ে সীমাহীনের মধ্যে পৌঁছে ছিল। ভেবে নেওয়া কারণে প্রকটিত হয়ে উঠলাে ওদের ইতরতা। নিজেকে খানিক ভুলের বশে অপমান করার জন্য ক্ষোভ হলাে।
বাড়ী ফিরে এসে বড় চঞ্চল হয়ে পড়লাম, ইচ্ছে হলাে ধ্বংস করি, ভেঙ্গে ফেলি সব কিছুকে, থাকবে না কিছু টুটে যা সব...নিজের স্তরকে ভাল করে বুঝে দেখলাম ওরা আছে অনেক নীচে। আমার জীবন যাত্রার পন্থা কোথায়—আর ওরা কোথায়...অনেক ব্যবধান...ঠিক করলাম আর যাবাে না, যত মনে হয় ওঁরা হীন—দেখি আর কিছু নয়, বাহিরের রূপটা চোখকে ঘৃণা করবার ইন্ধন যোেগাতে লাগলাে ।একবার মনে হলাে ওই যে দুঘণ্টা ওখানে অতিবাহিত করলাম, তখন আমার চোখের বিলাস ছিল না, তখন কি আমি ছিলাম স্বপ্নে ?
তবে কোন মাদকতায়—কেমন করে সে সময় কাটিয়েছিলাম ! কোথা থেকে অহেতুক, অপ্রয়ােজনীয় অভিমান এসে, ঢেকে ফেললে মন, ভাবলাম, আর যাবাে না; এমনি সে অভিমান, যেন আমি কলাবতীর কত গােপনে, কত কাছের মানুষনিজেকে অন্য ভাবে তৈরী করে নিলাম, সাজপােষাক থিয়েটারে আর সিগারেটে..এরই মধ্যে একদিন সন্ধ্যায় তখন আমি বাড়ীর পথে,ভাবলাম, আমার সঙ্গে কলাবতীর পার্থক্য অনেকখানি..শুধু অনুভবেই তা বুঝা যায় ও যেখানে, আমি তার অনেক পিছিয়ে !
আমি আছি কিছু ভাবনায় আর ভাবনাহীনতায় বেশী, গতদিনকে নিয়ে চলেছি, অতিক্রম করে চলেছি আজ--আর ওই ভাবনা বেশী কিংবা নিভাবনায়...সমতার যায়গায় বাঁচবাে কি করে—কেমন করে পৌছবাে সেখানে যেখানে স্ব’ বলে কথা নেই ?
মনে হলাে, ওরা করছে জীবন যাপন আর আমি জীবন ধারণ—আমি আছি জ্ঞানীহনতার প্রথমে আর ও আছে জ্ঞানের প্রথমেদিন সাতেক পর..বসে আছি নির্জন কক্ষে, মন ছিল কবিতার বইয়ে, এমন সময় দেখি সে, দীর্ঘ আরত লােচন দুটী মেলে চেয়ে আছে চকিত চিত্তে বলে ফেললাম, এই যে...তারপর কথা বলতে গিয়ে ওষ্ঠ শুধু কাঁপতে লাগলাে জীর্ণ পাতার মত, কিছুক্ষণ বাদে বললাম, কেমন আছাে ? তারপর হঠাৎ কি মনে করে ? এমনি..কই আমার বাড়ীতাে আর যাও না ? তুমি তাে আমায় ডাকনি...
ডাকলে কি যেতে নেই... মনে হয়েছিল ! ভেবেছিলাম--তুমি আসবে... কি করে ভাবলে ? এইবার হেসে ফেললে । বললাম—আজ যাবাে হ্যাঁ...সত্যি করে বলতাে কোথায় যাচ্ছিলে ?
ওষুধ আনতে ওষুধ !কেন ?—মনে হলাে, স্বামীর বােধ হয় অসুখ, শুধালাম,-অসুখ কার ? সুবচনীয়ার।
আপনার অচেতনে ভেবেছিলাম ওর স্বামী বুঝি বা কালের কোলে ! আনন্দ নিভে গেলাে। বললাম, চল আমি ডাক্তারি জানি— তুমি যে দেখছি সব জানাে ।
জানলে যে তােমার বিপদে পড়তে হবে, চলাে। দুজনে আবার চলতে সুরু করলাম। আর ওর পাশাপাশি যেতে কেমন সঙ্কোচ দোষ হলাে। ওকে-দেওয়া বােধ গুলাে তখন আমায় মুহূর্তে মুহূর্তে লজ্জিত করে তুলছিল । মনে হলাে, কলাবতী ও যেন একটু এড়িয়ে চলেছে,—সেদিনের মত সে আর সে সরল নয়, এ কথা ভেবে কেন কি জানি ঈষৎ সুখ পেলাম।সুবচনীয়ার অসুখ বিশেষ কিছু নয়। কলাবতীকে একান্তে ডেকে বললাম,“ভীষণ ব্যাধি ! তবে, আমি আছি ভয়ের কারণ নেই—তােমরা প্রত্যেকে একটু সাবধান থেকে বুঝলে ?—ওর মুখ দেখে মনে হলাে আমার কথা, সাবধানে বাণী ওকে যেন স্পর্শ করেনি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম,“চলাে কলাবতী ওষুধ নিয়ে আসবে ?
চলাে। চলাে, লাইনের উপর দিয়ে যাই তাড়াতাড়ি হবে-
আবার আমরা দুজন । দুজনে চলেছি লাইনের উপর দিয়ে, কখনও পাশের সঙ্কীর্ণ পায়ে চলা পথে—তারই মাঝে মাঝে, আমি মাঝে মাঝে চঞ্চল হয়ে পড়ছিলাম, পথ-পাশে ফোটা বনফুল ছিড়তে ছিড়তে চলেছি কানে ভেসে আসছিল কলাবতীর গতিভঙ্গি আর তার সহজ আভরণের শব্দ ; অন্যমনে যেতে যেতে আচমকা আর পায়ে—একটী কাঁটা ফুটে গেলাে। পাশের--কালভার্টের উপর বসে পড়লাম । কাতরকণ্ঠে কলাবতী শুধালে—লেগেছে খুব ?
—তবে বলে কাঁটা তুলবার চেষ্টা করতে লাগলাম—আমার রকম দেখে ও হেসে বললে—ওটা আমার কাজ বলে, সস্নেহে আমার পাখানি নিয়ে সেবা সুনিপুন হাত দিয়ে বার করতে লাগলাে। কাঁটা তােলার সময় ওর মুখের পানে চেয়ে দেখি, ব্যথায় বিধুর—ওর মুখের পরে ছায়া পড়েছে ভৈরবীর নিখাদের, অন্তরে আছে যে অভিমানী সকরুণ সুর, তারই। হঠাৎ তখন কোথা হতে এল আমি অদম্য স্পৃহা, কোন মতে নিজেকে সংযত রাখতে চেষ্টা করলাম—অন্য কথা ভেবে, মনে এলাে ওর কাছে আমার জেনে নেবার যা ছিল ।
দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললে—হাঁটতে পারবে? যদিও হাঁটতে হয়তাে কোন অসুবিধে হতাে না তবু বললাম ব্যথাটা একটু কমে যাক...
পীতসবুজ মাঠ অতিদূর ব্যাপি বিস্তৃত। পশ্চিম গগন দিগন্ত:তখন সূৰ্য্যহারা, রয়ে গেছে শেষের রক্তলেখাটী —যেন পরাজিতের হাসি । জিজ্ঞেস করলাম কলাবতী তােমরা বেশ সুখে আছছা না ?
সুখ... ? হ্যাঁ...সুখ... সে কি...?
আশ্চর্য হয়ে বললাম—সুখ তুমি জানােনা ! অর্থাৎ আমি বলতে চাইছি, আনন্দ বুঝিয়ে বললা— আনন্দ তুমি বােঝ না ? সত্যি আমি কিছুই বুঝতে পারছি না, বিশ্বাস কর ।
আমি যা হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করে ছিলাম, তা কেমন করে ওকে বােঝাবােখানিকটা অভাবের সমস্যার পূরণকে যে আমি সুখ বলি না, সত্যকার আনন্দ—যা আমি বুঝেও বুঝি ; মনে হল আমি কাকে কি জিজ্ঞেস করছি। তােমার মনে কোন সাধ খুসি কিছু নেই, কোন কামনা নেই ? কোন বাসনা নেই– নেই— কিছু না—
অদ্ভুত ঠেকলাে। তবে কোন আনন্দ নিয়ে ও বেঁচে আছে, এই বিংশ শতাব্দীর লােভ যার নেই তাকে মানুষ বলেই গন্য করা যায় না, বাঁচার যে তার কোন ক্রমেই অধিকার নেই!—কেমন ভাবে ও বেঁচে আছে ? ও কি পৌচেছে উৰ্দ্ধতম চেতনায় ! বাসনা নেই,কামনা নেই এ কেমন কথা, অসম্ভব নয় কি? একবার মনে হলাে হয়তাে ওর উর্দ্ধতন কোন মহান পুরুষ, যা আমার প্রশ্ন, তা নিয়ে সাধনা করেছিলেন কলাবতী আজ তা পরিপূর্ণ ভাবে উপভােগ করছে—ভুলেছে শুধু কথাটীআনন্দ ওর স্বভাব। বললাম চলাে। বাড়ীতে এসে ওকে হােমিওপ্যাথি ওষুধের গুলি দিয়ে বললাম পাঁচটা করে দিও.. কলাবতী চলে গেল।
ওদের আচার ব্যবহার দেখে বিমূঢ় হয়ে গিয়েছিলাম সে দিন সুবচনীয়াকে দেখতে গিয়ে শুনলাম, সেই বৃদ্ধা যার ছেলে সুদূর আসামে কাজ করতাে—সে আর নেই। বৃদ্ধা মােটেই বিচলিত হল না, আরাম করে তামাকটি সেজে নিয়ে আরাম করে টানতে টানতে কাঁদতে লাগলাে । তা কান্না নয়—যেন গান—গানের শৈশব ।
বিগত দু হাজার বৎসর পূর্বের সুর তার মধ্যে রনরনিয়ে উঠছে-বৃদ্ধার মাতৃত্ব ছিল গভীর, মাতৃত্ব পুরুষ শুধু কাদের ভিতর বােঝায় তা ছিল তার অন্তরে । শােক বলে কিছু নেই একটু খানি সংস্কার, প্রথমে আমার খুব হাসি পেয়েছিল কিন্তু সাহস সহায় হয়নি—সুবচণীয়ার অসুখ সারলাে—আমার সম্মান বর্ধিত হলাে ; সে আমায় ডাগদার সাব বলে ডাকে, একদা সুবিধে বুঝে তাকে প্রশ্ন করলাম ; আনন্দ কি জানাে ? সে উত্তর করলে, “না।” এরা সত্যি কোন স্তরের ; এরা কি প্রথম যুগের ! না যে মানুষ আছে কল্পনায়,যদি প্রথম মনগত যুগের হবে তাহলে সে লােভ কোথায়—সে অমানরিকতা কোথায় ? কলাবতী এসে বললে, তােমার যে নেমন্তন্ন...। আমার !
হঠাৎ...
ও সুবচনীয়াকে ডাকলে, সুবচনীয়া বললে, আমাদের রীতি, যে অসুখ সারাবে—তাকে আদর করে খাওয়াতে হয় ।
কবে ? কাল। নিমন্ত্রণের দিন, মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে—দূরে আকাশ ঝাপসা হয়ে আছে, আমি বেছে বেছে ঘেঁড়া জামাখানি পরলাম.হয়তাে অগােচরে ভেবেছিলাম—পার্থক্যটা এখানেই কিন্তু জানতাম আসল বিভেদ মনােগত ।পৌছলাম ওখানে, প্রায় আটটার সময় বৃষ্টি থামলাে রান্না চাপলাে তখন। আমি জীবদয়াল নাগেশ্বর। (সুবচনীয়ার স্বামি) বসে বসে গল্প করতে লাগলাম।
এরা যন্ত্রযুগের কলাবতী কি সুবচনীয়ার মত কালচার এদের নেই ; গল্প হলাে নিত্যনৈমিত্তিক জীবন সংগ্রামের ; ক্রমে বিরক্ত হয়ে উঠছিলাম—ওরা বললে, বাবু - মাপ কর—রাত্তির এগারােটায় খাওয়া হলাে। জীবদয়াল আর নাগেশ্বর গেল কাজে—আমি বাড়ী ফিরতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু পারলাম না—মনে হলাে যেন আমি আমার নিজের স্থান অধিকার ছেড়ে চলে যাচ্ছি—কোথায় ? অনতি পরেই ফিরে এলাম। ফিরে এসে লজ্জার সীমা রইল না, তবুও আস্তে আস্তে সুবচনীয়াকে ডেকে শুধলাম, বলতে পারাে কেন এসেছি ?
পারি—তুমি আসনি, তােমায় টেনে এনেছে—তুমি কলাবতীকে ভাল বাসাে না ? কি জানি ? সত্যি আমি জানতাম না যে কলাবতীকে আমি ভালবাসি কিনা ?—তাকে ভালবাসি, —তার জীবন যাত্রার পন্থাটী ভালবাসি ? সুবচনীয়া বললে—ওকে ডেকে দেবাে ?
তখন আমি নিশ্চল নির্বাক। বললে “দাঁড়াও” আমি মানা করতে পারলাম না—ঘন অন্ধকারের মধ্যে আপনাকে হারিয়ে দাঁড়িয়ে আছি, সুবচনীয়া ফিরে এসে বললে—যাও ডাকছে।দ্বিধাহীন, শঙ্কাবিহীন—নির্লজ্জের মত আমি প্রায় গুড়ি মেরে পাতার চালের মধ্যে প্রবেশ করে দেখি দেবী কলাবতী—একটী সুপ্ত কুকুরকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে শুয়ে আছে। ঘনময় পুরােন—বিশ্রী বাষ্প।
বললে—এত রাতে। ক্ষমা করাে । 'হেঁসে বললে—অর্থাৎ আমার উচিত হয়নি এত রাতে আসা।। রাত !বলে তারপর নির্বিকার ভাবে বললে—রাত হয়েছে তাতে কি ক্ষতি ! মানুষ মানুষের কাছে আসবে তাও কি দিন ক্ষণ মেনে ?
এ তােমার ভুল ধারণা কিন্তু—চুপ করে থেকে শুধালে—কেন এলে।কি জানি—কেন যে এলাম তা জানি না।
—কি একটী কথা আমার বলার ছিল, অথচ তা আমার তেমনি করে জানা ছিল না, যে কথাটী বলা যায় গানে, জানা যায় যােগে, তুমি আর আমি এক । আমি শুধু তারই খানিক আভাস দিতে পারি, করুণ কাতরভাবে চেয়ে। স্তব্ধ হয়েছিলাম। হােগলার চালের একটুখানি কেটে জানলা হয়েছে, সেই অবকাশ দিয়ে দেখা যায় শরীময় শূন্যতা। প্রকাশ হয়ে পড়েছে—মেঘব্যথিত তিমিরলজ্জিত তারাভরা খানিক আকাশ। শ্রবণের পথে অনন্ত গানের ধ্বনি—মনে এলাে অনন্ত চেতনা
বললে—সত্যি তুমি জানাে না কেন এসেছাে ?
আধ্যাত্মিক প্রশ্নের মত শােনালাে, বললাম—আমার জানা উচিত ছিল ক্ষমা করাে ।
ছিঃ বারবার ও কথা বলাে না। অনতিপরে বললে,—কিন্তু আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি এই ভেবে যে, তােমার পৃথিবী ছেড়ে, আত্মীয় ছেড়ে, সকল কিছু ছেড়ে হঠাৎ এমনি একটী নিভৃত কোণে মন পড়লাে কেমন করে ?
এটা নিতান্ত স্বাভাবিক কলাবতী তােমার সব কিছু বড় ভাল লেগেছে..হয়তাে যা খুঁজছি। তা পেয়েছি--- কি খুঁজে পেলে ? সুন্দরকে। কি সৌন্দর্য্য তুমি এর থেকে পেলে ?
সব চেয়ে যা সুন্দর, যা ছিল আমার স্বপনে, আমি যাকে অনুভব করেছি হৃদয়ে, রক্তে, ইন্দ্রিয়ের সঙ্গীতে...আমি আনন্দ পেয়েছি...
পাগল ।
হতে পারি যদি তােমার জীবন পাই। আমি মানুষ আমি সম্পূর্ণ হবাে । তুমি নেহাৎ শিশু হয়তাে কিন্তু তুমি আমায় ঠেকিয়ে রাখছে ? আমি আদর্শ চাই, উৰ্দ্ধতম অবস্থা আমার চাই...সত্যি তুমি পাগল..বলে মা যেমন সস্নেহে শিশুর মাথায় হাত বুলিয়ে দেন, ভগবান যেমন পাপীকে তেমনি করে ও আমার মাথায় হাত বুলােত বুলােতে শুধালে—
—তুমি আমায় ভালবাসাে...।
কি জানি, ঠিক বলতে পারি না কলাবতী:-ওই ইতস্ততার মধ্যে আমিও রয়েছি..কিন্তু তােমার পন্থা আমার ভাল লেগেছে, আমি ভালবেসেছি তােমার এই অনাড়ম্বর, সুন্দর স্বাধীন জীবন আমায় স্পর্শ করেছে—ইতরতা দীনতা দানবিকতা নেই, তুমি জীবন পেয়েছাে, তুমি জীবন যাপন করছে—আমি জীবন ধারণ করছি, জান তােমার পন্থাই আমার পন্থা, তােমার জীবনই আমার—এই ভাবে বাঁচতে আমি চাই..এই সমতা আমি চাই তুমি যেমন আনন্দ কি, সুখ কি জান না—আমি ওই না জানার আনন্দ পেতে চাই বলে তার হাত দুটী জড়িয়ে ধরলাম, মরণােম্মুখ যেমন করে তৃণকে অবলম্বন করে--দুজনের নিশ্বাসের দেওয়া নেওয়ায় অনেক লক্ষ গান হলাে রচনা, দুজনের পানে চেয়ে রাত প্রায় কাটলাে।
ফুল ফোটার বাতাস বইছে, ভৈরবী সুরের রেখাবের মাঝে, রাত্র তখন ক্ষণ বিশ্রামে মগ্ন, দুরে সবে-দেখা-দেওয়া আলাে । আমি বিদায় নিলাম ; বললে, পাগল হয়াে না।
সুবচনীয়া তার স্বামীর কাছে বলেছিল আমার ব্যাপারনাগেশ্বর যন্ত্রযুগের মানুষ ; বললে, বাবু জীবদয়ালকে কিছু টাকা দিন—
কি জানি কেন বললাম, কত ? বললে, যা ইচ্ছে আপনার । দিলাম টাকা। যে ভাবনা বাসা বেঁধেছিল—আজকের পৃথিবী থেকে আরাম পাবার জন্যে প্রকাশ পেলাে তা সৌন্দর্য্যের মধ্যে—চাঁদের মধ্যে কলঙ্কের মত—
জীবদয়াল সহসা উধাও হলাে—আমি বিস্মিত হয়ে ভাবলাম এ কি ? কলাবতী কাঁদতে লাগলাে—আমি তাকে স্বান্ত্বনা দিতে লাগলাম।লােকে শেষে ভাবলে, আমার দৃষ্টি ছিল দেহগত কলাবতীর উপর। ধিক্কারে চিত্ত আমার ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলাে। আমি যা ভাবিনি তাই হলাে—আমি চেয়েছিলাম একটুখানি স্থান-হীন অভিসন্ধি, অভিপ্রায়ের কণাটুকু তাে ছিল না মনে।
এ জীবন আমার ভাল লাগে।নি—এই প্রতি মুহূর্তের জন্যে ভাবা জীবন, এর মধ্যে কোন আর্টের লেশ মাত্র নেই—যে মানুষ হবে সে কখনই এ অন্যায় মানতে পারবে না। তারপর বুঝলাম আমি সময় মানিনি—আর একদিন, ওদের পথের পথিক হবাে ভেবে ভেঁড়া জামা পরেছিলাম। স্বপ্ন ভেঙ্গে গেল, কলাবতীকে বললাম, দেশে যাও।
আমার চাওয়া পূর্ণ হবে অনাগত—আশার মানুষের মধ্যে তাদের শিল্পের সৌকুমাৰ্যে—সঙ্গিতে, চিত্রে, কাব্যে। ওরা সবাই গেল—পেছনে পড়ে রইলাে হােগলার ঘর।
সব ছন্নছাড়া হয়ে গেল—শুধু একটুখানি বুদ্ধিতে। কোথায় গেল জীবন যাপন আর জীবন ধারণ ! কলাবতী বললে, চললাম—পাগল হয়াে না।
ট্রেন ছাড়লাে শূন্যময় হয়ে গেলাে হাওড়া স্টেশন—ধীরে ধীরে গঙ্গার ধারে এসে দাঁড়ালাম—গঙ্গার দিকে চেয়ে দেখি তীব্র তার স্রোতের গতি—চোখে সইল না। ক্লান্তজনের মত এ পথ সে পথ করে এলাম সেই হােগলার ঘরের কাছে-দুরন্ত ফাঁকা—উপরে রেল লাইন দূরে লাল আলাে।
আমি আস্তে আস্তে কলাবতীর ঘরে ঢুকে ভিজে জমীর উপর—জুমী আঁকড়ে শুয়ে পড়লাম—মাটীর মধ্যে জড়িয়েছিল পুরোনো দিনের ইতিহাস—আমি গভীর ভাবে অনুভব করলাম-মনে পড়লাে জীবন ধারণ আর জীবন যাপন—আর একদা বরষার দুপুরের—একা ঘরে বসে শােনা-মধুময় ‘মধু ডাকটি। কান পেতে শুনলাম মাটীর মধ্যে প্রবাহিত অনন্ত চেতনা..
আরো নতুন নতুন valobasar Golpo পড়তে ভিজিট করুন
উত্তরমুছুনWWW.VALOBASARGOLPO2.XYZ