নদীর ধারে কুড়ে ঘর। বৃষ্টি পড়ছে অঝােরে। সকাল কি দুপর নাকি সন্ধে বােঝার উপায় নেই। মাঝে মাঝে হাওয়ার দাপটে কনকনে ঠাণ্ডা নমিছে। নদীর ওপার থেকে কে একজন ডাক দিল, পার করে দাও মাঝি। ও মাঝি ভাই, পার করে দাও।
অঝোর বৃষ্টির শব্দ ভেদ করে সেই ডাক কুড়েঘরের লাজো ও রাজীর কানে আসে। রাজী ঘরের ভেতরে থেকে লাজোকে ডেকে বলে, কে ডাকে, এই বাদলায় কে আবার ঘাটে আটকা পড়ল।
বৃষ্টির জন্যে বুড়ো মাঝি নৌকো ছেড়ে ঘরে চলে গেছে। আহা রে বেচারী, বলে লাজোও দুঃখ করতে লাগল।
রাজী ততক্ষণে লাজোর সামনে এসে দাঁড়াল। ঘরের দরোজার মুখে দাঁড়িয়ে কান পেতে শুনল ডাকটা চেনাজানা কিনা। কিন্তু ভারী বৃষ্টির জন্যে লােকটির গলা চিনতে পারল না। রাজীর স্বামী মতি গরু জোড়া নিয়ে গেছে কাঁধে-লাঙলে পরের জমিতে চাষ দিতে। মতি মাঝে মাঝে পরের জমিতে গরু নিয়ে মজুর খাটতে যায়। তাতে একবেলায় চল্লিশ টাকা পায়। তবে পুরােদিন খাটে না, গায়ে-গতরে সারাদিন খাটা খুব কঠিন। শরীরে রস-কষ কিছুই আর থাকে না।
আবার সেই করুণ ডাক শোনা যায়, মাঝি ভাই, পার করে দাও। রাজীর খুব কষ্ট হতে লাগল।বুড়ো মাঝি নৌকো ছেড়ে ঘরে বসে আছে, পাহাড়ী ঢল নেমেছে নদীতে, ঠাণ্ডা ঘোলা পানি খলখল করে ছুটছে। মাঝে মাঝে পাড় ভাঙার শব্দও শোনা যায়। কে তাকে পার করবে এখন?
লাকড়ি ও খড়কুটো ভেসে যায় স্রোতের টানে। কূল-ভাঙা গাছপালা, পাখির বাসা এবং গাছ ব্যবসায়ীর চেরাই করা বড় বড় টুকরাে গাছও ভেসে যায়। পথেঘাটে একটি লোকও দেখা যায় না। দু দিন ধরে সমানে বৃষ্টি ঝরছে। বিলে পানি জমে গেছে, নদীর পানিও কূল ছুই ছুই করছে।
রাজী ডাকল, ও লাজো, যা না, নৌকোটা নিয়ে ওকে তুলে আন না বােন !
নদীর স্রোতকে আমার বড় ভয়, ভাঙনকেও ভয়। এরকম বৃষ্টিতে অামার হৃদপিণ্ডের পড়ি ভাঙতে থাকে ঝপাং ঝপাং। মনে হয় ভাঙতে ভাঙতে একসময় সব শেষ হয়ে যাবে, আমি মরে যাব, নদীর কূলও ভাঙতে ভাঙতে দরিয়া হয়ে যাবে।
রাজী বলল, সেদিন কেন বুঝলি না কেন তাহলে অমন করে সুরুজের বুকে ছুটে গেলি। তুই আসলে সুরুজকেই ভালোবাসিস। ভালোবাসার অমন কাঙাল আমার দেওরটা তোর জন্যে আজ ঘর ছাড়া। ও কত না তোকে ভালোবাসতো। ওর আবেগের কোনো দামই দিলি না তুই।
আমিও তো ওকে আজো ভালোবাসি। ওর জন্যে পাঁচ-পাঁচটি বছর অপেক্ষা করে আছি। ঘর থেকে বের হই না। বাপের বাড়ি থেকে নিতে অাসলেও যাই না। অপেক্ষা করে আছি কবে সে আসিবে। পাছে এসে অামাকে না পায় সেই ভয়ে কোথাও যেতে পারি না।—বলতে বলতে লাজো মুখ ফিরিয়ে নিল, মুখে আঁচল চাপা দিল। আর কি কি বলল আঁচিল ও বৃষ্টির শব্দের জন্যে শোনা গেল না।
এমন সময় আবার ডাক শোনা গেল। রাজী ছেলেকে বকা দিল, বাদল বাইরে কি করছিস ? বৃষ্টিতে ভিজিস না। ভিজলে পিটুনি খাবি।
বাদল বারান্দা থেকে চিৎকার করে বলল, বসে বসে বৃষ্টির খেলা দেখছি। মা দেখে যাও, পানিতে উঠোন ভরে গেছে। পিপড়েগুলো দলামোচা হয়ে ভাসছে। বোধহয় বান হবে।
মা রাজী বলল, অপয়া কথা বলিস না। এমনিতে চলে না, বান হলে উপোস করে মরতে হবে। লােকটা আবার ডাক দিল। ঠাণ্ডায় ওর গলাও কেঁপে গেল মনে হয়। এমন সময় মতি গরু জোড়া গোয়ালে বেঁধে উঠোনে এসে দাঁড়াল। ডাকাডাকি করে সোরগোল ফেলে দিল। মাথার বড় টোকা খুলে, লাঙল-জোয়াল দাওয়ায় রেখে, কাঁপতে কাঁপতে বলল, লুঙ্গিটা দে বউ।
বাদল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বকবক করতে লাগল। রাজী লুঙ্গি নিয়ে বেরিয়ে এসে বলল, নদীর ওপারে কে যেন আটকা পড়েছে, যাও না নৌকোটা নিয়ে, বেচারী অনেকক্ষণ ধরে ডাকছে। লাজো ঘরের ভেতর ছটফট করতে লাগল, ভাবল, যদি জামাল হয়। আবার ভাবল জামালের গলা তো সে চিনবে।
একশো বছর পরে ফিরে এলেও ওর গলা সে চিনতে পারবে। সুরুজ হলেও চিনবে বৈকি! জামালকে সে ভালোবেসে বিয়ে করেছে। ভালােবাসা সব সময় লাজোর বুকে টগবগ করে। সুরুজকে দেখলেও বুকের ভেতর তোলপাড় ওঠে, কিন্তু জামাল...হ্যা, জামাল তার প্রথম ভালোবাসা।
মতি শীতে কাঁপতে কাঁপতে বিরক্ত হয়ে বলল, মরুক গে। বাপের বেটা হলে সঁতরে আসতে পারে না? না যদি পারে বউয়ের আঁচল ধরে ঘরে বসে না থেকে বেরিয়েছে কেন?
এমন সময় লাজো মাথায় আঁচল দিয়ে সামনে এসে দাঁড়াল। মুখে। কিছু না বলে ছলছল তাকিয়ে রইল। নীরবে অনেক কথা বলে নিল। বাদল বলে উঠল, বাবা, আমিও যাব। চলো, আমিও যাই তােমার সঙ্গে। যদি জামাল কাকু হয়?
রাজী তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ঠাণ্ডা লাগিয়ে জ্বর বঁধলে তবেই তোর শান্তি। যা তো দেখি, ঠ্যাং ভেঙে দেব।
জামালের কথায় মতির বুকটা ধক করে উঠল। কতদিন ছােট ভাইটিকে দেখে না, কোলে-পিঠে করে তাকে মানুষ করেছে, কাজ শিখিয়েছে ঢাষবাসের, নিজের হাতে বিয়ে দিয়ে সংসারী করেছে, সে ভাই অজি বউয়ের জন্যে অভিমান করে ঘরছাড়া, বেচারী লাজোর ওপর সব দোষ দিতেও পারে না। নষ্টের মূল তো সুরুজ, বন্ধু হয়ে সে বন্ধুর বউয়ের দিকে হাত বাড়ায় কী করে! ভাবতে ভাবতে মতি বলল, বৈঠাটা দে।
তাহলে দেখি কোন মেয়েছেলে কাঁদছে। জামাল যদি হয় তো দুটো থাপর দিয়ে কান ধরে নিয়ে আসি। অন্য কেউ হলে দুটো কথা শুনিয়ে দেব। লাজো তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে মুখ-চোখ মুছতে লাগল ।
টোকা মাথায় দিয়ে বৈঠা হাতে মতি তেমনি চলে গেল। নদীর কূল ঘেঁষে ঘর, আম কাঠাল ও মাদারের ঘন সারির জন্য নদী দেখা যায় না বলে দূরে মনে হয়, কলকল শব্দটা ঠিকই শোনা যায়। বছর দুয়েক হল এদিকে পাড় ভাঙছে না, তা না হলে কবেই ভিটেমাটি নদীতে ভেসে যেত। পাড়ে গিয়ে মতি গলা ফাটিয়ে ডাক দিল, কে ওখানে, এখনাে কি বেঁচে আছি, নাকি মরেই গেলে। সঙ্গে সঙ্গে ওপার থেকে সাড়া দিল, পার করো মাঝি ভাই, ঠাণ্ডায় মরে। কথা শেষ না হতেই বৃষ্টি ও হাওয়ার ঝাপটায় অসমাপ্ত কথাগুলো একদিকে ধুয়ে-মুছে সাফ করে নিয়ে গেল।
দূরে কোথায় বাজ পড়ল, একটা কুকুর কেঁদে উঠল পাশের কোনো বাড়ি থেকে, ব্যাঙগুলো বাজ পড়ার শব্দে একটু থেমে আবার একঘেয়ে ডাকতে লাগল আর আগের মতাে বৃষ্টির শব্দ একটানা তো চলছেই। নদীতে ঢেউ, স্রোতের কোলাকুলি, গাছপালার ডাল এ-ওর গায়ে পড়ে কাকুতিমিনতি করছে। অথবা ঝগড়া করছে, একের কথা অন্যকে বোঝাতে চেষ্টা করছে, অথবা একজন বলে অমার কথা অগে, আরেকজন বলে আমার কথা আগে শোন—হাওয়া না উঠলে ওরা কখনাে একে অন্যের সঙ্গে মারামারি ঝাপাঝাপি করে না।
নদীর বুকও অমন ওঠানামা করে না, কূলও বুক ফার্টিয়ে নদীর বুকে আছড়ে পড়ে না। আজ কাল পরশু কতদিনের জমা ব্যথা ওরা বলাবলি করছে, কতদিনের রুদ্ধ আবেগ এলোপাতাড়ি বেরিয়ে আসছে'তখন মতি বৈঠা হাতে নৌকোয় উঠে বসল। শেকলটা খুলে নিল, স্রোতের টানে নৌকো ঘুরে যেতে চায়। পাহাড় থেকে নামা এক রোখী ঢল, চুলছেড়া তার স্রোত।
ঘাট থেকে কিছু দৃর উজানে গিয়ে পাড়ি দিল মতি। স্রোতের টানে অনেকখানি নিচে গিয়ে ওপারে পেছিল। ভিজতে ভিজতে নৌকের কাছে এসে দাঁড়াল সুরুজ। তাকে দেখেই গজে উঠল মতি। কোথা থেকে এলি আবার, তোর মুখ দেখতে চাই না, তাের জন্যে আমার ভাই অজি ঘরছাড়া, আর তুইকিনা ঘাটে এসে ডাকাডাকি করছিস। দূর হয়ে যা, আমার চোখের সামনে থেকে চলে যা। সুরুজ মিনতি করে বলল, আগে আমার কথা শোনো, আমি অনেক দূর থেকে আসছি, কত জায়গা ঘুরলাম, কত মানুষের কাছে গেলাম, শেষ পর্যন্ত ওর দেখা পেলাম।জামালের দেখা পেয়েছি। সে আমাকে ভুল বুঝে দূরে সরে রইল। আমি কত করে বোঝালাম। সে বুঝেও বুঝতে চায় না। সেও তোমার মতো দূর দূর করে তাড়িয়ে দিল ।
জামালকে পেয়েছে শুনে মতি একটু নরম হল। উৎসাহী হয়ে তার কথা আরো কিছু শুনতে চাইল। তার একমাত্র ভাই, মা মরার সময় ওর হাতে তুলে দিয়ে গিয়েছিল। বাবা মরার সময় তো দু জনেই ছোট ছিল। মা তাদের বড় করেছে। মাত্র দু বিঘে জমি আর ভিটেটুকু এখনাে আছে। দিনরাত পরিশ্রম করে মতি ও জামাল নিজেদের পায়ে দাঁড়িয়েছে, আর সুখের দেখা পেতে না পেতেই সামনে এসে দাঁড়াল সুরুজ। জামালের বন্ধু। এক প্রাণ দুই হৃদয়।
সেই সুরুজ লাজোকে ভালােবাসলো কি করে ? অথবা লাজোই সুরুজকে চেয়ে বসল, সুরুজ মিনতি করে বলল, দোহাই তোমার ভাই, অামাকে পার করে দাও, না হয় এই ঠাণ্ডায় মরে যাব। তুমিও তো শীতে কাঁপছ। মতি চুপচাপ শুনল শুধু। সত্যিই সেও ঠক ঠক কাঁপছে। গায়ে হূল ফুটছে। বেশিক্ষণ এই কাঁপুনি সহ্য করা সম্ভব হবে না।
সে আর কিছু না বলে নৌকো কূলে ভিড়িয়ে দিল। সুরুজও এক লাফে উঠে লগি মেরে নৌকা উজানে নিয়ে চলল। অনেকখানি উজানে না গেলে হবে না। চোখের পলকে ছুটছে স্রোত। মতির বুকের ভেতরটা তবুও ধকধক করছে। সে আজ শত্রুকে নিজের হাতে বর্ম দিয়ে সাজিয়ে তুলছে, নৌকোয় তুলে পার করতে যাচ্ছে। সাজোর সামনে নিয়ে যাবে তাকে। সব কথা শুনবে, ঘরে নিয়ে যাবে, লাজোর সামনে নিয়ে গিয়ে সব কথা শুনবে?
নদী পাড়ি দিল ওরা। ঘাটে গিয়ে নামল। দুজনেরই তখন এক চিন্তা, উষ্ণতা চাই, আগুন চাই। কোনো মতে নৌকা বেঁধে কোনো দিকে না তাকিয়ে কাঁপতে কাঁপতে এক সুত্র বাঁধা পড়ে গেল ওরা। মতি একবারও পিছন ফিরে তাকাল না। দু জনেই যখন দাওয়ায়।
উঠল তখন কারো মুখে কোনো কথা নেই। রাজী থমকে দাঁড়িয়ে ভাবল, চিৎকার করে তাড়িয়ে দেবে সুরুজকে। আবার এসেছে বন্ধু বেশে !
কিন্তু ওদের দুজনের অবস্থা দেখে ঘর থেকে তাড়াতাড়ি দুটো লুঙ্গি আর গামছা বের করে দিল। বাক্স খুলে সুরুজের জন্য একটা শার্ট ও খদ্দরের চাদর বের করল। দাওয়া ভিজিয়ে একটা একটা করে কাপড় নিঙড়ে বারান্দায় টাঙানো বাঁশের ওপর শুকোতে দিল। তারপর ওরা যখন ঘরে ঢুকল তখন ওদের চেহারা ভেজা ও ফ্যাকাশে, ঠাণ্ডা লেগে জ্বর উঠলে যেমন কাপে তেমনি কাঁপছে। মাটির মালসায় আগুন এনে দিল লাজো।
বুকের ভেতরটা ধকধক করে একেবারে থেমে যাবে মনে হল। স্পর্শ নেই কথা নেই তবুও লাজোর শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেল। নেচে নেচে বয়ে চলল সেই বিদ্যুৎ, তার শুরুও নেই শেষও নেই। বাইরে বৃষ্টি ও একটানা ঝমঝম করেছে দুদিন ধরে, তার শেষ কোথায় যেমন কেউ জানে না তেমনি লাজোর অবশ বুকের পাশ থেকে বেরিয়ে যাওয়া হাত দুটো আপনা-আপনি ওদের সামনে অাগুনের মালসাটা রাখল। কিছুই বলল না সে।
চোখ দুটো তুলে তাকাতেই চোখাচোখি হয়ে গৈল। আর অমনি শরীরে তড়িৎ তরঙ্গটা টেউ তুলে, আরেক দফা ভেঙ পড়ে ধাক্কা দিল। মনে মনে ভাজা বলল, কেন এলে, আবার কেন এলে ? অজ পাঁচ বছর জামাল ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেছে। এখনো আশায় পথ চেয়ে আছি। প্রতিদিন পথ চেয়ে থাকি কবে এসে ডাকবে, লাজী:-আমার লাজো। এত অভিমান, এত ঈৰ্য্য? নাকি ঘৃণা! কেন ঈর্ষা, কেন ঘৃণা, আমি তো তোমারই জামাল।
রান্নাঘরে গেল লাজো। পা দুটি অবশ, বুক ভারী, মাথা ঘুরছে। রাজী বলল, আমি জানি ওকে দেখলে তুই কাহিল হয়ে পড়িস, সেদিনও এমনি ঝড়-বাদলা ছিল। না, আরো বেশি। বানে চারদিক ডুবে গিয়েছিল। দু’ ভাই গিয়েছিল নৌকোর খোঁজে।
লাজো ওর মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বলল, তুই তখন বিছানায় কাতরাচ্ছিস প্রসব বেদনায়, আমি একবার ঘর আরেকবার দাওয়ায়। গিয়ে দাঁড়াচ্ছিলাম। উঠোন জুবে ঘরের দাওয়ায় উঠতে আর মাত্র এক হাত বাকি। ওরা দু ভাই গেছে যেখানে নৌকো পায় নিয়ে আসতে। একজন দাইয়েরও দরকার। মানানা দাই আশ্রয় নিয়েছে স্কুলে, ওর নাতির সঙ্গে থাকে তো ! নাতি আর নাতবউ আর তিন ছেলে, মানানা দাইয়ের বড় হাত যশ। ওর হাতের কাটা নাই পাঁচ দিনে শুকিয়ে সাফ, চার দিনে কালো গুটি হয়ে সাতদিন যেতেই ঝড়ে পড়ে যায়।
রাজী আবার নিজে নিজে বলল, এখন এসব কথা থাক, চায়ের পানি তুলেছি, দু’বাটি রঙ চা দিয়ে আয়, এক চুমুক খেলেই গা গরম হয়ে যাবে।
বাদল একবার রান্নাঘর আবার সুরুজের কাছে গিয়ে কথা শুনছে। জামাল কাকু কেমন আছে, বারবার তার গল্প শোনাতে বলছে। কবে আসবে, কেন এতদিন অাসে না কত প্রশ্ন। মতি ছেলেকে একবার জোরে ধমক দিল। যা, দাওয়ায় বসে বসে বৃষ্টি দেখ গে। উঠোনে নৌকো ভাসিয়েছে কে? শাদা কাগজ দিয়ে নৌকো বানাতে হয় ? কয়টা খাতা শেষ করেছিস? লাট সাহেবের মতো শাদা কাগজ দিয়ে নৌকো বানাচ্ছিস।
সুরুজ ওকে কাছে টেনে নিল, অদির করে বলল, হ্যা আসবে, অনেক টাকা-পয়সা নিয়ে তবেই আসবে। তোর কথা কত জিজ্ঞেস করেছে ! বাদল বলল, কাকু ভালো না, কাকীকে দেখে না, কোনো খবর দেয় না। মতি অাবার ধমক দিয়ে থামিয়ে দিল, যা এখান থেকে মা বলছি, নইলে ঠ্যাং ভেঙে দেব।
সুরুজ বলল, আমি তো ওর কাছে সব স্বীকার করেছি। আমি জানি লাজো ওকে ভালোবাসে। আমাকে নয়। ভালোবাসা তো কত রকম হয়। মাও ছেলেকে ভালোবাসে, একটি মেয়েও একটি যুবককে ভালোবাসে, বোন ভালোবাসে ভাইকে। যুবকের ভালোবাসা একরকম, আবার সেই যুবক তার বোনকে ভালোবাসে, তার বড় ভায়ের বৌকে ভালোবাসে, মাসিপিসিকে ভালোবাসে, বন্ধুর পত্নীকে ভালোবাসে। ভালোবাসার কত রকম ফের, কত রূপ।
জামালের বৌকে আমি শ্রদ্ধা করি।
শ্রদ্ধার আরেক নাম ভালোবাসা, যাকে ভালোবাসে, তাকে শ্রদ্ধা করতে হয়।
না, লাজোর প্রতি অন্যায় দোষ দিও না।
লাজোকে দেখে এইমাত্র কেঁপে উঠেছিস তুই।
এসময় লাজো আরেকটা মালসা হাতে ঘরে ঢুকল। সুরুজের কাছাকাছি রেখে দিতেই সুরুজ টেনে নিল। হাতে হাত লেগে গেল বুঝি! লাজো চলে গেল।
চুপচাপ চারদিক, শুধু ব্যাঙ ডাকছে। মতি বলল, মালসায় ওর ছোঁয়া আছে, হাত বুলিয়ে তুলে নে। মিথ্যাবাদী কোথাকার। সুরুজ চিৎকার করে বলল, মতি ভাই, দোহাই তোমার।।
মেয়েদের একজনের থাকতে দেওয়াই ভালাে, নইলে ঘর আর বার দুই-ই নষ্ট হয়। তুই যদি ওকে কেড়ে নিয়ে যাসতো দেখবি সে আর তোর নয়...সে যে আসলে জামালের তখন বুঝতে পারবে লাজো, তুইও টের পাবি। এখন তাের মনে হচ্ছে লাজো তোর। সে মনে করছে পৃথিবীতে তুই ছাড়া পুরুষ মানুষ নেই—এরকমই মনে হয়।
মতি ভাই ।
আমি সত্যি কথাই বলছি। তবে ওকে যদি ভুলে থাকতে দিস তো সব ঠিক হয়ে যাবে। তুই ওকে বলে যা জামাল কবে আসবে। নিজের মুখে বলে যা জামাল ওকে কতখানি ভালোবাসে।
সুরুজ সমীহ ভরে বলল, মনকে নিয়ে আর কত পারি! জামালকে ফিরিয়ে আনতেই তো এই এক বছর ধরে ঘুরলাম। সেও তোমার মতো আমাকে দুষছে, আমাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছে। আমার কোনাে কথাই বিশ্বাস করতে চায় না। আমার কোনো অনুরোধ সে রাখে নি।
রাজী লাজোকে চায়ের বাটি দুটি নিয়ে যেতে বলল। লাজো নিজেকে ভয় পায়, নিজের অাবেগক ভয় পায়, ভাগ্যকে নিয়ে লড়তে সাহস পায় না। কেন এই ভয়? সামনে তো মতি আছে।
কেন সে নিজেকে সহজ করে নিতে পারে না? সহজ হবার জন্যেই সে আগুনের মলিসা নিয়ে গিয়েছিল। এইতাে সুযােগ, নিজেকে সবকিছুর ওপরে তুলে সে বলে দিতে পারে, অামি জামালের বিবাহিতা স্ত্রী। রাজীর কথার উত্তরে বলল, ওর সামনে গেলে সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়, নিজেকে সামলাতে পারি না।
রাজী ঠাট্টা করে বলল, লোকজনের সামনে আলিঙ্গন করবি নাকি! কি নির্লজ্জ রে বাবা! এমন মেয়ে বাপের জন্মেও দেখি নি।
দোহাই তোর, অমন করে বলিস না। তুই যা।
রাজী এবার গম্ভীর হয়ে বলল, সুরুজকে ভালোবাসার কিছুই নেই। তাের জন্যে জামাল কী না করেছে। বড় ভায়ের সঙ্গে ঝগড়া করেছে, অথচ সে কোনােদিন মুখ তুলে কথা বলত না। পাড়ার লোকজনের বিরােধিতা সত্ত্বেও পাগল হয়ে ছুটে গেছে তোর কাছে।
শেষ পর্যন্ত ভায়ের মত আদায় করে তােকে ঘরে তুলেছে। বিয়েতে তোর ভাসুর সাধ্যমতাে। করেছে। জমি পর্যন্ত বন্ধক দিয়েছে। সে-জমি আবার ফিরিয়ে আনতে দু’ ভাই কত হাড়ভাঙা খাটুনিই না খেটেছে। আর তুই কিনা মজে গেলি ওর বন্ধুকে দেখে?
লাজো একবার ভাবল কিছুই বলবে না। কি হবে পুরোনাে কথা ভেবে, কি হবে বলে! এইতো মাত্র সেদিনের কথা। থৈ-থৈ করছে বানের জল। নৌকো নিয়ে দেখতে এল সুরুজ। দু’ ভাই তখন নৌকো খুজতে গেছে পানি সাঁতারে। নৌকো বেঁধে সুরুজ যখন দাওয়ায় উঠল তখন তার সারা গা ভেজা। ভেজা কাপড়ের নিচে তার পেশীগুলো লাফিয়ে লাফিয়ে নাচছে। লাজোকে দেখে প্রথমে জামালের কথা জিজ্ঞেস করেছিল। তাড়াতাড়ি ঘর থেকে শুকনো গামছা এনে ওর হাতে দিতেই ছোঁয়া লেগে গেল অঙুিলের সঙ্গে।
বিদ্যুৎ শিহরণ সেই যে খেলে গেল তা আর থামল না । এখনো সেই ঢেউ চলছে সারা শরীরে। লাজো শুধু বলল, অজি বৃষ্টির দাপাদাপির সঙ্গে আরো বেশি উথাল-পাথাল করছে সেই স্মৃতি, জোর করে রুখে রাখতে পারি না, থামিয়ে দিতে চাইছি বলে বিদ্রোহ করছে মন।
রাজী বলল, কি বলছিস তুই? এতদূর? কিন্তু ঐ পর্যন্তই। আমি তো আর বেশি কিছু চাই নি। জামালকে আমি ভালোবাসি, ওর জন্যে পাঁচ-পাঁচটি বছর অপেক্ষা করে আছি। চিরদিন থাকব।
রাজী হতাশ হয়ে বলল, কে জানে সুরুজের মাঝে কি অাছে। আমি তো আলাদা কিছুই দেখি না। তুই কি করে দেখবি? তাের চোখ তো মতি ভায়ের চোখে ধাঁধা পড়ে অাছে। ছেলে আছে। তুইও তো বাপের কাছে গো ধরে বসেছিলি ওকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করবি না বলে।
মেয়েদের একজনের হয়ে থাকাই ভালো। দু' নৌকোয় পা দিয়ে সংসার হয় না, দুই পুরুষের কাছে মন দিয়ে জীবন চালান যায় না।
বাইরে তেমনি বৃষ্টি হচ্ছে। বাদল দাওয়ায় বসে বসে বৃষ্টির গান ও ছড়া কাটছে। মতি ও সুরুজ চুপচাপ করে অাছে। লাজো শুধু বলল, সেদিন ঢেউয়ের আঘাতে থেকে নিজেকে বাঁচাতে চেয়েছি, সরিয়ে কূলের কাছে নিয়ে এসেছি, তোর কাছে ছুটে গেছি, কিন্তু পাল খাটানাে নৌকো তো আর বাতাস থেকে সরিয়ে নেয়া যায় না, নিজের ইচ্ছে মতো চালাতে হলে কৌশল করতে হয়। পাল নামিয়ে নিলেও হাওয়ার দাপট থেকে রক্ষা পাওয়া মুশকিল।
লাজোর মন তখন ঐ পালের মতাে হাওয়ায় বুক ফুলিয়ে তরতর ছুটে চলেছে। সেদিন থেকেই লাজোর ভয়। মনকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বাগে আনতে না পেরে জামালের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। কাঁপতে কাঁপতে জ্বর এসে গেল তার। তখন জামাল জানতে চেয়ে বলেছিল, কি হয়েছে, কেউ কিছু বসেছে, পাড়া-পড়শি, রাজী ভাবী? লাজো সব খুলে বলল। হাতের স্পর্শে থেকে লুঙ্গি ও শার্ট দেওয়া, ওর ভেজা কাপড় শুকোতে দেওয়া, তারপর রাজীকে ধরাধরি করে নৌকার গলুয়ের নিচে নেওয়া, সব। আবার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিতে বারবার ঘরে ঢোকা, তখন কী যে হয়ে গেল লাজোর। বাক্সে-কাপড় তুলতে গিয়ে সুরুজের সঙ্গে মাথায় ঠোকাঠুকি হয়ে গেল।
মাথায় শিং গজাবে বলে আবার যখন টোকা। খেতে গেল তখন লাজে। আর পারল না, সুরুজের বুকে মাথা রেখে বসে পড়ল। সুরুজ হাত বুলিয়ে দিল ওর পিঠে। হাত তাে নয় যেন সোনার কাঠি রুপোর কাঠি। একে একে জেগে উঠল প্রতিটি রােমকূপ, প্রতিটি কোষ। শরীরের বাঁধন থেকে তো অনুভূতি বেরিয়ে যেতে পারে না যতক্ষণ না তার নিবৃত্তি হয়। আস্তে আস্তে লাজোর বুক থেকে সুরুজের শরীরে সেই কাপুনি পার হচ্ছে, একটু একটু সুস্থ হচ্ছে সে।
বাটিতে চা ঢালতে ঢালতে রাজী বুঝল লাজোকে চা দিতে পাঠান যাবে না। তাছাড়া জামাল কেমন আছে, কী করছে জানা দরকার। এতদিন যখন বাড়িতে আসে নি আর কোনোদিন কি অাসবে? অার এসেও যদি থাকে সুরুজ এসেছে বা লাজোর এসব কথা শুনলে আবার কি চলে যাবে না চিরদিনের মতো? অথচ লাজোকে রেখে দ্বিতীয় বিয়ে করবে না, তালাকও দেবে না। সে এটুকু বুঝল—লাজোর।
কপাল পুড়েছে, নিজেদের সুখও নষ্ট হয়ে গেছে। কী কুক্ষণেই না সেদিন সুরুজ নৌকো নিয়ে এল। একটু দেরিতে এলেই তাে হত। জামাল নৌকো বেঁধে ঘরে ঢুকল। কেন যে ওর আসার শব্দ লাজো একটুও টের পেল না, বৃষ্টি ও বাজবিজুরী যে কেন অমন করে তখন ঝাপিয়ে নামল হয়তাে নিয়তির খেলায় এই যােগসাজস হয়েছে। নইলে সুরুজের সঙ্গে মাথা ঠোকাঠুকিই বা কেন হবে, কেনই বা ঠিক তখন জামাল এসে সব দেখতে পেল ।
রাজী বার্টি দুটো নিয়ে গেল। ওরা দু জন তখন চুপচাপ বসে অাছে, কারো মুখে কোনো কথা নেই। সেও কিছু বলার সাহস পেল না, দু-একবার এদিক ওদিক তাকিয়ে থাও বলে চলে এল।
লাজো আগের কথার খেই ধরে বলল, ও এসে দেখল, দেখেই চিৎকার করে উঠল, সুরুজকে কিছু না বলে আমার দিকে এগিয়ে এসে এক গণ্ডুসে পান করার মতো দু হাত ধরে যা বলল সেসব শোনার পরও কেন আমি বেঁচে আছি জানি না। তারপর একসময় নিজে নিজে থেমে আমাকে বলল, যা, এই মুহর্তে আমার সামনে থেকে বেরিয়ে যা ওর নৌকোয় চড়ে। ততক্ষণে মতি ভাইও ঘরে ঢুকছে। তারপর দু ভাই মিলে তোকে সুরুজের নৌকো থেকে নিজেদের নৌকোয় তুলল। ওর নৌকো খালি করে দিয়ে আমাকে বলল, যা আমার চোখের সামনে থেকে যেখানে ইচ্ছে দু জনে চলে যা। মতি ভাই ওকে থামাল। তুইও বলিল, আমার কোনাে দোষ নেই, সব দোষ সুরুজের।
রাজী সেই অতীতে ফিরে গিয়ে ভাবল, কেন তার অমন করে পৃথিবীর জোড়া প্রসব বেদনা শুরু হল, কেন লাজোকে চোখে চোখে রাখতে পারল না।
মাথা নিচু করে সুরুজ নৌকো নিয়ে চলে গেল। এক লহমায় কূলভাঙা মাটি নদীতে যেমন পড়ে যায়, তারপর যেমন কিছুক্ষণের জন্য শান্তি ও নীরবতা নেমে আসে তেমনি লাজোর বুক হাল্কা হয়ে উঠল। কিন্তু সেও ক্ষণিকের জন্যে, আবার কুলের মাটি তলে তলে ক্ষয় হতে থাকে এবং একটু পরেই আবার ঝপাৎ করে মাটির আরেকটা চাঙর ধসে পড়বে।
স্কুলের কামরায় সেদিন রাজীর কোলে এল বাদল। সুখের নিঃশ্বাস ফেলল রাজী। সেই দুর্যোগের ভেতর বাদল সবার মনের মধ্যে সুখের সেতু গড়ে তুলল।
সারারাত দাই মানানা জেগে রইল, সাই মিলে কত কথা, লাজো যেন হারানো সুখ খুঁজে পেল।আশপাশের লোকজন সারাক্ষণ খোঁজ নিচ্ছে, সাহায্য করতে ছুটে আসছে, মোট কথা বানে আশ্রয় নেওয়া লোকগুলোর মনে আনন্দের জোয়ার এনে দিয়েছে বাদল। রাজীও নিজেকে ভাগ্যবতী মনে করে সুখে চোখ খুলছে ও বাঁধছে।
আর এদিকে?
হা, বাদল ও রাজীকে দেখে জামাল সেই খুশির সকালে কী একটা ছল করে যে বেরিয়ে গেল আর এল না। একবার মনে হয়েছে জামাল বুঝি বানের জলে ডুবে মরেছে বা কোনো দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে। কিন্তু সেরকম কিছু যে হয় নি পরে বোঝা গেল। পুরুষ মানুষের রাগ, শুধু তাই নয় প্রতিশােধরও আগুন জ্বলছে। যাওয়ার সময় একটি কথাও বলল না লাজোর সঙ্গে। রাজী বলে, পুরুষ মানুষের জেদ থাকা ভালো, নইলে পৃথিবীতে এত বড় বড় কাজ হত না।
উত্তরে লাজো বলল, আর মেয়েরা বুঝি ঐ জেদের পায়ের নিচে পিষে মরার জন্যে জমেছে ?
তোরই বা বড়াই করার মতাে কি আছে? তুই নিজেই তো নিজের সর্বনাশটা করলি। কেন সুরজের অমন কি আছে ? কী পেয়েছিস একবার বল।
কি করব। মনটা সেদিন অমন ভিজে ফুলে-ফেঁপে উঠল কেন ? কত যত্ন করে মনটাকে বেঁধে রেখেছিলাম, কত সাবধান ছিলাম, কত সতর্কতা! কিন্তু জামাল তো জানত আমি ওরই, একা ওর।
নিজের ঢােখে দেখাকে অবিশ্বাস করবে কি করে? তাছাড়া তার সবচেয়ে আপন বন্ধুকে কিনা তুই ভালােবাসতে গেলি। প্রেমে পুরুষরা অবিশ্বাসকে সহ্য করতে পারে না।
লাজো ফুপিয়ে উঠে বলল, কিন্তু সবাই শুধু বাইরেরটাই দেখল। আমার মনটা একটু কোমল, আমার মন যদি এভাবে তৈরি না হত। তাহলে আমি কি অমন করতাম কখনো? আমার চোখমুখ নাক আলাদাভাবে মাটেই সুন্দর নয়। মনটাও আবেগে ভরা, জন্ম ও তুলা রাশিতে বোধহয়। আমার মুখে যদি বসন্তের দাগ থাকত, যদি খেঁদিপেঁচি হতাম, খোঁড়া হতাম কিংবা এক চোখ কান হত তাহলে কেউ ভালোবাসতে আসত না, আমিও বেঁচে যেতাম। এ অবস্থা হত না।
কিসের সঙ্গে কী কথা অনিছিস। যতসব আজেবাজে কথা। খোড়া হবি কেন ?
লাজো কিছুটা সংশয় আর কিছু দ্বিধা নিয়ে বলল, কে জানে সুরুজের ভালোবাসায় কি আছে ? ও কিছুই জোর করে চায় না। প্রায় নরীবে আর অভিমান ভরে সরে সরে থাকে। একটা কিছু বললেই অমনি মুখ গোমরা করে থাকে, নীরবে মেনে নিয়ে চুপ করে যায়।
সুরুজের সঙ্গে তুই একা দেখা করিস নি ?
না, কখনো না। আমি ভয় পাই আমাকে। ওকে দেখলে দূর থেকে সরে যাই, পাশ দিয়ে নীরবে চলে যাই, সে যখন গরু নিয়ে যায় আমি তাড়াতাড়ি অন্যপথে চলে যাই, ওর চোখের সামনে পড়লেই আমার শরীর কেমন করতে থাকে, মুখ বন্ধ হয়ে যায়, বুকে ঢোল বাজতে থাকে।
ওকে ভয় পাস ?
ওকে নয়, আমার নিজেকে। আমার আবেগকে, আমার নিয়তিকে। জামালকে। ওকে দেখলেই জামাল অামার সামনে এসে চোখ তুলে দাঁড়ায়, শাসায়।
তুই একটা অস্তি পাগলী। তুই যদি জামালকে ভালােবাসিস তো অরি সব ছেড়েছুড়ে দিতে পারিস না কেন?
চা খেয়ে মতি বলল, এবার যা তুই। আর কোনোদিন এ-বাড়ি আর এ-মুখে হবি না। তারপর ছাতাটা সুরুজের হাতে তুলে দিয়ে বলল, কাউকে দিয়ে পাঠিয়ে দিস, তুই আসবি না, খবরদার।
সুরুজ আবার প্রতিবাদ করল, আবার বলল যে সে সব কথা জামালকে জানিয়েছে, ফিরে আসতে বলেছে, ফিরে এলে সব ঠিক হয়ে যাবে এবং জামাল এলে সে গ্রাম ছেড়ে চলে যাবে বলেও জানিয়ে দিয়েছে। কিন্তু মতির এক কথা, সুরুজের জন্যই ওদের জীবন বরবাদ হয়ে গেল।
সুরুজ বলল, আমি তো ইচ্ছে করে কিছু করি নি, জোর করে কারো মনের ওপর হাত দেই নি। আমি...
মতি বলল, আর সাফাই গাইতে হবে না, নেহাৎ চিনতে পারি নি, নইলে ওপার থেকে অনিতেও যেতাম না। মরাই তোর উচিত ছিল।
সুরুজ বলতে চাইল, আমি তো অার একটি কথাও নয়, এখখুনি বেরিয়ে যা, এই মুহর্তে।
লাজো তখন নদীতে চান করতে গেছে। ঝমঝম বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ভাব, একবার যদি জানতে পারতাম জামাল কেমন আছে, আমাকে ছাড়া কী সুখে আছে, কি করছে সে? ক্ষমা করে দিয়ে কেন ফিরে আসে না? ভাবতে ভাবতে উজ্জ্বল অতীত দেখতে পায়, একবার এরকম বৃষ্টিতে দু' জনে নদীতে নেমেছিল, জামাল ডুব দিয়ে ওর পা ধরে টেনে গভীর জলে নিয়ে গিয়েছিল, পা থেকে সারা শরীর ধরে এদিক-ওদিক করে অাবার বুক-জলে টেনে এনে কাঁধে তুলে নিয়েছিল।
জলের একটা আলাদা রহস্য আছে, ডুব দিয়ে একজন আরেকজনকে অবিছা দেখতে পায়, দু' দিক থেকে দু জনে অঙ্ক ছুয়ে দেখতে পারে—স্বপ্নের মতাে মনে হয় তখন সবকিছু। ডুব মেরে একজন আরেকজনকে ডাকলে ঝিমঝিম একটা শব্দ পাওয়া যায়, নিঃশব্দে বসে থাকলে বৃষ্টির ধাতব আওয়াজ শোনা যায়।
আর আজ সুরুজ এল অথচ জামালের কথা জিজ্ঞেস করার উপায় নেই। কোনো মতে একা হয়ে যদি সুরুজের কাছ থেকে জেনে নিতে পারত? উপায় নেই। জামালের ঠিকানা, শরীর কেমন আছে, আগের মতো লাজো লাজো ভাবে কিনা? কতদিন দেখা হয় না, বিরহের পাঁচ বছর কী সহজ কথা, মেয়েটাও যদি বেঁচে থাকত হয়তো তার টানে জামাল ফিরে আসত।
পুরুষ মানুষ দেহের আকর্ষণে ব্যাকুল হয়ে সাড়া দেয়, সন্তানের মায়ায় ঘরে ফিরে আসে । বিয়ের প্রথম বছরটা কী উদ্দাম কেটে গেছে। ঘর-বাড়ি মাতিয়ে রাখত সে, বাজার থেকে সামান্য একটা কিছু হলেও নিয়ে আসত। একটা লেবেনচুষ, এক গজ ফিতে, একটা ছােট্ট ক্লিপ বা আলতা।
আলতা পরাতে সে খুব ভালোবাসতো। কতবার নিজের হাতে আলতা পরিয়ে দিয়েছে। পুরুষ মানুষ মেয়েদের পায়ে হাত দিয়ে আলতা পরিয়ে দিলে কার না লজ্জা করে ? সঙ্গে সঙ্গে গর্বে বুকও ভরে যেত। তারপর লাজো জামালের পা কপালে ঠেকত। স্বামীর পা ধরতে লজ্জা কিসের। মাঝে মাঝে আজো হাঁফিয়ে উঠত, তবুও চাইত, স্বামীর সোহাগ আর দৌরাত্ম সমান কথা। একবার যদি জামালকে পায় তাহলে জিজ্ঞেস করবে, ভুলেই যদি যাবে তেী কেন এত উজাড় করে ভালোবেসেছিলে। মুহর্তের ভুলটুকুই কী সব, সেদিন যা ঘটেছিল সেটাই কী জীবনের সবকিছু!
ভাবতে ভাবতে নদী থেকে উঠে এল। ভিজতে ভিজতে নদীর কূল থেকে ঘাটের পাশের কদম গাছের নিচে ছাতা মাথায় কে দাঁড়িয়ে আছে অনুমান করতে চেষ্টা করল। অবিকল জামাল, জামালের লুঙ্গি শাট গায়ে। মুহর্তের জন্যে লাজো ভুল গেল যে ঐ জামা ঐ লুঙ্গি রাজী বের করে দিয়েছিল সুরুজকে। সেই সুরুজ দাঁড়িয়ে আছে।
ছুটে গেল লাজো, তারপর ছাতার নিচে মুখ বাড়িয়ে যখন দেখল সুরুজকে তখন। সে হু হু কেঁদে দিল। সুরুজও ততক্ষণে ওকে ধরে বোঝাতে লাগল, কেঁদো না, আমি অনেক খুঁজে ওর দেখা পেয়েছি। সব কথা খুলে বলেছি। তোমার কোনো দোষ নেই, কোনো অপরাধ হয় নি তোমার।
অাসলে রাজী ভাবীর কথা ভেবেই তাে তুমি সেদিন ভেঙে পড়েছিল, তোমাকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে হঠাৎ কি যে হয়ে গেল; কেন জিনিসপত্র গােছগাছ করতে তোমার মাথার সঙ্গে ঠোকাঠুকি হয়ে গেল—সবই বুঝি দৈব। নিয়তি এভাবে অামাদের বঞ্চিত করেছিল, সুখ থেকে আমাদের এক জায়গায় নিয়ে দাঁড় করিয়েছিল। আমাদের তো কোনাে দোষ ছিল না, বন্ধুর প্রতি অামার তো কোনাে হিংসে নেই, ঈর্ষাও নেই ।
লাজো ভাবল, কেন সে এভাবে পথের ওপর দাঁড়িয়ে আছে, সেদিনের মতাে আজও কেন বৃষ্টি ও আঁধারে চাপা পড়ে আছে সবকিছু। নদীর কূল ছাপিয়ে উঠছে জল বান। বানের জল উঠে আসতে আর বেশি দেরিও নেই বোধ হয়। ঐ বুঝি সে নৌকো নিয়ে এল, কে যেন নদীতে গান গাইছে,
গান শুনে শুরুজ ভাবল, কে না কে যাচ্ছে। জামাল তো আর অাসবে না। দু দিন আগে সে সাতকানিয়া থেকেও পালিয়েছে। আমার সঙ্গে দেখা হয়েছে বলেই আবার পালাল। আমাকে অবহেলা ও ঘৃনায় পথের ঘাস বানিয়ে ছাড়ল। হায়, যে মানুষ এভাবে পালিয়ে বেড়ায় তাকে কি ধরে আনা যায় ?
ফিরিয়ে এনেও কি লাভ ? সে তো থাকবে না।
লাজো বলল, কি বলেছে সে ? কোনোদিন আসবে না বলেছে? কিন্তু তাকে আসতেই হবে। আমার ভালােবাসার কাছে ফিরে আসতে হবে।
না, সে আর আসবে না। তুমি ওর কথা ভুলে যাও।
অমন করে বলো না। আমাকে আর অমন করে ধুয়ো না। সেদিনের স্পর্শে এখনো মুছে যায় নি, ঢেউ তুলছে এখনো।
সুরুজ বলল, কেন ছায়ার পেছনে ঝুড়ি নিয়ে ছুটবে? পাঁচ-পাঁচটি বছর কেটে গেল, আমার সবকিছু স্বীকার করার পরও যখন সে ক্ষমা করল না আর কেন অপেক্ষা করবে ? আমিও কেন সত্যকে তাড়িয়ে বেড়াব?
আমি ওকে ভয় পাই, আমি নিজের মুখে কিছু কথা বলতে চাই। সুরুজ অস্থির হয়ে বলল, কিসের ভয়, কি কথা বলবে?
লাজো সজাগ হয়ে বলল, ঐ শোনাে, আবার গান গাইছে ? লোকটা নৌকো নিয়ে কূলে ভিড়ছে। আমাদের ঘাটে, ওই বুঝি অসছে।
কখখনো না। সে আসবে না, কোনোদিন আর আসবে না। আসবে, তাকে অাসতেই হবে। জবাব দিয়ে যেতে হবে।
লাজোর মনের ভুল সব সময়ই হয়। ভাবনায় এলোমোলো অার বড় কল্পনাপ্রবণ। সে বলতে লাগল, হা, আমি দেখতে পাচ্ছি সে নৌকো থেকে নামছে, উঠে আসছে কূল বেয়ে রাস্তায়, আর একটু এলেই বাড়ির ঘাটা তারপর পুকুর পাড়। কল্পনার সে ছবি আঁকতে লাগল।
সুন্দর জীবনের আলপনা, সোনালি ভোরের স্বপ্ন একে দেখতে পায়
জামাল আসছে। ওর বুকে বিদ্যুৎ খেলে যায়, তরঙ্গের পর তরঙ্গ ছোটে, ভেঙে পড়ে আর গড়ে ওঠে। সেই ঢেউ উদ্দাম, অনন্ত সেই প্রবাহ---শেষ নেই। ভাবতে ভাবতে সে এগিয়ে যায় সুরুজের দিকে।
সুরুজ বলল, সব ঠিক হয়ে যাবে, সব ভয়ের অবসান হয়ে। লাজো সুরুজের হাতে মাথা ঘষতে ঘষতে শুনতে পায় নিজের বুকে ঢােল বাজছে, নৌকোর বাইচ হচ্ছে, দাঁড় টানছে কেউ জোরে জোরে। মনে মনে বলে, তোমার হাতে কি এমন কোনো দাওয়াই নেই যে এক নিমেশে সব ঠাণ্ডা করে দিতে পারে! কেন পারো না বুকের ঝড় শান্ত করতে, কেন পারো না হৃদপিণ্ডের দাপাদাপি থামাতে ?
সুরুজও নিজের মনে বলে চলল, আজ আমি এসেছি, ওর কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে এসেছি, সে আর ফিরবে না। দ্যাখো, সেদিনের মতাে ঝড় উঠেছে। বাজ পড়ল শুনলে ?
লাজো আরো ভয় পেল। এক মুহর্তে সে ঝাপিয়ে পড়ল ওর বুকে। সুরুজ বলল, এই ঝড় একদিন আমাদের অালাদা করেছে অজি অাবার এক করে দিল।
লাজো আবার ভাবল, ঐ বুঝি জামাল এল, ঐ তার অসির শব্দ, পায়ের শব্দ, গলা খাকারির আওয়াজ। বুকের ওপর থেকে সে মাথা আলগা করল, ছেড়ে দিয়ে দাঁড়াল। সে ঠিক শুনতে পেল জামাল এসেছে। তারপর বলল, ঐ দ্যাখো, ঐ তো এসেছে। তোমার পিছনে।
জামাল বলল, হ্যা আমি জামাল। আমাকে দেখে সতর্ক হওয়ার কি দরকার ?
লাজো যেন অনেক দূর থেকে বলল, জামাল। জামাল তেমনি নিস্পৃহ গলায় বলল, তুমি ওর বুকে মাথা রেখে বলতে পারো, আমি আর কিছুই মনে করব না। সেদিন যা দেখেছি। তার বেশি আর কি দেখব? আমি জানতাম সুরুজ তোমার কাছে ছুটে আসিবে।
জামাল, তুমি এত নিষ্ঠুর হয়াে না। আমাকে ভুল বুঝে না। ওর পাশে গিয়ে একটু দাঁড়াও। দেখি। লাজো কাঁদতে কাঁদতে বলল, না না না। কেন নয়, ওর গায়ে তো আমার শাট, লুঙ্গি। জামাল দেখল, তার স্মৃতি নেই, বাঁচার আগ্রহ নেই, লাজোর প্রতি অবিশ্বাসও নেই। নাকি হিংসা, বিদ্বেষ, ঈর্ষা এবং ভালোবাসাও নেই?
দিনমজুরের কাজ করতে করতে তার মনটাও যেন ছোট হয়ে গেছে। একবার ভাবল, যেসব অভিযোগ জমা হয়েছে সব একে একে বলে দেয়। চিৎকার করে বলে, কেন দেখলাম, কেন তোমাদের দু জনকে এক সঙ্গে দেখতে পেলাম। আবার সুরুজের দিকে তাকিয়ে বলতে চাইল, তুই বন্ধু হয়েও কেন আমার এত বড় সর্বনাশ করলি, ঘরছাড়া করলি, সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা করলি, অামার শান্তি হরণ করে নিলি ?
লাজো কিছুই করতে না পেরে ব্যথায় কঁকিয়ে উঠল। কাঁদতে কাঁদতে বলল, তোমার ভালােবাসার দোহাই, আমাদের এই নদীর দোহাই, এই কদম গাছটির দিব্যি আমাদের সুন্দর দিনগুলো অরি। ভাবী বংশধরের শপথ "তুমি চুপ করো, আমাকে ক্ষমা করো।
জামাল বলতে চাইল, কেন চুপ করব, কার জন্যে, কিসের মোহে ? বলতে বলতে সে হাঁটতে লাগল। লাজোও তার নাগাল পেতে আতে
আস্তে এগিয়ে চলল। আরো কাছে গিয়ে হাত ধরল, শরীরের সঙ্গে মিশে গেল। জামাল নিজেকে মুক্ত করতে করতে বলল, আমাকে যেতে দাও। লাজো কাঁপতে কাঁপতে বলল, এই নদী সাক্ষী, গাছপালা সাক্ষী, কতবার দাওয়ায় আনমনে বসে থেকেছি, পথের ধারে ছুটে গেছি''।
জামাল বলল, আমি যাব। যেখানে আমার স্বপ্নরা থাকে, স্মৃতির খেলা করে, যেখানে গেলে ফিরে আসতে হবে না।
লাজো এবার আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলল, তোমার ঘরেই আছে ওরা , চলো সেখানে।
জামাল না না বলতে বলতে চলে গেল। সুরুজ মনে মনে বলল, চলে গেল, আবার চলে গেল।
লাজো তখন সুরুজকে গালাগালি করে বলল, তুমি, তুমি কেন দাঁড়িয়ে আছে, যাও চলে যাও। এক্ষুণি চলে যাও।
এসময় রাজী এল, মতি এল। ছাতা মাথায় বাদলও এল।
সাজো চিৎকার করে বলতে লাগল, ওকে থামাও, ও চলে গেল। ও চলে গেল।
রাজী বলল, কে ? হ্যা, এসেছিল। আবার চলে গেল।
ওরা কেউ কথা বলতে পারল না। মতি ও রাজী ছুটে এল তবুও দেখা পেল না। বাদল অনেকক্ষণ আগে থেকে আসতে চাইছিল, সেও দেরি করে ফেলল। জামাল একটুও দেরি না করে ঘটে গিয়ে নৌকোয় উঠল, মতিও কথা না বলে ভিজতে ভিজতে ছুটল। আকাশে বিদ্যুৎ চমকলি, বাজ পড়ল, কাক ডেকে উঠল। ঝাপটা মেরে হাওয়া এল, আবার আকাশের এ-মাথা থেকে ও-মাথা ছিড়ে টুকরো টুকরো হয়ে বিদ্যুৎ চমকে গেল।
রাজী তখন বলল, চল, ঘরে চল বােন। আমরা ঘরে গিয়ে অপেক্ষা করি।
অঝোর বৃষ্টির শব্দ ভেদ করে সেই ডাক কুড়েঘরের লাজো ও রাজীর কানে আসে। রাজী ঘরের ভেতরে থেকে লাজোকে ডেকে বলে, কে ডাকে, এই বাদলায় কে আবার ঘাটে আটকা পড়ল।
বৃষ্টির জন্যে বুড়ো মাঝি নৌকো ছেড়ে ঘরে চলে গেছে। আহা রে বেচারী, বলে লাজোও দুঃখ করতে লাগল।
রাজী ততক্ষণে লাজোর সামনে এসে দাঁড়াল। ঘরের দরোজার মুখে দাঁড়িয়ে কান পেতে শুনল ডাকটা চেনাজানা কিনা। কিন্তু ভারী বৃষ্টির জন্যে লােকটির গলা চিনতে পারল না। রাজীর স্বামী মতি গরু জোড়া নিয়ে গেছে কাঁধে-লাঙলে পরের জমিতে চাষ দিতে। মতি মাঝে মাঝে পরের জমিতে গরু নিয়ে মজুর খাটতে যায়। তাতে একবেলায় চল্লিশ টাকা পায়। তবে পুরােদিন খাটে না, গায়ে-গতরে সারাদিন খাটা খুব কঠিন। শরীরে রস-কষ কিছুই আর থাকে না।
আবার সেই করুণ ডাক শোনা যায়, মাঝি ভাই, পার করে দাও। রাজীর খুব কষ্ট হতে লাগল।বুড়ো মাঝি নৌকো ছেড়ে ঘরে বসে আছে, পাহাড়ী ঢল নেমেছে নদীতে, ঠাণ্ডা ঘোলা পানি খলখল করে ছুটছে। মাঝে মাঝে পাড় ভাঙার শব্দও শোনা যায়। কে তাকে পার করবে এখন?
লাকড়ি ও খড়কুটো ভেসে যায় স্রোতের টানে। কূল-ভাঙা গাছপালা, পাখির বাসা এবং গাছ ব্যবসায়ীর চেরাই করা বড় বড় টুকরাে গাছও ভেসে যায়। পথেঘাটে একটি লোকও দেখা যায় না। দু দিন ধরে সমানে বৃষ্টি ঝরছে। বিলে পানি জমে গেছে, নদীর পানিও কূল ছুই ছুই করছে।
রাজী ডাকল, ও লাজো, যা না, নৌকোটা নিয়ে ওকে তুলে আন না বােন !
নদীর স্রোতকে আমার বড় ভয়, ভাঙনকেও ভয়। এরকম বৃষ্টিতে অামার হৃদপিণ্ডের পড়ি ভাঙতে থাকে ঝপাং ঝপাং। মনে হয় ভাঙতে ভাঙতে একসময় সব শেষ হয়ে যাবে, আমি মরে যাব, নদীর কূলও ভাঙতে ভাঙতে দরিয়া হয়ে যাবে।
রাজী বলল, সেদিন কেন বুঝলি না কেন তাহলে অমন করে সুরুজের বুকে ছুটে গেলি। তুই আসলে সুরুজকেই ভালোবাসিস। ভালোবাসার অমন কাঙাল আমার দেওরটা তোর জন্যে আজ ঘর ছাড়া। ও কত না তোকে ভালোবাসতো। ওর আবেগের কোনো দামই দিলি না তুই।
আমিও তো ওকে আজো ভালোবাসি। ওর জন্যে পাঁচ-পাঁচটি বছর অপেক্ষা করে আছি। ঘর থেকে বের হই না। বাপের বাড়ি থেকে নিতে অাসলেও যাই না। অপেক্ষা করে আছি কবে সে আসিবে। পাছে এসে অামাকে না পায় সেই ভয়ে কোথাও যেতে পারি না।—বলতে বলতে লাজো মুখ ফিরিয়ে নিল, মুখে আঁচল চাপা দিল। আর কি কি বলল আঁচিল ও বৃষ্টির শব্দের জন্যে শোনা গেল না।
এমন সময় আবার ডাক শোনা গেল। রাজী ছেলেকে বকা দিল, বাদল বাইরে কি করছিস ? বৃষ্টিতে ভিজিস না। ভিজলে পিটুনি খাবি।
বাদল বারান্দা থেকে চিৎকার করে বলল, বসে বসে বৃষ্টির খেলা দেখছি। মা দেখে যাও, পানিতে উঠোন ভরে গেছে। পিপড়েগুলো দলামোচা হয়ে ভাসছে। বোধহয় বান হবে।
মা রাজী বলল, অপয়া কথা বলিস না। এমনিতে চলে না, বান হলে উপোস করে মরতে হবে। লােকটা আবার ডাক দিল। ঠাণ্ডায় ওর গলাও কেঁপে গেল মনে হয়। এমন সময় মতি গরু জোড়া গোয়ালে বেঁধে উঠোনে এসে দাঁড়াল। ডাকাডাকি করে সোরগোল ফেলে দিল। মাথার বড় টোকা খুলে, লাঙল-জোয়াল দাওয়ায় রেখে, কাঁপতে কাঁপতে বলল, লুঙ্গিটা দে বউ।
বাদল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বকবক করতে লাগল। রাজী লুঙ্গি নিয়ে বেরিয়ে এসে বলল, নদীর ওপারে কে যেন আটকা পড়েছে, যাও না নৌকোটা নিয়ে, বেচারী অনেকক্ষণ ধরে ডাকছে। লাজো ঘরের ভেতর ছটফট করতে লাগল, ভাবল, যদি জামাল হয়। আবার ভাবল জামালের গলা তো সে চিনবে।
একশো বছর পরে ফিরে এলেও ওর গলা সে চিনতে পারবে। সুরুজ হলেও চিনবে বৈকি! জামালকে সে ভালোবেসে বিয়ে করেছে। ভালােবাসা সব সময় লাজোর বুকে টগবগ করে। সুরুজকে দেখলেও বুকের ভেতর তোলপাড় ওঠে, কিন্তু জামাল...হ্যা, জামাল তার প্রথম ভালোবাসা।
মতি শীতে কাঁপতে কাঁপতে বিরক্ত হয়ে বলল, মরুক গে। বাপের বেটা হলে সঁতরে আসতে পারে না? না যদি পারে বউয়ের আঁচল ধরে ঘরে বসে না থেকে বেরিয়েছে কেন?
এমন সময় লাজো মাথায় আঁচল দিয়ে সামনে এসে দাঁড়াল। মুখে। কিছু না বলে ছলছল তাকিয়ে রইল। নীরবে অনেক কথা বলে নিল। বাদল বলে উঠল, বাবা, আমিও যাব। চলো, আমিও যাই তােমার সঙ্গে। যদি জামাল কাকু হয়?
রাজী তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ঠাণ্ডা লাগিয়ে জ্বর বঁধলে তবেই তোর শান্তি। যা তো দেখি, ঠ্যাং ভেঙে দেব।
জামালের কথায় মতির বুকটা ধক করে উঠল। কতদিন ছােট ভাইটিকে দেখে না, কোলে-পিঠে করে তাকে মানুষ করেছে, কাজ শিখিয়েছে ঢাষবাসের, নিজের হাতে বিয়ে দিয়ে সংসারী করেছে, সে ভাই অজি বউয়ের জন্যে অভিমান করে ঘরছাড়া, বেচারী লাজোর ওপর সব দোষ দিতেও পারে না। নষ্টের মূল তো সুরুজ, বন্ধু হয়ে সে বন্ধুর বউয়ের দিকে হাত বাড়ায় কী করে! ভাবতে ভাবতে মতি বলল, বৈঠাটা দে।
তাহলে দেখি কোন মেয়েছেলে কাঁদছে। জামাল যদি হয় তো দুটো থাপর দিয়ে কান ধরে নিয়ে আসি। অন্য কেউ হলে দুটো কথা শুনিয়ে দেব। লাজো তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে মুখ-চোখ মুছতে লাগল ।
টোকা মাথায় দিয়ে বৈঠা হাতে মতি তেমনি চলে গেল। নদীর কূল ঘেঁষে ঘর, আম কাঠাল ও মাদারের ঘন সারির জন্য নদী দেখা যায় না বলে দূরে মনে হয়, কলকল শব্দটা ঠিকই শোনা যায়। বছর দুয়েক হল এদিকে পাড় ভাঙছে না, তা না হলে কবেই ভিটেমাটি নদীতে ভেসে যেত। পাড়ে গিয়ে মতি গলা ফাটিয়ে ডাক দিল, কে ওখানে, এখনাে কি বেঁচে আছি, নাকি মরেই গেলে। সঙ্গে সঙ্গে ওপার থেকে সাড়া দিল, পার করো মাঝি ভাই, ঠাণ্ডায় মরে। কথা শেষ না হতেই বৃষ্টি ও হাওয়ার ঝাপটায় অসমাপ্ত কথাগুলো একদিকে ধুয়ে-মুছে সাফ করে নিয়ে গেল।
দূরে কোথায় বাজ পড়ল, একটা কুকুর কেঁদে উঠল পাশের কোনো বাড়ি থেকে, ব্যাঙগুলো বাজ পড়ার শব্দে একটু থেমে আবার একঘেয়ে ডাকতে লাগল আর আগের মতাে বৃষ্টির শব্দ একটানা তো চলছেই। নদীতে ঢেউ, স্রোতের কোলাকুলি, গাছপালার ডাল এ-ওর গায়ে পড়ে কাকুতিমিনতি করছে। অথবা ঝগড়া করছে, একের কথা অন্যকে বোঝাতে চেষ্টা করছে, অথবা একজন বলে অমার কথা অগে, আরেকজন বলে আমার কথা আগে শোন—হাওয়া না উঠলে ওরা কখনাে একে অন্যের সঙ্গে মারামারি ঝাপাঝাপি করে না।
নদীর বুকও অমন ওঠানামা করে না, কূলও বুক ফার্টিয়ে নদীর বুকে আছড়ে পড়ে না। আজ কাল পরশু কতদিনের জমা ব্যথা ওরা বলাবলি করছে, কতদিনের রুদ্ধ আবেগ এলোপাতাড়ি বেরিয়ে আসছে'তখন মতি বৈঠা হাতে নৌকোয় উঠে বসল। শেকলটা খুলে নিল, স্রোতের টানে নৌকো ঘুরে যেতে চায়। পাহাড় থেকে নামা এক রোখী ঢল, চুলছেড়া তার স্রোত।
ঘাট থেকে কিছু দৃর উজানে গিয়ে পাড়ি দিল মতি। স্রোতের টানে অনেকখানি নিচে গিয়ে ওপারে পেছিল। ভিজতে ভিজতে নৌকের কাছে এসে দাঁড়াল সুরুজ। তাকে দেখেই গজে উঠল মতি। কোথা থেকে এলি আবার, তোর মুখ দেখতে চাই না, তাের জন্যে আমার ভাই অজি ঘরছাড়া, আর তুইকিনা ঘাটে এসে ডাকাডাকি করছিস। দূর হয়ে যা, আমার চোখের সামনে থেকে চলে যা। সুরুজ মিনতি করে বলল, আগে আমার কথা শোনো, আমি অনেক দূর থেকে আসছি, কত জায়গা ঘুরলাম, কত মানুষের কাছে গেলাম, শেষ পর্যন্ত ওর দেখা পেলাম।জামালের দেখা পেয়েছি। সে আমাকে ভুল বুঝে দূরে সরে রইল। আমি কত করে বোঝালাম। সে বুঝেও বুঝতে চায় না। সেও তোমার মতো দূর দূর করে তাড়িয়ে দিল ।
জামালকে পেয়েছে শুনে মতি একটু নরম হল। উৎসাহী হয়ে তার কথা আরো কিছু শুনতে চাইল। তার একমাত্র ভাই, মা মরার সময় ওর হাতে তুলে দিয়ে গিয়েছিল। বাবা মরার সময় তো দু জনেই ছোট ছিল। মা তাদের বড় করেছে। মাত্র দু বিঘে জমি আর ভিটেটুকু এখনাে আছে। দিনরাত পরিশ্রম করে মতি ও জামাল নিজেদের পায়ে দাঁড়িয়েছে, আর সুখের দেখা পেতে না পেতেই সামনে এসে দাঁড়াল সুরুজ। জামালের বন্ধু। এক প্রাণ দুই হৃদয়।
সেই সুরুজ লাজোকে ভালােবাসলো কি করে ? অথবা লাজোই সুরুজকে চেয়ে বসল, সুরুজ মিনতি করে বলল, দোহাই তোমার ভাই, অামাকে পার করে দাও, না হয় এই ঠাণ্ডায় মরে যাব। তুমিও তো শীতে কাঁপছ। মতি চুপচাপ শুনল শুধু। সত্যিই সেও ঠক ঠক কাঁপছে। গায়ে হূল ফুটছে। বেশিক্ষণ এই কাঁপুনি সহ্য করা সম্ভব হবে না।
সে আর কিছু না বলে নৌকো কূলে ভিড়িয়ে দিল। সুরুজও এক লাফে উঠে লগি মেরে নৌকা উজানে নিয়ে চলল। অনেকখানি উজানে না গেলে হবে না। চোখের পলকে ছুটছে স্রোত। মতির বুকের ভেতরটা তবুও ধকধক করছে। সে আজ শত্রুকে নিজের হাতে বর্ম দিয়ে সাজিয়ে তুলছে, নৌকোয় তুলে পার করতে যাচ্ছে। সাজোর সামনে নিয়ে যাবে তাকে। সব কথা শুনবে, ঘরে নিয়ে যাবে, লাজোর সামনে নিয়ে গিয়ে সব কথা শুনবে?
নদী পাড়ি দিল ওরা। ঘাটে গিয়ে নামল। দুজনেরই তখন এক চিন্তা, উষ্ণতা চাই, আগুন চাই। কোনো মতে নৌকা বেঁধে কোনো দিকে না তাকিয়ে কাঁপতে কাঁপতে এক সুত্র বাঁধা পড়ে গেল ওরা। মতি একবারও পিছন ফিরে তাকাল না। দু জনেই যখন দাওয়ায়।
উঠল তখন কারো মুখে কোনো কথা নেই। রাজী থমকে দাঁড়িয়ে ভাবল, চিৎকার করে তাড়িয়ে দেবে সুরুজকে। আবার এসেছে বন্ধু বেশে !
কিন্তু ওদের দুজনের অবস্থা দেখে ঘর থেকে তাড়াতাড়ি দুটো লুঙ্গি আর গামছা বের করে দিল। বাক্স খুলে সুরুজের জন্য একটা শার্ট ও খদ্দরের চাদর বের করল। দাওয়া ভিজিয়ে একটা একটা করে কাপড় নিঙড়ে বারান্দায় টাঙানো বাঁশের ওপর শুকোতে দিল। তারপর ওরা যখন ঘরে ঢুকল তখন ওদের চেহারা ভেজা ও ফ্যাকাশে, ঠাণ্ডা লেগে জ্বর উঠলে যেমন কাপে তেমনি কাঁপছে। মাটির মালসায় আগুন এনে দিল লাজো।
বুকের ভেতরটা ধকধক করে একেবারে থেমে যাবে মনে হল। স্পর্শ নেই কথা নেই তবুও লাজোর শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেল। নেচে নেচে বয়ে চলল সেই বিদ্যুৎ, তার শুরুও নেই শেষও নেই। বাইরে বৃষ্টি ও একটানা ঝমঝম করেছে দুদিন ধরে, তার শেষ কোথায় যেমন কেউ জানে না তেমনি লাজোর অবশ বুকের পাশ থেকে বেরিয়ে যাওয়া হাত দুটো আপনা-আপনি ওদের সামনে অাগুনের মালসাটা রাখল। কিছুই বলল না সে।
চোখ দুটো তুলে তাকাতেই চোখাচোখি হয়ে গৈল। আর অমনি শরীরে তড়িৎ তরঙ্গটা টেউ তুলে, আরেক দফা ভেঙ পড়ে ধাক্কা দিল। মনে মনে ভাজা বলল, কেন এলে, আবার কেন এলে ? অজ পাঁচ বছর জামাল ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেছে। এখনো আশায় পথ চেয়ে আছি। প্রতিদিন পথ চেয়ে থাকি কবে এসে ডাকবে, লাজী:-আমার লাজো। এত অভিমান, এত ঈৰ্য্য? নাকি ঘৃণা! কেন ঈর্ষা, কেন ঘৃণা, আমি তো তোমারই জামাল।
রান্নাঘরে গেল লাজো। পা দুটি অবশ, বুক ভারী, মাথা ঘুরছে। রাজী বলল, আমি জানি ওকে দেখলে তুই কাহিল হয়ে পড়িস, সেদিনও এমনি ঝড়-বাদলা ছিল। না, আরো বেশি। বানে চারদিক ডুবে গিয়েছিল। দু’ ভাই গিয়েছিল নৌকোর খোঁজে।
লাজো ওর মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বলল, তুই তখন বিছানায় কাতরাচ্ছিস প্রসব বেদনায়, আমি একবার ঘর আরেকবার দাওয়ায়। গিয়ে দাঁড়াচ্ছিলাম। উঠোন জুবে ঘরের দাওয়ায় উঠতে আর মাত্র এক হাত বাকি। ওরা দু ভাই গেছে যেখানে নৌকো পায় নিয়ে আসতে। একজন দাইয়েরও দরকার। মানানা দাই আশ্রয় নিয়েছে স্কুলে, ওর নাতির সঙ্গে থাকে তো ! নাতি আর নাতবউ আর তিন ছেলে, মানানা দাইয়ের বড় হাত যশ। ওর হাতের কাটা নাই পাঁচ দিনে শুকিয়ে সাফ, চার দিনে কালো গুটি হয়ে সাতদিন যেতেই ঝড়ে পড়ে যায়।
রাজী আবার নিজে নিজে বলল, এখন এসব কথা থাক, চায়ের পানি তুলেছি, দু’বাটি রঙ চা দিয়ে আয়, এক চুমুক খেলেই গা গরম হয়ে যাবে।
বাদল একবার রান্নাঘর আবার সুরুজের কাছে গিয়ে কথা শুনছে। জামাল কাকু কেমন আছে, বারবার তার গল্প শোনাতে বলছে। কবে আসবে, কেন এতদিন অাসে না কত প্রশ্ন। মতি ছেলেকে একবার জোরে ধমক দিল। যা, দাওয়ায় বসে বসে বৃষ্টি দেখ গে। উঠোনে নৌকো ভাসিয়েছে কে? শাদা কাগজ দিয়ে নৌকো বানাতে হয় ? কয়টা খাতা শেষ করেছিস? লাট সাহেবের মতো শাদা কাগজ দিয়ে নৌকো বানাচ্ছিস।
সুরুজ ওকে কাছে টেনে নিল, অদির করে বলল, হ্যা আসবে, অনেক টাকা-পয়সা নিয়ে তবেই আসবে। তোর কথা কত জিজ্ঞেস করেছে ! বাদল বলল, কাকু ভালো না, কাকীকে দেখে না, কোনো খবর দেয় না। মতি অাবার ধমক দিয়ে থামিয়ে দিল, যা এখান থেকে মা বলছি, নইলে ঠ্যাং ভেঙে দেব।
সুরুজ বলল, আমি তো ওর কাছে সব স্বীকার করেছি। আমি জানি লাজো ওকে ভালোবাসে। আমাকে নয়। ভালোবাসা তো কত রকম হয়। মাও ছেলেকে ভালোবাসে, একটি মেয়েও একটি যুবককে ভালোবাসে, বোন ভালোবাসে ভাইকে। যুবকের ভালোবাসা একরকম, আবার সেই যুবক তার বোনকে ভালোবাসে, তার বড় ভায়ের বৌকে ভালোবাসে, মাসিপিসিকে ভালোবাসে, বন্ধুর পত্নীকে ভালোবাসে। ভালোবাসার কত রকম ফের, কত রূপ।
জামালের বৌকে আমি শ্রদ্ধা করি।
শ্রদ্ধার আরেক নাম ভালোবাসা, যাকে ভালোবাসে, তাকে শ্রদ্ধা করতে হয়।
না, লাজোর প্রতি অন্যায় দোষ দিও না।
লাজোকে দেখে এইমাত্র কেঁপে উঠেছিস তুই।
এসময় লাজো আরেকটা মালসা হাতে ঘরে ঢুকল। সুরুজের কাছাকাছি রেখে দিতেই সুরুজ টেনে নিল। হাতে হাত লেগে গেল বুঝি! লাজো চলে গেল।
চুপচাপ চারদিক, শুধু ব্যাঙ ডাকছে। মতি বলল, মালসায় ওর ছোঁয়া আছে, হাত বুলিয়ে তুলে নে। মিথ্যাবাদী কোথাকার। সুরুজ চিৎকার করে বলল, মতি ভাই, দোহাই তোমার।।
মেয়েদের একজনের থাকতে দেওয়াই ভালাে, নইলে ঘর আর বার দুই-ই নষ্ট হয়। তুই যদি ওকে কেড়ে নিয়ে যাসতো দেখবি সে আর তোর নয়...সে যে আসলে জামালের তখন বুঝতে পারবে লাজো, তুইও টের পাবি। এখন তাের মনে হচ্ছে লাজো তোর। সে মনে করছে পৃথিবীতে তুই ছাড়া পুরুষ মানুষ নেই—এরকমই মনে হয়।
মতি ভাই ।
আমি সত্যি কথাই বলছি। তবে ওকে যদি ভুলে থাকতে দিস তো সব ঠিক হয়ে যাবে। তুই ওকে বলে যা জামাল কবে আসবে। নিজের মুখে বলে যা জামাল ওকে কতখানি ভালোবাসে।
সুরুজ সমীহ ভরে বলল, মনকে নিয়ে আর কত পারি! জামালকে ফিরিয়ে আনতেই তো এই এক বছর ধরে ঘুরলাম। সেও তোমার মতো আমাকে দুষছে, আমাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছে। আমার কোনাে কথাই বিশ্বাস করতে চায় না। আমার কোনো অনুরোধ সে রাখে নি।
রাজী লাজোকে চায়ের বাটি দুটি নিয়ে যেতে বলল। লাজো নিজেকে ভয় পায়, নিজের অাবেগক ভয় পায়, ভাগ্যকে নিয়ে লড়তে সাহস পায় না। কেন এই ভয়? সামনে তো মতি আছে।
কেন সে নিজেকে সহজ করে নিতে পারে না? সহজ হবার জন্যেই সে আগুনের মলিসা নিয়ে গিয়েছিল। এইতাে সুযােগ, নিজেকে সবকিছুর ওপরে তুলে সে বলে দিতে পারে, অামি জামালের বিবাহিতা স্ত্রী। রাজীর কথার উত্তরে বলল, ওর সামনে গেলে সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়, নিজেকে সামলাতে পারি না।
রাজী ঠাট্টা করে বলল, লোকজনের সামনে আলিঙ্গন করবি নাকি! কি নির্লজ্জ রে বাবা! এমন মেয়ে বাপের জন্মেও দেখি নি।
দোহাই তোর, অমন করে বলিস না। তুই যা।
রাজী এবার গম্ভীর হয়ে বলল, সুরুজকে ভালোবাসার কিছুই নেই। তাের জন্যে জামাল কী না করেছে। বড় ভায়ের সঙ্গে ঝগড়া করেছে, অথচ সে কোনােদিন মুখ তুলে কথা বলত না। পাড়ার লোকজনের বিরােধিতা সত্ত্বেও পাগল হয়ে ছুটে গেছে তোর কাছে।
শেষ পর্যন্ত ভায়ের মত আদায় করে তােকে ঘরে তুলেছে। বিয়েতে তোর ভাসুর সাধ্যমতাে। করেছে। জমি পর্যন্ত বন্ধক দিয়েছে। সে-জমি আবার ফিরিয়ে আনতে দু’ ভাই কত হাড়ভাঙা খাটুনিই না খেটেছে। আর তুই কিনা মজে গেলি ওর বন্ধুকে দেখে?
লাজো একবার ভাবল কিছুই বলবে না। কি হবে পুরোনাে কথা ভেবে, কি হবে বলে! এইতো মাত্র সেদিনের কথা। থৈ-থৈ করছে বানের জল। নৌকো নিয়ে দেখতে এল সুরুজ। দু’ ভাই তখন নৌকো খুজতে গেছে পানি সাঁতারে। নৌকো বেঁধে সুরুজ যখন দাওয়ায় উঠল তখন তার সারা গা ভেজা। ভেজা কাপড়ের নিচে তার পেশীগুলো লাফিয়ে লাফিয়ে নাচছে। লাজোকে দেখে প্রথমে জামালের কথা জিজ্ঞেস করেছিল। তাড়াতাড়ি ঘর থেকে শুকনো গামছা এনে ওর হাতে দিতেই ছোঁয়া লেগে গেল অঙুিলের সঙ্গে।
বিদ্যুৎ শিহরণ সেই যে খেলে গেল তা আর থামল না । এখনো সেই ঢেউ চলছে সারা শরীরে। লাজো শুধু বলল, অজি বৃষ্টির দাপাদাপির সঙ্গে আরো বেশি উথাল-পাথাল করছে সেই স্মৃতি, জোর করে রুখে রাখতে পারি না, থামিয়ে দিতে চাইছি বলে বিদ্রোহ করছে মন।
রাজী বলল, কি বলছিস তুই? এতদূর? কিন্তু ঐ পর্যন্তই। আমি তো আর বেশি কিছু চাই নি। জামালকে আমি ভালোবাসি, ওর জন্যে পাঁচ-পাঁচটি বছর অপেক্ষা করে আছি। চিরদিন থাকব।
রাজী হতাশ হয়ে বলল, কে জানে সুরুজের মাঝে কি অাছে। আমি তো আলাদা কিছুই দেখি না। তুই কি করে দেখবি? তাের চোখ তো মতি ভায়ের চোখে ধাঁধা পড়ে অাছে। ছেলে আছে। তুইও তো বাপের কাছে গো ধরে বসেছিলি ওকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করবি না বলে।
মেয়েদের একজনের হয়ে থাকাই ভালো। দু' নৌকোয় পা দিয়ে সংসার হয় না, দুই পুরুষের কাছে মন দিয়ে জীবন চালান যায় না।
বাইরে তেমনি বৃষ্টি হচ্ছে। বাদল দাওয়ায় বসে বসে বৃষ্টির গান ও ছড়া কাটছে। মতি ও সুরুজ চুপচাপ করে অাছে। লাজো শুধু বলল, সেদিন ঢেউয়ের আঘাতে থেকে নিজেকে বাঁচাতে চেয়েছি, সরিয়ে কূলের কাছে নিয়ে এসেছি, তোর কাছে ছুটে গেছি, কিন্তু পাল খাটানাে নৌকো তো আর বাতাস থেকে সরিয়ে নেয়া যায় না, নিজের ইচ্ছে মতো চালাতে হলে কৌশল করতে হয়। পাল নামিয়ে নিলেও হাওয়ার দাপট থেকে রক্ষা পাওয়া মুশকিল।
লাজোর মন তখন ঐ পালের মতাে হাওয়ায় বুক ফুলিয়ে তরতর ছুটে চলেছে। সেদিন থেকেই লাজোর ভয়। মনকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বাগে আনতে না পেরে জামালের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। কাঁপতে কাঁপতে জ্বর এসে গেল তার। তখন জামাল জানতে চেয়ে বলেছিল, কি হয়েছে, কেউ কিছু বসেছে, পাড়া-পড়শি, রাজী ভাবী? লাজো সব খুলে বলল। হাতের স্পর্শে থেকে লুঙ্গি ও শার্ট দেওয়া, ওর ভেজা কাপড় শুকোতে দেওয়া, তারপর রাজীকে ধরাধরি করে নৌকার গলুয়ের নিচে নেওয়া, সব। আবার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিতে বারবার ঘরে ঢোকা, তখন কী যে হয়ে গেল লাজোর। বাক্সে-কাপড় তুলতে গিয়ে সুরুজের সঙ্গে মাথায় ঠোকাঠুকি হয়ে গেল।
মাথায় শিং গজাবে বলে আবার যখন টোকা। খেতে গেল তখন লাজে। আর পারল না, সুরুজের বুকে মাথা রেখে বসে পড়ল। সুরুজ হাত বুলিয়ে দিল ওর পিঠে। হাত তাে নয় যেন সোনার কাঠি রুপোর কাঠি। একে একে জেগে উঠল প্রতিটি রােমকূপ, প্রতিটি কোষ। শরীরের বাঁধন থেকে তো অনুভূতি বেরিয়ে যেতে পারে না যতক্ষণ না তার নিবৃত্তি হয়। আস্তে আস্তে লাজোর বুক থেকে সুরুজের শরীরে সেই কাপুনি পার হচ্ছে, একটু একটু সুস্থ হচ্ছে সে।
বাটিতে চা ঢালতে ঢালতে রাজী বুঝল লাজোকে চা দিতে পাঠান যাবে না। তাছাড়া জামাল কেমন আছে, কী করছে জানা দরকার। এতদিন যখন বাড়িতে আসে নি আর কোনোদিন কি অাসবে? অার এসেও যদি থাকে সুরুজ এসেছে বা লাজোর এসব কথা শুনলে আবার কি চলে যাবে না চিরদিনের মতো? অথচ লাজোকে রেখে দ্বিতীয় বিয়ে করবে না, তালাকও দেবে না। সে এটুকু বুঝল—লাজোর।
কপাল পুড়েছে, নিজেদের সুখও নষ্ট হয়ে গেছে। কী কুক্ষণেই না সেদিন সুরুজ নৌকো নিয়ে এল। একটু দেরিতে এলেই তাে হত। জামাল নৌকো বেঁধে ঘরে ঢুকল। কেন যে ওর আসার শব্দ লাজো একটুও টের পেল না, বৃষ্টি ও বাজবিজুরী যে কেন অমন করে তখন ঝাপিয়ে নামল হয়তাে নিয়তির খেলায় এই যােগসাজস হয়েছে। নইলে সুরুজের সঙ্গে মাথা ঠোকাঠুকিই বা কেন হবে, কেনই বা ঠিক তখন জামাল এসে সব দেখতে পেল ।
রাজী বার্টি দুটো নিয়ে গেল। ওরা দু জন তখন চুপচাপ বসে অাছে, কারো মুখে কোনো কথা নেই। সেও কিছু বলার সাহস পেল না, দু-একবার এদিক ওদিক তাকিয়ে থাও বলে চলে এল।
লাজো আগের কথার খেই ধরে বলল, ও এসে দেখল, দেখেই চিৎকার করে উঠল, সুরুজকে কিছু না বলে আমার দিকে এগিয়ে এসে এক গণ্ডুসে পান করার মতো দু হাত ধরে যা বলল সেসব শোনার পরও কেন আমি বেঁচে আছি জানি না। তারপর একসময় নিজে নিজে থেমে আমাকে বলল, যা, এই মুহর্তে আমার সামনে থেকে বেরিয়ে যা ওর নৌকোয় চড়ে। ততক্ষণে মতি ভাইও ঘরে ঢুকছে। তারপর দু ভাই মিলে তোকে সুরুজের নৌকো থেকে নিজেদের নৌকোয় তুলল। ওর নৌকো খালি করে দিয়ে আমাকে বলল, যা আমার চোখের সামনে থেকে যেখানে ইচ্ছে দু জনে চলে যা। মতি ভাই ওকে থামাল। তুইও বলিল, আমার কোনাে দোষ নেই, সব দোষ সুরুজের।
রাজী সেই অতীতে ফিরে গিয়ে ভাবল, কেন তার অমন করে পৃথিবীর জোড়া প্রসব বেদনা শুরু হল, কেন লাজোকে চোখে চোখে রাখতে পারল না।
মাথা নিচু করে সুরুজ নৌকো নিয়ে চলে গেল। এক লহমায় কূলভাঙা মাটি নদীতে যেমন পড়ে যায়, তারপর যেমন কিছুক্ষণের জন্য শান্তি ও নীরবতা নেমে আসে তেমনি লাজোর বুক হাল্কা হয়ে উঠল। কিন্তু সেও ক্ষণিকের জন্যে, আবার কুলের মাটি তলে তলে ক্ষয় হতে থাকে এবং একটু পরেই আবার ঝপাৎ করে মাটির আরেকটা চাঙর ধসে পড়বে।
স্কুলের কামরায় সেদিন রাজীর কোলে এল বাদল। সুখের নিঃশ্বাস ফেলল রাজী। সেই দুর্যোগের ভেতর বাদল সবার মনের মধ্যে সুখের সেতু গড়ে তুলল।
সারারাত দাই মানানা জেগে রইল, সাই মিলে কত কথা, লাজো যেন হারানো সুখ খুঁজে পেল।আশপাশের লোকজন সারাক্ষণ খোঁজ নিচ্ছে, সাহায্য করতে ছুটে আসছে, মোট কথা বানে আশ্রয় নেওয়া লোকগুলোর মনে আনন্দের জোয়ার এনে দিয়েছে বাদল। রাজীও নিজেকে ভাগ্যবতী মনে করে সুখে চোখ খুলছে ও বাঁধছে।
আর এদিকে?
হা, বাদল ও রাজীকে দেখে জামাল সেই খুশির সকালে কী একটা ছল করে যে বেরিয়ে গেল আর এল না। একবার মনে হয়েছে জামাল বুঝি বানের জলে ডুবে মরেছে বা কোনো দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে। কিন্তু সেরকম কিছু যে হয় নি পরে বোঝা গেল। পুরুষ মানুষের রাগ, শুধু তাই নয় প্রতিশােধরও আগুন জ্বলছে। যাওয়ার সময় একটি কথাও বলল না লাজোর সঙ্গে। রাজী বলে, পুরুষ মানুষের জেদ থাকা ভালো, নইলে পৃথিবীতে এত বড় বড় কাজ হত না।
উত্তরে লাজো বলল, আর মেয়েরা বুঝি ঐ জেদের পায়ের নিচে পিষে মরার জন্যে জমেছে ?
তোরই বা বড়াই করার মতাে কি আছে? তুই নিজেই তো নিজের সর্বনাশটা করলি। কেন সুরজের অমন কি আছে ? কী পেয়েছিস একবার বল।
কি করব। মনটা সেদিন অমন ভিজে ফুলে-ফেঁপে উঠল কেন ? কত যত্ন করে মনটাকে বেঁধে রেখেছিলাম, কত সাবধান ছিলাম, কত সতর্কতা! কিন্তু জামাল তো জানত আমি ওরই, একা ওর।
নিজের ঢােখে দেখাকে অবিশ্বাস করবে কি করে? তাছাড়া তার সবচেয়ে আপন বন্ধুকে কিনা তুই ভালােবাসতে গেলি। প্রেমে পুরুষরা অবিশ্বাসকে সহ্য করতে পারে না।
লাজো ফুপিয়ে উঠে বলল, কিন্তু সবাই শুধু বাইরেরটাই দেখল। আমার মনটা একটু কোমল, আমার মন যদি এভাবে তৈরি না হত। তাহলে আমি কি অমন করতাম কখনো? আমার চোখমুখ নাক আলাদাভাবে মাটেই সুন্দর নয়। মনটাও আবেগে ভরা, জন্ম ও তুলা রাশিতে বোধহয়। আমার মুখে যদি বসন্তের দাগ থাকত, যদি খেঁদিপেঁচি হতাম, খোঁড়া হতাম কিংবা এক চোখ কান হত তাহলে কেউ ভালোবাসতে আসত না, আমিও বেঁচে যেতাম। এ অবস্থা হত না।
কিসের সঙ্গে কী কথা অনিছিস। যতসব আজেবাজে কথা। খোড়া হবি কেন ?
লাজো কিছুটা সংশয় আর কিছু দ্বিধা নিয়ে বলল, কে জানে সুরুজের ভালোবাসায় কি আছে ? ও কিছুই জোর করে চায় না। প্রায় নরীবে আর অভিমান ভরে সরে সরে থাকে। একটা কিছু বললেই অমনি মুখ গোমরা করে থাকে, নীরবে মেনে নিয়ে চুপ করে যায়।
সুরুজের সঙ্গে তুই একা দেখা করিস নি ?
না, কখনো না। আমি ভয় পাই আমাকে। ওকে দেখলে দূর থেকে সরে যাই, পাশ দিয়ে নীরবে চলে যাই, সে যখন গরু নিয়ে যায় আমি তাড়াতাড়ি অন্যপথে চলে যাই, ওর চোখের সামনে পড়লেই আমার শরীর কেমন করতে থাকে, মুখ বন্ধ হয়ে যায়, বুকে ঢোল বাজতে থাকে।
ওকে ভয় পাস ?
ওকে নয়, আমার নিজেকে। আমার আবেগকে, আমার নিয়তিকে। জামালকে। ওকে দেখলেই জামাল অামার সামনে এসে চোখ তুলে দাঁড়ায়, শাসায়।
তুই একটা অস্তি পাগলী। তুই যদি জামালকে ভালােবাসিস তো অরি সব ছেড়েছুড়ে দিতে পারিস না কেন?
চা খেয়ে মতি বলল, এবার যা তুই। আর কোনোদিন এ-বাড়ি আর এ-মুখে হবি না। তারপর ছাতাটা সুরুজের হাতে তুলে দিয়ে বলল, কাউকে দিয়ে পাঠিয়ে দিস, তুই আসবি না, খবরদার।
সুরুজ আবার প্রতিবাদ করল, আবার বলল যে সে সব কথা জামালকে জানিয়েছে, ফিরে আসতে বলেছে, ফিরে এলে সব ঠিক হয়ে যাবে এবং জামাল এলে সে গ্রাম ছেড়ে চলে যাবে বলেও জানিয়ে দিয়েছে। কিন্তু মতির এক কথা, সুরুজের জন্যই ওদের জীবন বরবাদ হয়ে গেল।
সুরুজ বলল, আমি তো ইচ্ছে করে কিছু করি নি, জোর করে কারো মনের ওপর হাত দেই নি। আমি...
মতি বলল, আর সাফাই গাইতে হবে না, নেহাৎ চিনতে পারি নি, নইলে ওপার থেকে অনিতেও যেতাম না। মরাই তোর উচিত ছিল।
সুরুজ বলতে চাইল, আমি তো অার একটি কথাও নয়, এখখুনি বেরিয়ে যা, এই মুহর্তে।
লাজো তখন নদীতে চান করতে গেছে। ঝমঝম বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ভাব, একবার যদি জানতে পারতাম জামাল কেমন আছে, আমাকে ছাড়া কী সুখে আছে, কি করছে সে? ক্ষমা করে দিয়ে কেন ফিরে আসে না? ভাবতে ভাবতে উজ্জ্বল অতীত দেখতে পায়, একবার এরকম বৃষ্টিতে দু' জনে নদীতে নেমেছিল, জামাল ডুব দিয়ে ওর পা ধরে টেনে গভীর জলে নিয়ে গিয়েছিল, পা থেকে সারা শরীর ধরে এদিক-ওদিক করে অাবার বুক-জলে টেনে এনে কাঁধে তুলে নিয়েছিল।
জলের একটা আলাদা রহস্য আছে, ডুব দিয়ে একজন আরেকজনকে অবিছা দেখতে পায়, দু' দিক থেকে দু জনে অঙ্ক ছুয়ে দেখতে পারে—স্বপ্নের মতাে মনে হয় তখন সবকিছু। ডুব মেরে একজন আরেকজনকে ডাকলে ঝিমঝিম একটা শব্দ পাওয়া যায়, নিঃশব্দে বসে থাকলে বৃষ্টির ধাতব আওয়াজ শোনা যায়।
আর আজ সুরুজ এল অথচ জামালের কথা জিজ্ঞেস করার উপায় নেই। কোনো মতে একা হয়ে যদি সুরুজের কাছ থেকে জেনে নিতে পারত? উপায় নেই। জামালের ঠিকানা, শরীর কেমন আছে, আগের মতো লাজো লাজো ভাবে কিনা? কতদিন দেখা হয় না, বিরহের পাঁচ বছর কী সহজ কথা, মেয়েটাও যদি বেঁচে থাকত হয়তো তার টানে জামাল ফিরে আসত।
পুরুষ মানুষ দেহের আকর্ষণে ব্যাকুল হয়ে সাড়া দেয়, সন্তানের মায়ায় ঘরে ফিরে আসে । বিয়ের প্রথম বছরটা কী উদ্দাম কেটে গেছে। ঘর-বাড়ি মাতিয়ে রাখত সে, বাজার থেকে সামান্য একটা কিছু হলেও নিয়ে আসত। একটা লেবেনচুষ, এক গজ ফিতে, একটা ছােট্ট ক্লিপ বা আলতা।
আলতা পরাতে সে খুব ভালোবাসতো। কতবার নিজের হাতে আলতা পরিয়ে দিয়েছে। পুরুষ মানুষ মেয়েদের পায়ে হাত দিয়ে আলতা পরিয়ে দিলে কার না লজ্জা করে ? সঙ্গে সঙ্গে গর্বে বুকও ভরে যেত। তারপর লাজো জামালের পা কপালে ঠেকত। স্বামীর পা ধরতে লজ্জা কিসের। মাঝে মাঝে আজো হাঁফিয়ে উঠত, তবুও চাইত, স্বামীর সোহাগ আর দৌরাত্ম সমান কথা। একবার যদি জামালকে পায় তাহলে জিজ্ঞেস করবে, ভুলেই যদি যাবে তেী কেন এত উজাড় করে ভালোবেসেছিলে। মুহর্তের ভুলটুকুই কী সব, সেদিন যা ঘটেছিল সেটাই কী জীবনের সবকিছু!
ভাবতে ভাবতে নদী থেকে উঠে এল। ভিজতে ভিজতে নদীর কূল থেকে ঘাটের পাশের কদম গাছের নিচে ছাতা মাথায় কে দাঁড়িয়ে আছে অনুমান করতে চেষ্টা করল। অবিকল জামাল, জামালের লুঙ্গি শাট গায়ে। মুহর্তের জন্যে লাজো ভুল গেল যে ঐ জামা ঐ লুঙ্গি রাজী বের করে দিয়েছিল সুরুজকে। সেই সুরুজ দাঁড়িয়ে আছে।
ছুটে গেল লাজো, তারপর ছাতার নিচে মুখ বাড়িয়ে যখন দেখল সুরুজকে তখন। সে হু হু কেঁদে দিল। সুরুজও ততক্ষণে ওকে ধরে বোঝাতে লাগল, কেঁদো না, আমি অনেক খুঁজে ওর দেখা পেয়েছি। সব কথা খুলে বলেছি। তোমার কোনো দোষ নেই, কোনো অপরাধ হয় নি তোমার।
অাসলে রাজী ভাবীর কথা ভেবেই তাে তুমি সেদিন ভেঙে পড়েছিল, তোমাকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে হঠাৎ কি যে হয়ে গেল; কেন জিনিসপত্র গােছগাছ করতে তোমার মাথার সঙ্গে ঠোকাঠুকি হয়ে গেল—সবই বুঝি দৈব। নিয়তি এভাবে অামাদের বঞ্চিত করেছিল, সুখ থেকে আমাদের এক জায়গায় নিয়ে দাঁড় করিয়েছিল। আমাদের তো কোনাে দোষ ছিল না, বন্ধুর প্রতি অামার তো কোনাে হিংসে নেই, ঈর্ষাও নেই ।
লাজো ভাবল, কেন সে এভাবে পথের ওপর দাঁড়িয়ে আছে, সেদিনের মতাে আজও কেন বৃষ্টি ও আঁধারে চাপা পড়ে আছে সবকিছু। নদীর কূল ছাপিয়ে উঠছে জল বান। বানের জল উঠে আসতে আর বেশি দেরিও নেই বোধ হয়। ঐ বুঝি সে নৌকো নিয়ে এল, কে যেন নদীতে গান গাইছে,
ভালোবেসে সুখ হারালাম আমি
আমি ইচ্ছে করেই অতল জলে নামি...
গান শুনে শুরুজ ভাবল, কে না কে যাচ্ছে। জামাল তো আর অাসবে না। দু দিন আগে সে সাতকানিয়া থেকেও পালিয়েছে। আমার সঙ্গে দেখা হয়েছে বলেই আবার পালাল। আমাকে অবহেলা ও ঘৃনায় পথের ঘাস বানিয়ে ছাড়ল। হায়, যে মানুষ এভাবে পালিয়ে বেড়ায় তাকে কি ধরে আনা যায় ?
ফিরিয়ে এনেও কি লাভ ? সে তো থাকবে না।
লাজো বলল, কি বলেছে সে ? কোনোদিন আসবে না বলেছে? কিন্তু তাকে আসতেই হবে। আমার ভালােবাসার কাছে ফিরে আসতে হবে।
না, সে আর আসবে না। তুমি ওর কথা ভুলে যাও।
অমন করে বলো না। আমাকে আর অমন করে ধুয়ো না। সেদিনের স্পর্শে এখনো মুছে যায় নি, ঢেউ তুলছে এখনো।
সুরুজ বলল, কেন ছায়ার পেছনে ঝুড়ি নিয়ে ছুটবে? পাঁচ-পাঁচটি বছর কেটে গেল, আমার সবকিছু স্বীকার করার পরও যখন সে ক্ষমা করল না আর কেন অপেক্ষা করবে ? আমিও কেন সত্যকে তাড়িয়ে বেড়াব?
আমি ওকে ভয় পাই, আমি নিজের মুখে কিছু কথা বলতে চাই। সুরুজ অস্থির হয়ে বলল, কিসের ভয়, কি কথা বলবে?
লাজো সজাগ হয়ে বলল, ঐ শোনাে, আবার গান গাইছে ? লোকটা নৌকো নিয়ে কূলে ভিড়ছে। আমাদের ঘাটে, ওই বুঝি অসছে।
কখখনো না। সে আসবে না, কোনোদিন আর আসবে না। আসবে, তাকে অাসতেই হবে। জবাব দিয়ে যেতে হবে।
লাজোর মনের ভুল সব সময়ই হয়। ভাবনায় এলোমোলো অার বড় কল্পনাপ্রবণ। সে বলতে লাগল, হা, আমি দেখতে পাচ্ছি সে নৌকো থেকে নামছে, উঠে আসছে কূল বেয়ে রাস্তায়, আর একটু এলেই বাড়ির ঘাটা তারপর পুকুর পাড়। কল্পনার সে ছবি আঁকতে লাগল।
সুন্দর জীবনের আলপনা, সোনালি ভোরের স্বপ্ন একে দেখতে পায়
জামাল আসছে। ওর বুকে বিদ্যুৎ খেলে যায়, তরঙ্গের পর তরঙ্গ ছোটে, ভেঙে পড়ে আর গড়ে ওঠে। সেই ঢেউ উদ্দাম, অনন্ত সেই প্রবাহ---শেষ নেই। ভাবতে ভাবতে সে এগিয়ে যায় সুরুজের দিকে।
সুরুজ বলল, সব ঠিক হয়ে যাবে, সব ভয়ের অবসান হয়ে। লাজো সুরুজের হাতে মাথা ঘষতে ঘষতে শুনতে পায় নিজের বুকে ঢােল বাজছে, নৌকোর বাইচ হচ্ছে, দাঁড় টানছে কেউ জোরে জোরে। মনে মনে বলে, তোমার হাতে কি এমন কোনো দাওয়াই নেই যে এক নিমেশে সব ঠাণ্ডা করে দিতে পারে! কেন পারো না বুকের ঝড় শান্ত করতে, কেন পারো না হৃদপিণ্ডের দাপাদাপি থামাতে ?
সুরুজও নিজের মনে বলে চলল, আজ আমি এসেছি, ওর কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে এসেছি, সে আর ফিরবে না। দ্যাখো, সেদিনের মতাে ঝড় উঠেছে। বাজ পড়ল শুনলে ?
লাজো আরো ভয় পেল। এক মুহর্তে সে ঝাপিয়ে পড়ল ওর বুকে। সুরুজ বলল, এই ঝড় একদিন আমাদের অালাদা করেছে অজি অাবার এক করে দিল।
লাজো আবার ভাবল, ঐ বুঝি জামাল এল, ঐ তার অসির শব্দ, পায়ের শব্দ, গলা খাকারির আওয়াজ। বুকের ওপর থেকে সে মাথা আলগা করল, ছেড়ে দিয়ে দাঁড়াল। সে ঠিক শুনতে পেল জামাল এসেছে। তারপর বলল, ঐ দ্যাখো, ঐ তো এসেছে। তোমার পিছনে।
জামাল বলল, হ্যা আমি জামাল। আমাকে দেখে সতর্ক হওয়ার কি দরকার ?
লাজো যেন অনেক দূর থেকে বলল, জামাল। জামাল তেমনি নিস্পৃহ গলায় বলল, তুমি ওর বুকে মাথা রেখে বলতে পারো, আমি আর কিছুই মনে করব না। সেদিন যা দেখেছি। তার বেশি আর কি দেখব? আমি জানতাম সুরুজ তোমার কাছে ছুটে আসিবে।
জামাল, তুমি এত নিষ্ঠুর হয়াে না। আমাকে ভুল বুঝে না। ওর পাশে গিয়ে একটু দাঁড়াও। দেখি। লাজো কাঁদতে কাঁদতে বলল, না না না। কেন নয়, ওর গায়ে তো আমার শাট, লুঙ্গি। জামাল দেখল, তার স্মৃতি নেই, বাঁচার আগ্রহ নেই, লাজোর প্রতি অবিশ্বাসও নেই। নাকি হিংসা, বিদ্বেষ, ঈর্ষা এবং ভালোবাসাও নেই?
দিনমজুরের কাজ করতে করতে তার মনটাও যেন ছোট হয়ে গেছে। একবার ভাবল, যেসব অভিযোগ জমা হয়েছে সব একে একে বলে দেয়। চিৎকার করে বলে, কেন দেখলাম, কেন তোমাদের দু জনকে এক সঙ্গে দেখতে পেলাম। আবার সুরুজের দিকে তাকিয়ে বলতে চাইল, তুই বন্ধু হয়েও কেন আমার এত বড় সর্বনাশ করলি, ঘরছাড়া করলি, সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা করলি, অামার শান্তি হরণ করে নিলি ?
লাজো কিছুই করতে না পেরে ব্যথায় কঁকিয়ে উঠল। কাঁদতে কাঁদতে বলল, তোমার ভালােবাসার দোহাই, আমাদের এই নদীর দোহাই, এই কদম গাছটির দিব্যি আমাদের সুন্দর দিনগুলো অরি। ভাবী বংশধরের শপথ "তুমি চুপ করো, আমাকে ক্ষমা করো।
জামাল বলতে চাইল, কেন চুপ করব, কার জন্যে, কিসের মোহে ? বলতে বলতে সে হাঁটতে লাগল। লাজোও তার নাগাল পেতে আতে
আস্তে এগিয়ে চলল। আরো কাছে গিয়ে হাত ধরল, শরীরের সঙ্গে মিশে গেল। জামাল নিজেকে মুক্ত করতে করতে বলল, আমাকে যেতে দাও। লাজো কাঁপতে কাঁপতে বলল, এই নদী সাক্ষী, গাছপালা সাক্ষী, কতবার দাওয়ায় আনমনে বসে থেকেছি, পথের ধারে ছুটে গেছি''।
জামাল বলল, আমি যাব। যেখানে আমার স্বপ্নরা থাকে, স্মৃতির খেলা করে, যেখানে গেলে ফিরে আসতে হবে না।
লাজো এবার আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলল, তোমার ঘরেই আছে ওরা , চলো সেখানে।
জামাল না না বলতে বলতে চলে গেল। সুরুজ মনে মনে বলল, চলে গেল, আবার চলে গেল।
লাজো তখন সুরুজকে গালাগালি করে বলল, তুমি, তুমি কেন দাঁড়িয়ে আছে, যাও চলে যাও। এক্ষুণি চলে যাও।
এসময় রাজী এল, মতি এল। ছাতা মাথায় বাদলও এল।
সাজো চিৎকার করে বলতে লাগল, ওকে থামাও, ও চলে গেল। ও চলে গেল।
রাজী বলল, কে ? হ্যা, এসেছিল। আবার চলে গেল।
ওরা কেউ কথা বলতে পারল না। মতি ও রাজী ছুটে এল তবুও দেখা পেল না। বাদল অনেকক্ষণ আগে থেকে আসতে চাইছিল, সেও দেরি করে ফেলল। জামাল একটুও দেরি না করে ঘটে গিয়ে নৌকোয় উঠল, মতিও কথা না বলে ভিজতে ভিজতে ছুটল। আকাশে বিদ্যুৎ চমকলি, বাজ পড়ল, কাক ডেকে উঠল। ঝাপটা মেরে হাওয়া এল, আবার আকাশের এ-মাথা থেকে ও-মাথা ছিড়ে টুকরো টুকরো হয়ে বিদ্যুৎ চমকে গেল।
রাজী তখন বলল, চল, ঘরে চল বােন। আমরা ঘরে গিয়ে অপেক্ষা করি।
আরো নতুন নতুন valobasar Golpo পড়তে ভিজিট করুন
উত্তরমুছুনWWW.VALOBASARGOLPO2.XYZ