পানি পানি পানি। বােশেখ পড়ার মুখেই পানির অভাব শুরু হল। প্রথম প্রথম সস্তায় দু-এক দিন, তারপর অবস্থা একেবারে আয়ত্ত্বের বাইরে চলে যায়। সারা দিন এক ফোটা পানি নেই। শুধু খাওয়ার পানিটুকু জোগাড় করলে তো চলে না। রান্নার কাজে কম করে দু-তিন কলসি লাগে। তারপর ধোয়া-মোছাতে আরো বেশি। অাছে চান করা। শৌচকর্মও অপরিহার্য কাজ। চাল ও তরকারী ধোয়ার পানি দিয়ে টবের গাছের প্রয়োজন মেটান যায়। কিন্তু ঐ পানি দিয়ে আবার এক প্রস্থ থালা-বাসন ধােয়ার কাজ সারতে হয়। এরপর কাপড় কাচার কাজে কত লাগতে পারে তা আপনারাই ভেবে বলুন।
জিয়াদ না হয় অফিসে গিয়ে দিন-শুরুর শৌচকর্ম সারতে পারে। কিন্তু দাড়ি-গোঁফ কাটা। অভাব যখন শুরু হয় অফিসও রেহাই পায় না। প্রকৃতির ছোবল অনেক বেশি ভয়ঙ্কর। মার খেতে খেতে একেবারে কোণঠাসী হলে তবেই প্রকৃতি চোখ তোলে। এই জনহাওয়ার দেশে পানির এই অভাব কি কেউ কোনো দিন ভাবতে পেরেছিল ? মানুষের দয়া-মায়া কমে যাওয়ার সঙ্গে কি এর কোনো সম্পর্কে আছে? পদ্মা-মেঘনা-যমুনা ঘেরা ঢাকার যদি এই অবস্থা হয় তাহলে পঞ্চগড় কোথায় দাঁড়াবে। পানি বিশেষজ্ঞরা বলে, এ হল নদীর উজানে বাঁধ দেওয়ার ফল। কেউ বলে ভূর্গভস্থ পানির অপরিকল্পিত ব্যবহার।
কিন্তু যমুনা ও মেঘনার উজানে তো বাধ নেই। কেউ বলে বর্ষায় পানি ধরে রাখতে হবে, জলাধার তৈরি করতে হবে। শহরের পানি যোগান দিতে হবে নদী আর তৈরি জলাধার থেকে। কিন্তু সাধারণ মানুষ অত-শত বোঝে না। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, পানির অভাব ও লোড শেডিং বোঝে। ঢাকা শহরে কত লক্ষ গ্যালন পানি দরকার এবং সেটা কোথা থেকে আসবে তার দায় ওয়াসার। দিনে এনে দিনে খাওয়া মানুষ তো পানির সমস্যা মেটাতে বৈঠকে বসতে পারে না। এমন কি দুর্দিনের জন্যে পানি ধরে রাখবে সেরকম বড় একটা ড্রামও থাকে না সবার।
কষ্ট এক দিন চরমে উঠল। সকাল থেকে ট্যাঙ্কে পানি নেই। রাতে যেটুকু এসেছিল তাকে ঠিক অাসা বলে না। নিচের ট্যাঙ্ক থেকে মেশিনে ছাদের ট্যাঙ্কে তুলতে না তুলতে পানি শেষ। মাত্র চার বালতি পানি ধরল দলমা। সেই পানি রেশনের ওপর রেশন করে দুপুর পর্যন্ত কাটল। নাওয়া হয় নি, বাসি কাপড়-চোপড় ধোওয়াও নয়। এক বালতি খাওয়ার জন্যে, এক বালতি বাথরুমের ব্যবহারের জন্যে, এক বালতি দিয়ে রান্নাবান্না অার এক বালতি দুঃসময়ের জন্যে সঞ্চয় হিসেবে। বালতি ঢাকা থাকে যাতে আরশোলা টিকটিকি না পড়ে। ছুটা কাজের মেয়ে অঙুিরকে বিদায় দিল ঘর ঝাড় দিয়েই। ছেলেমেয়ে দুটিকে স্কুলে নিয়ে গেল জিয়াদ।
সেখানে থেকে অফিসে পেীছে দেখে অফিসও কারবালা। প্লাস্টিকের গ্যালন হাতে নিয়ে এদিক-ওদিক ছুটছে রাস্তার বাসিন্দা ছেলেমেয়েরা। বস্তি থেকে এল পানি নিতে। সবার মুখে একই কখ-পানি নেই, পানি নেই। জিয়াদ টেলিফোন করতে বসল পত্রিকা অফিসে। পরিচিত সাংবা দিককে পেয়ে জানতে চাইল শহরের অবস্থা কেমন। সাংবাদিক বন্ধুও ফিরিস্তি দিল কোন কোন এলাকায় পানি নেই। শাজাহানপুরের গৃহবধুরা কলসি হাতে মিছিলে নেমেছে। পানিটোলায়ও একই অবস্থা। বাসাবোতে আছে জিয়াদের আরেক বন্ধু। তার অফিসে ফোন করতেই উত্তর এল-ভাবছি, বউ ছেলেমেয়েদের গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেব। শুনে জিয়াদও বলল, তাহলে আমিও তাই করব।
দুটো বাজতেই জিয়াদ ছুটল বাসায়। সারা পথ ভবিল পানির কথা। বাসে দেখা গেল তিনজন যাত্রী ভাগ্যবান। তাদের পানির কষ্ট নেই। তবে বাড়িওয়ালা রেশন করে পানি দিতে আরম্ভ করেছে। ট্যাঙ্কে সব সময় অর্ধেক পানি রিজার্ভ রাখছে। জিয়াদ ও সবাই তাদের মনে মনে ঈর্ষা করে গেল।
বাসায় পৌছল সে। ট্যাঙ্কের মুখ খােলা। তলা পর্যন্ত খাঁ খাঁ করছে। দলমা দরজা খুলল গোমরা মুখে। ছেলেমেয়েদের স্কুল থেকে এনে খাইয়ে দিয়েছে। এক গ্লাস পানিতে মুখ-হাত ধুয়ে সেও খেতে বসল। ব্যস, প্রথম দফা দু জনে। পানির কষ্ট শুরু হওয়ার পর থেকে ওদের মধ্যে কথাবার্তা কমে গেছে। কথা বললেই ঘুরে-ফিরে চলে আসে পানির প্রসঙ্গ। সরকারের বননীতির সমালোচনা করে কয়েক দফা। একটি দেশের জন্যে কত ভাগ বনের দরকার, পরিবেশের ভারসাম্য ইত্যাদি কত কথা।
বিকেলে অঙুর এল পানি এসেছে কিনা দেখতে। না, আসে নি। তার হাতে দুটি প্লাস্টিকের গ্যালন। তাদের বস্তির অবস্থা একেবারে কাহিল। তারও আমার মতাে প্রাণ-চাঞ্চল্য নেই, কথায় কথায় হাসি নেই। আধ মাইল দূরে বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকায় কিন্তু পানির অভাব নেই। ওরা কলের মুখ বন্ধ করে না বললেই চলে। সেখান থেকে কেউ কেউ কলসিতে করে পানি অানে। এক দিন দু দিন চাইলে পানি দেয়। তৃতীয় দিন মুখ গোমরা করে বিরক্তি দেখায়। তারপর নিশ্চয়ই সোজা না করে দেবে।
আঙুরদের বস্তির পাশেই একটা নতুন বাড়ি উঠছে । চারতলায় গাঁথুনি চলছে। বাড়ির মালিকের দয়ার শরীর। যে কেউ পানি নিতে গেলে এক কলসি দেবে। সারা দিন বাড়ির কাজ তদারক করবে আর কাকে একবার পানি দিয়েছে চেহারা দেখেই মনে রাখতে পারে। একবারের বেশি কাউকে পানি দেবে না। মহল্লার সবার বাড়ি ও নম্বর তার মুখস্ত। জিয়াদ একটা বালতি নিয়ে বের হল। ভদ্রলােক পানি উঠিয়ে দিল লোক দিয়ে এবং বলল, এক বালতির বেশি কাউকে দেই না। জিয়াদ ভাবল আঙুরকে পাঠাবে কলসি নিয়ে, শিখিয়ে দেবে কি বলতে হবে না হবে। তারপর অাঙুরকে পাঠাল এবং যথারীতি ধরা পরে ফেরত এল।
বিকেল কাটত অস্বস্তিতে, দলমার সঙ্গে মন খুলে কথা হয়। না। ট্যাঙ্কে পানি আসছে না। পানির চিন্তায় দলমার রক্তচাপ বেড়ে গেল। সে সটান শুয়ে পড়ল। দলমাও কী আর করবে। আঙুর অাগে প্রতিদিন কাজ শেষে দু গ্যালন পানি নিয়ে যেত। সেদিন সে মুখ ভার করে বলল, ঘরে একটুকও পানি নাই। কেউই আর পানি দিবার চায় না। দিন দিন দুইন্ন্যাই কেমুন হইলা যাইতেছে।
দলমা বলল, কি আর করবে। পানি তো আমাদেরও নেই। থাকলে তাে পেতে।
আঙ্গুর মেয়েটি বিশ্বাসী। জিয়াদ ভাবে তাকে সারা দিনের জন্যে রাখতে পারলে ভালো হত। তাতে করে তাকে দু বেলা ভাত। দিতে হবে। তার ওপর চা-পানি ও এক শ' টাকা আছে। দুই ঈদে কাপড় দিতে হবে। এক ঈদে শাড়ি দিলে অন্য ঈদে বলাউজ-পেটিকোট। এভাবে হুট করে খরচ বাড়ালে সামলাতে বেগ পেতে হবে। বিলাসিতা হয়ে যায় আঙুরকে সারা দিনের জন্যে রাখলে। সে বলেছে তা না হলে পোশাক তৈরির কারখানায় চাকরি খুঁজবে। ছুটা কাজের মেয়েও পাওয়া মুশকিল।
বিশ্বাসী বলে আঙুরকে ছাড়াও যায় না। ওকে ঠকানো হচ্ছে সেটাও ঠিক। মাত্র ষাট টাকার বদলে ধােয়ামোছার কাজ, মরিচ-মশল্লা বাটা, মাঝে মাঝে মাছ কোটা-বলতে গেলে তাকে শোষণ করার সামিল। বেচারী না করে না। এজন্যে তোষামোদ করতে হয়। দলমাকে না জানিয়ে পাঁচ-দশ টাকা বকশিস দেয়। কত কম দামে শ্রম বেচে ওরা। বিয়ে হয় নি বলেই হয়তো এসবের পাত্তা দেয় না সে। যে কাজ তাকে দেওয়া হয় কোনো প্রতিবাদ ছাড়া সে তা শেষ করে। ছেলেমেয়ে দুটিকেও মাঝে মাঝে দেখাশোনা করে। ওরা পাশের বাড়ির উঠোনে খেলতে যায়। বিকেলটা ওদের জন্য মুক্তি। সারা দিন ওরা। এই বিকেলের জন্যে হাঁ করে থাকে। শহুরে জীবনে এর বেশি মুক্তি অরি কোথায়?
শুধু ঘর ঝাড় দিয়ে আঙুর চলে গেল। কাপড়-চোপড় স্তুপ হয়ে আছে। হাঁড়ি-পাতিল থেক চামচ দিয়ে নিয়ে খাওয়া সারতে হয়। একটা বাটি ধােওয়াও অভাবের দিনে বাড়তি বোঝা।
রাত একটা নাগাদ ট্যাঙ্কে পানি আসবে। সম কাটাবার জন্যে। জিয়াদ বই নিয়ে বসে। পড়ায় মন বসে না। ছেলেমেয়েরা ঘুমিয়ে পড়েছে। মাথায় পানির চিন্তা নিয়ে উপন্যাস পড়াও এগোয় না। “মুক্তিযুদ্ধের গল্প’ বইটি টেনে নিল। মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীরাই তো তার অফিস দখল করে আছে। বাছাই করে করে তাদের উচু আসনে বসান হয়েছে। তার মতো চুনোপুটিদের কথা কে মানে। ইন্দোনেশিয়ার মুখতার লুবিশ -এর ‘ভয় উপন্যাসটি মুখ বাড়িয়ে আছে। মাহমুদুল হক-এর প্রতিদিন একটি রুমাল’ গল্পটি কয় দিন আগে পড়েছিল। তার কোনো গল্প সঙ্কলন নেই। খুব আস্তে আস্তে পানি আসতে শুরু করেছে ভূগর্ভের ট্যাঙ্কে।
ঘড়িও চলে যেন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। চোখে ঘুম নেমে আসে। কিন্তু ঘুমোলে চলবে না। রাত যত হোক একবার পানি দেবে। নিচে নেমে দেখে অাসবে কিনা ভাবল। পাঁচ তলা বাড়ি। দশটা ফ্লাট। সব বাসায় একজন দু জন জেগে আছে পানি ধরবে বলে। বালতি, হাঁড়ি-পাতিল, ড্রাম সব খালি। এক ড্রাম পানি পেলে এই অকালে দু দিন চালান যেত।
অত পানি একেবারে পাওয়া মানে তো সমস্যার সমাধান। মাঝে এক বার কুকুরের ডাক থেমে গেল। শহরের বড় রাস্তায় গজরাতে গজরাতে ট্রাক চলে গেল। পুলিশ লাইনে লোহার পাতে ঘন্টা পেটানর শব্দ হয়। ঠিক সাড়ে তিনটায় পানি এল যেন লাজলজ্জা ভুলে। একটা ছোট ড্রাম আর চারটে বালতি ভরতে পারলে হয়। দলমা সেই ফাঁকে কাপড় কেচে নিতে চায়। দুটো বড় হাঁড়ি আছে। কিন্তু সব কাজ শেষ করার আগে পানি বন্ধ হয়ে যাবে বুঝতে পারল দলমা। সে বলল, ঐ শোনো, মেশিন বন্ধ হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি করো। জিয়া বলল, কত আর তাড়াতাড়ি করব। আস্তে আস্তে অাসছে পানি।
জিয়াদ নিচে গিয়ে দেখে এল। ট্যাঙ্কে পানি আসা বন্ধ হয়ে গেছে। অর্থাৎ আগামী দিন আবার একই অবস্থা। 'না, এভাবে চলা যায় না। আর দু দিন দেখে দলমাদের গ্রামে পাঠিয়ে দিতে হবে। পানির এ অবস্থার জন্যে সে ছেলেমেয়েদের ওপর পর্যন্ত চেটিপাট শুরু করেছে। অথচ ওদের কী দোষ! জিয়াদ সব বোঝে। দলম বলে, ওদের রাগ দেখাচ্ছে কেন বলো তো।
ঠিক তাই। গ্রামে পাঠাবার আগে ছেলেমেয়েদের খুব অদিরসােহাগ করল। দলমাকে চুমো খেতে খেতে বলল, ওদের সাঁতার শেখাতে চেষ্টা করে। দশ-বিশ বছর বাদে হয়তাে সাঁতার কাটার মতো পানিই দেশে থাকবে না, তবু।
দলমী বলল, বর্ষাও বুঝি হবে না। তুমি এত হতাশ হয়ে পড়ছে কেন?
কে জানে! আমার মনে হয় বর্ষার পাঠও বুঝি উঠে যাবে। পাগলামাে বন্ধ করো। ঠিক আছে। তবে ওদের পুকুর থেকে সামলে রেখো। ঘাট খুব খারাপ। তুমিও সাবধানে নেমে।
আরাে নানা উপদেশ দিয়ে সামাদের গ্রামে পাঠিয়ে দিল। স্টেশন থেকে অফিসে ফিরে চট্টগ্রামে ফোন করে দিল দলমার ভাইকে। বাসায় ফিরে একা একা কতক্ষণ বই ঘাঁটাঘাঁটি করল। সচিত্র আরব্য রজনী বইটির ছবিগুলো উল্টোপাল্টে দেখল। বইটি মূল থেকে সরাসরি অনুবাদ। দেহকে ওরা কতভাবে যে নাড়াচাড়া করেছে, নরনারীর দৈহিক সম্পর্কে কত অকপট, গল্পের অবাধ যাত্রা । তিন শ’ একানব্বইতম রাতে তরুণ ও তরুণীর দেহ-সৌষ্ঠব বর্ণনায় সে আটকে গেল। পড়ল, নারীর আকাক্ষাতেই সুক্ষ মসলিন আবিস্কৃত হয়েছিল।
যত সুক্ষ সুচীকর্ম দেখেন তা শুধুমাত্র নারীর মনােরঞ্জনের জন্যেই তৈরি হয়। নারীর রূপ, তারপর আবার পানির সমস্যায় ডুবে গেল। আলো না থাকলে কোনো মতে চলে। অলো না থাকলে পাখা ঘুরবে না, গরমে সেদ্ধ হতে হবে। তবুও তো বাঁচা যায়। পানি না হলে যে একেবারেই চলে না। নদীর ধারে জিয়াদের বাড়ি। পৃথিবীর সমস্ত প্রাচীন সভ্যতা নদীর কূল-কেন্দ্রিক। ছেলেবেলা থেকে সে নদীতে সাঁতরে দুরন্তপনা করেছে। বাজি ধরে ঘন্টার পর ঘন্টা নদীতে ভেসেছে। বর্ষার নদীর পলিমাখা পানিতে ফিটকিরি দিয়ে খাবার পানি করেছে।
তখন তাদের গ্রামে একটিও চাপকলা ছিল না। গাঙের কুলে ঘর বলে গরম কালে পুকুরের পানি কমে যায়, কিন্তু সেটা কখনো খুব বড় সমস্যা ছিল না। বর্ষায় নদী পুকুর বিল থই থই করে। বান হত কোনো কোনো বছর। পলি পড়ে চরের জমি হত উর্বর। পরের বছর সে জমি থেকে দ্বিগুণ ফসল উঠত। এখন আর তেমন করে বান হয় না। কালেভদ্রে বান হলেও চর ডোবে না। সেই জিয়াদের এক জীবনে পানির জন্যে জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। অনেক গ্রামেও এখন পানির সমস্যা।
দলমাদের গ্রামে পাঠিয়ে জিয়াদ অনেকখানি মুক্ত। দু-এক বালতিতে দিন কাটিয়ে দিতে পারে। বালতিতে পানি নিয়ে মাথা ধুয়ে সে পানি গায়ে ঢলে। গামছা ভিজিয়ে গা মুছে নেয় রাতে। গরম পড়ছে যেন রাগ পুষে। এক দিন তাপ উঠল একচল্লিশ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সেদিন রাত তিনটেয় চার বালতি পানি ধরে চমৎকার একটা চান সেরে বিছানায় গেল ঘুমোতে। ক্লান্ত শরীরে ঘুম নামে তাড়াতাড়ি। সকালে অফিসে যাওয়ার আগে আর চান কর না। অনেক দিন পর হালকা শরীর নিয়ে অফিসে গেল। বিকেলে আঙুর এল। ওদের অবস্থা আরো খারাপ হচ্ছে দিন দিন। কলে দিনেরাতে একটুও পানি আসে না। আশপাশ ঘুড়ে পানি সংগ্রহ করে।
আবার দু'দিন নাওয়া নেই। দু রাত বলতে গেলে পানি আসেই নি। মেশিন চালিয়ে পানি তােলা যায় না। বালতিতে রশি বেঁধে সব বাসায় দু’ বালতি করে পানি ভাগ করে দিয়েছে বাড়িওয়ালা। জিয়াদ হােটেলে খেয়ে আসে। মেয়েটি এসে শুধু ঘর ঝাঁট দিয়ে যায়। পানি নেই এ ভাবনাটিই বেশি কাহিল করে দেয়। পত্রিকায় লেখা লেখি চলে। উত্তরবঙ্গে মরুপ্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞ এক রিপাের্টার তার ভাষ্য ছাপে। আর কুড়ি বছরের মধ্যে রাজশাহী অঞ্চল মরুভূমিতে পরিণত হয়ে যাবে, এই মুহর্ত থেকে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। বর্ষায় যে-সব নদী পানিতে খলবল করে সে-সব এখন একে বারে খা খা। এ-গ্রাম থেকে ও-গ্রামে লোকজন ছুটছে। খাবার পানির জন্যে। পদ্মা ও যমুনায় নতুন চর জাগছে ইত্যাদি ইত্যাদি।
সেদিন অঙুির এসে বলল, ভাইজান, আমাগো বস্তির মানুষ। দ্যাশে চইলা যাইতাছে। আমরাও যামু। তিন দিন গোসল নাই। বাঁচনের আর পথও নাই। জিয়াদ বলল, আমিও চান করি না।
সে বলল, আমাগো বস্তির লগে একটা পুকুর আছে। টলটল পানি। মস্ত বড় পুকুর। তার মালিক দিনভর চাবুক লইয়া পাহারায় থাকে। পুকুর পাড়েই চা খায়, সিগারেট খায়। দুপুরে খাইতে গেলে বড় মাইয়ারে রাইখা যায়। এক বদনা পানিও লইবার দেয় না। কাইল ফজর সময়ে অন্ধার থাকতে থাকতে আলীর মা কাপড় ধুইবার গেছিল। ধোওয়াও শেষ কইরা অনিছিল। কিন্তু কপাল খারাপ। ধরা পইড়া গেল। পাষণ্ডটা বেবাক কাপড় কাঁচি দিয়া কাইটা ফ্যাল ফ্যাল কইরা পুকুরে ফেইলা দিল। বালতিখানও এককেরে পুকুরের মইধ্যে।
পরদিন শুরু হল পানির লাইন খোঁড়াখুঁড়ি। ট্যাঙ্কও পরিষ্কার করল। জিয়াদ-এর বুকটা হু হু করে ওঠে। ট্যাঙ্কের তলানির পানিটুকুও নেই। আঙুর এসে বলল, আমারে কিছু ট্যাহা দিবেন ? মাস ত শেষ হয় নাই, যে-কয় দিনের পাই দেন। দ্যাশে চইলা যামু। মায়ও যাইব। ভাইডা শুধু থাকব। ব্যবসাপাতির ট্যাহা আটকা পইড়া আছে। অহন চইলা গেলে সব শেষ হইয়া যাইব।
গ্রামে তোর কে আছে রে ?
বড় ভাইজান আছে। সে জুদা। অরি চাচায় আছে। মাসের শেষ সপ্তাহ চলছে। হাতে টাকা নেই বললেই চলে। তার ওপর দলমার জন্য একটা আটপৌরে শাড়ি কিনেছে। অঙুিরকে বলল, আর কয়টা দিন অপেক্ষা কর। এই দু দিন। পুরো মাসের টাকাই দেব। অঙুিরও বলল গরম শেষ না হলে ওরা ফিরে। আসবে না। দেশ-গ্রামে কাজ নেই। গার্মেন্টসে তার কাজ পাওয়ার অশি। অাছে। কিন্তু পানির কষ্টের সুরাহা না হলে শহরে থাকবে কী করে।
সপ্তাহের শেষ দিনটি আর কাটতে চায় না। পানির লাইনের খোড়াখুড়ি শেষ। দু’ ফুট নিচু করেছে। জিয়াদ পার্কে বসে বিকেলটা কাটাল। বন্ধু ও আত্মীয়ের বাসায় যাওয়ার কথা মনে পড়েছিল। অন্য সময় হলে যেত। মাথায় পানির চিন্তা নিয়ে কারু কাছে গেল না। পার্কে খুব ভালো লাগল না। গাছগুলো কেমন নেতিয়ে পড়েছে। নাগকেশর, অশোক ও জারুল ফুল কেমন ঝিমিয়ে আছে মনে হল। পার্কের পুকুরে অনেক লোক। পাখিরাও নাইছে। ওদের জন্যে শনি বাঁধান ঘাটের দরকার পড়ে না। সে ঘাটের সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেল। ওপরের পানি গরম। একবার ভাবল গায়ের কাপড় সুদ্ধ নেমে পড়বে কিনা! লুঙ্গি ও গামছা আনলে শরীর জুড়োতে পারত। শেষে মুখে ও ঘাড়ে পানি দিল। শার্ট খুলে গায়ে ভালো করে দিল। আবার শাট গায়ে দিল। শার্টের অনেকখানি ভিজে গেছে।
এক মেয়ে। শাড়ির নিচে হাত দিয়ে ভরা বুক মাজছে। ফাক দিয়ে মাঝে মাঝে পূর্ণতা দেখা দেয়। ওদিকে নেমেছে অারো দু জন। সিঁড়িতে কাগড় ধুচ্ছে পুরুষরা। সেই মেয়েটি কাপড় বদলাত বদলাত জিয়াদের দিকে তাকাল। চোখে চোখ পড়ল। প্রায় অঙুিরের বয়েসী, কিন্তু বিবাহিতা মনে হয়। মেয়েটি হাসল না, কিন্তু শাসন করল। নিজেকেও শাসালো ঘুরে দাঁড়িয়ে। জিয়াদ তথন প্যান্ট গুটিয়ে হাঁটছে। সে নাগকেশরের গন্ধ পায়। অশথ গাছে কয়েকটা দাঁড়কাক চুপচাপ বসে আছে। বেশ কয়েক মিনিট ধরে ওরা ডাকছে না। এরকম মৌনব্রত নিলে ওদের গরম কমে কিনা ওরাই জানে। চুপচাপ থাকলে কি অয় বাড়ে ? সেও অনেকক্ষণ কথা বলছে না। কার সঙ্গেই বা বলবে, একা একা কি কথা বলা চলে?
হঠাৎ তার খুব গান গাইতে ইচ্ছে করল। চৈত্র পবনে মম চিত্ত বনে’ গানটি কেন মনে পড়ল কে জানে! দলমা না থাকলেই শরীর টাটাতে থাকে। মাহবুবের প্রস্তাবের কথা মনে পড়ে। একা একা থাকলে অনেক মুখ মনে পড়ে যায়। পুরনাে প্রেম, পথের দেখা নারীর সঙ্গ কামনায় অকিৗশ-কুসুম গড়ে। শুধু ভাবে কে যেন আসবে। এসে ডাকবে দরজা খুলতে। পার্কে দেখা প্রতিটি নারীকে সুন্দরী ও ভালোবাসার যোগ্য ভাবে। দু' দিন আগে মাহবুবের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল ওর দোকানে। খুব সস্তায় একখানা শাড়ি দিয়েছিল। বলেছিল পানি সমস্যার কথা। দলমাদের গ্রামের পাঠানর কথা। মাহবুব বলেছিল, একা আছিস ? সময় কাটে কি করে ? সঙ্গী চাই তাে বল। ঐ যে দেখছিস পেছন ঘুরে আছে মেয়েটি। সে খবর নিতে এসেছে। ওকেও নিতে পারিস। বাসায় চলে যাবে। সারা দিনও রাখতে পারিস, রাতেও।
পার্কে সন্ধে কাটিয়ে হোটেলে গেল খেতে। কোনো মতে এক থালা খেয়ে বাসায় ফিরল। পানি আসে নি। অারো এক দফা ক্লান্তি জাপটে ধরল। এত ক্লান্ত যে বিছানায় পড়াই শুধু বাকি। বিছানাও ডাকছে। তবুও জাগতে হবে। বাড়ির দু' নম্বর মালিক বয়সে তরুণ। জিয়াদ থেকে অনেক ছোট। সে অশ্বাস দিয়ে গেল পানি আসবে বলে। ভােরে পানি পাওয়া যাবে। রাতটা নিশ্চিন্তে ঘুমুতে বলল। সপ্তাহের শেষ দিন। ছুটির দিন ঘুম থেকে উঠে পানি মিলবে বলে গভীর আশ্বাস দিয়ে গেল । জিয়াদও আর রাত জাগবে না ভেবে বিছানায় গিয়ে টানাটান হয়ে শুয়ে পড়ল। তারপর বালিশটী কোলে টেনে নিল। ঘুম আসবে বৈকি! পার্কের স্নানরতার ছবি মনে পড়ে চকিতে। মাহবুবের সেই মেয়েটিও কম কি । একা থাকলে কত ভাবনা।
ঘুম ভাঙা দেরিতে। সূর্য উঠতে উঠতেই চরাচর গরম করে তুলছে। জিয়াদ ক্লান্তি নিয়ে আরো কিছুক্ষণ পড়ে রইল। বিছানা ছাড়তেও ভয়। যদি পানি না আসে! কনের মুখ বন্ধ করে রেখেছে। মেশিন ছাড়ার শব্দও পায় নি। ঘুম হচ্ছে মৃত্যুর যমজ ভাই। শরীরে এক মুঠো জোর নেই। তার চেয়ে ভয় যদি পানি না আসে। এমন সময় দরজার কড়া নড়ে উঠা। ছুটির দিনে কে এত সকাল সকাল কড়া নাড়তে পারে ভাবতে ভাবতে জিয়াদ উঠল। মাথার ওপর পাখা ঘুরছে বনবন। গেঞ্জিটা-লুঙ্গিটা পাশ থেকে টেনে নিল। একা থাকলে সে এরকম শোয়। উলঙ্গ শোওয়াটা তার বিলাস।
দরজা খুলতেই দেখে আঙুর। এক ঝলক মোহনীয় হাসিতে মুহর্তের মধ্যে জিয়াদের শরীরে ঝড় বইয়ে দিল। থর থর করে কেঁপে উঠল সেই ভুবনমােহিনী হাসিতে। দলমার সঙ্গে প্রথম পরিচয় ও হাসির মুহর্তগুলো ছবির মতো ছুটে এল। জিয়াদকে এক রকম ঠেলে আঙুর ঢুকল। দরজা বন্ধ করতে করতে বলল, পানি আইছে, পানি আইছে।
পানি এসেছে ? পানি? সত্যি !--আর এক মুহুর্তও দেরি না করে আঙুরকে এক রকম ধাক্কা দিয়ে ঠেলে এক টানে গেঞ্জি খুলে, ছুড়ে ফেলে এক লাফে বাথরুমে ঢুকে পড়ল। দরজা বন্ধ করে এক মোচড়ে ঝর্ণা খুলে দু হাত তুলে দাঁড়িয়ে পড়ল। আফ্রিকার আদিবাসীরা প্রকৃতির কাছে যেমন প্রার্থনা জানায় তেমনি দু হাত তুলে দাঁড়াল। পানি অসাও প্রকৃতির আশীর্বাদ। জিয়াদ মনে করে প্রকৃতি ছাড়া মানুষের বাচার আর কোনো উপায় নেই।
মানুষ প্রকৃতি থেকে দু হাতে গ্রহণ করে নিষ্ঠুরের মতো, কিন্তু প্রকৃতিকে দিতে চায় কৃপণের মতাে। প্রকৃতিও এক সময় রুদ্র রূপ নিয়ে এক হাত দেখে নেয় মানুষকে। আনন্দে উল্লাসে জিয়াদ হাত তুলল, ফুর্তিতে গান ধরল, জলতরঙ্গ বাজে..••••। কেন এ গানটি মনে পড়ল সে জানে না। সারা গায়ে দু' হাত খেলা শুরু করছে। চোখ-মুখ-কপাল ঘষল। কানের পেছনের ঘাম তুলল। বগলের নিচে সাবান মাখল। বুকের ছাতি ফোলাল। নিজের উদোম শরীরটা বার বার দেখল। একান্ত অন্তরঙ্গ অঙ্গে সাবান দিতে দিতে কিছুক্ষণ খেলা করল। মাথার ওপর ঝমঝম ঝর্ণা আর শরীরনিয়ে খেলায় সুখ খুঁজল।
দলমা না থাকলে শরীর নিয়ে নাড়াচাড়া করতে ভালো লাগে। মনে পড়ল গ্রামের নদীতে সাঁতার কাটার স্মৃতি। ভাদ্রের গরমে নদীতে সাঁতার কাটার মতাে দুরন্ত অনিন্দ আর কিছুতেই হয় না। সারা শরীর জলের স্পর্শে রোমাঞ্চিত হয়ে ভেঙে ভেঙে পড়ে। এ জন্যেই বুঝি মানবসভ্যতা নদীকেন্দ্রিক। এজন্যে জলই জীবন। এজন্যে পানির অভাবে এত উত্তেজনা, এত বিষাদ, এত উদ্বেগ। পানি আসার সঙ্গে সঙ্গে তাই সে শরীর নিয়ে পড়ল।
মুহূর্তে মুহর্তে মনে পড়ে একেক কথা। ছেলেবেলার কথা, কৈশােরের কথা, দলমার। গ্রামে ফেলে আসা সেই মেয়েটি তাকে বার বার কাছে ডেকে চুমু খেত। এক বার মাত্র শোনা একটি গানের কথা মনে পড়ল। একদিনের খাওয়ার কথা মনে পড়তেই হঠাৎ খুব খিদে পেল। আঙুরকে বললেও হত। ডিম ও আলু সেদ্ধ বসতি। বয়ামে টমেটোর জেলি থাকতে পারে। মিরতিঙ্গা চা বাগান থেকে একজন কিছু উৎকৃষ্ট চা পাঠিয়েছে ক'দিন আগে। আর মেয়েটি কেমন তাও ভাবল মনে মনে। সে কি করছে এখন ? অাবার গান গেয়ে উঠল, আমার এ ভালোবাসা কি যে তার নাম...।
কতক্ষণ কল খুলে শরীর জুড়িয়েছে...কতক্ষণ আকাশপাতাল ভেবেছে...। তারপর মনে পড়ল লুঙ্গি তোয়ালে কিছুই নেয় নি। অঙুিরকে ডাকতে তো হবেই। গলা খুলে ডাকল, আঙুর, একটা লুঙ্গি আর গামছা দে। মনে আর কোনো অলসতা বুঝি নেই। কোনাে গ্লানি বা অভিযােগ নেই কারো প্রতি। শুধু অঙুিরের ভাবনা মনের ভেতর খচখচ করছে। তাই তাড়াতাড়ি ঠিক করল দলমী ও ছেলেমেয়েদের নিয়ে আসার কথা।
একটা চিঠি লিখবে দলমাকে। কতদিন দলমাকে চিঠি লেখার সুযোগ হয় না। দলমার প্রতি তীব্র আকর্ষণ অনুভব করল। দরজা খুলে বের হতেই দেখে আঙুরের চোখে-মুখে করুণা। টেবিলে খাবার পরিবেশন করছে সে। এক জোড়া ডিম পোচ। একসঙ্গে এক জোড়া ডিম দিল কেন? সে তো এক জোড়া ডিম কোনাে দিন খায় না। রাঙা আলু সেদ্ধ থেকে ধোঁয়া উড়ছে।
খোসা খুলে পরিপাটি করে চিনো মাটির বাটিতে রেখেছে। ঢাকা দিয়েছে কাচের প্লেট দিয়ে। খাবার ঢাকাও হল আবার দেখাও যায়। এত সুন্দর করে পরিবেশন করেছে যে জিয়াদের চোখে পড়ল। পাশে জেলির বয়াম। তলায় পড়ে আছে। বিস্কিটও আছে। আরেকটা টিনে কি আছে কে জানে। চা বানিয়ে পটে ঢেকে রেখেছে। চিরুণি হাতে দাঁড়াতেই আঙুরের সঙ্গে অয়নায় চোখাচোখি হল। সে বাথরুমে মাজছে । এইমাত্র সে বলেছে ওদের পানির কষ্ট মিটবে না। একটা ডোবা থেকে পানা সরিয়ে ধোয়ার কাজ সারে। ওদের বস্তির মালিক বলে দিয়েছে পানি আসার কোনো সম্ভাবনা নেই।
খুশির চোটে একটা ডিম অঙরের জন্যে রেখে দিল। রাঙা আলুর ভাগ রাখল। এক বার ভাবল দলমার জন্যে কেনা শাড়িটা আঙুরকে দেবে কিনা। তাহলে সে চান করতে পারবে। গায়ের ঘাম কত দিন পরিষ্কার করতে পারে না সে-ও ! মেয়েটি ভালো। আবার ভাবল, নতুন শাড়ি দেওয়ায় যদি অন্য অর্থ করে। ঘরে ঢোকার সময় হাসির অর্থ কি শুধু পানি আসার জন্যে! নাকি আচ্ছন্নতা ? দ্বিধা ও দ্বন্দ্ব শেষ করে সে উঠল।
অলিমারী খুলে শাড়ি খানা নিল। নতুন কাপড়ের একরকম গন্ধ আছে, একরকম মাদকতা অাছে, অাছে আনন্দ। পায়ে পায়ে বাথরুমের দরজায় গিয়ে দাঁড়াতেই বুকের দুরু দুরু। শুনল। শরীরে শিহরণ খেলে গেল। আর...হাতের চাপে নতুন শাড়ি শব্দ করে উঠল।
জিয়াদ না হয় অফিসে গিয়ে দিন-শুরুর শৌচকর্ম সারতে পারে। কিন্তু দাড়ি-গোঁফ কাটা। অভাব যখন শুরু হয় অফিসও রেহাই পায় না। প্রকৃতির ছোবল অনেক বেশি ভয়ঙ্কর। মার খেতে খেতে একেবারে কোণঠাসী হলে তবেই প্রকৃতি চোখ তোলে। এই জনহাওয়ার দেশে পানির এই অভাব কি কেউ কোনো দিন ভাবতে পেরেছিল ? মানুষের দয়া-মায়া কমে যাওয়ার সঙ্গে কি এর কোনো সম্পর্কে আছে? পদ্মা-মেঘনা-যমুনা ঘেরা ঢাকার যদি এই অবস্থা হয় তাহলে পঞ্চগড় কোথায় দাঁড়াবে। পানি বিশেষজ্ঞরা বলে, এ হল নদীর উজানে বাঁধ দেওয়ার ফল। কেউ বলে ভূর্গভস্থ পানির অপরিকল্পিত ব্যবহার।
কিন্তু যমুনা ও মেঘনার উজানে তো বাধ নেই। কেউ বলে বর্ষায় পানি ধরে রাখতে হবে, জলাধার তৈরি করতে হবে। শহরের পানি যোগান দিতে হবে নদী আর তৈরি জলাধার থেকে। কিন্তু সাধারণ মানুষ অত-শত বোঝে না। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, পানির অভাব ও লোড শেডিং বোঝে। ঢাকা শহরে কত লক্ষ গ্যালন পানি দরকার এবং সেটা কোথা থেকে আসবে তার দায় ওয়াসার। দিনে এনে দিনে খাওয়া মানুষ তো পানির সমস্যা মেটাতে বৈঠকে বসতে পারে না। এমন কি দুর্দিনের জন্যে পানি ধরে রাখবে সেরকম বড় একটা ড্রামও থাকে না সবার।
কষ্ট এক দিন চরমে উঠল। সকাল থেকে ট্যাঙ্কে পানি নেই। রাতে যেটুকু এসেছিল তাকে ঠিক অাসা বলে না। নিচের ট্যাঙ্ক থেকে মেশিনে ছাদের ট্যাঙ্কে তুলতে না তুলতে পানি শেষ। মাত্র চার বালতি পানি ধরল দলমা। সেই পানি রেশনের ওপর রেশন করে দুপুর পর্যন্ত কাটল। নাওয়া হয় নি, বাসি কাপড়-চোপড় ধোওয়াও নয়। এক বালতি খাওয়ার জন্যে, এক বালতি বাথরুমের ব্যবহারের জন্যে, এক বালতি দিয়ে রান্নাবান্না অার এক বালতি দুঃসময়ের জন্যে সঞ্চয় হিসেবে। বালতি ঢাকা থাকে যাতে আরশোলা টিকটিকি না পড়ে। ছুটা কাজের মেয়ে অঙুিরকে বিদায় দিল ঘর ঝাড় দিয়েই। ছেলেমেয়ে দুটিকে স্কুলে নিয়ে গেল জিয়াদ।
সেখানে থেকে অফিসে পেীছে দেখে অফিসও কারবালা। প্লাস্টিকের গ্যালন হাতে নিয়ে এদিক-ওদিক ছুটছে রাস্তার বাসিন্দা ছেলেমেয়েরা। বস্তি থেকে এল পানি নিতে। সবার মুখে একই কখ-পানি নেই, পানি নেই। জিয়াদ টেলিফোন করতে বসল পত্রিকা অফিসে। পরিচিত সাংবা দিককে পেয়ে জানতে চাইল শহরের অবস্থা কেমন। সাংবাদিক বন্ধুও ফিরিস্তি দিল কোন কোন এলাকায় পানি নেই। শাজাহানপুরের গৃহবধুরা কলসি হাতে মিছিলে নেমেছে। পানিটোলায়ও একই অবস্থা। বাসাবোতে আছে জিয়াদের আরেক বন্ধু। তার অফিসে ফোন করতেই উত্তর এল-ভাবছি, বউ ছেলেমেয়েদের গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেব। শুনে জিয়াদও বলল, তাহলে আমিও তাই করব।
দুটো বাজতেই জিয়াদ ছুটল বাসায়। সারা পথ ভবিল পানির কথা। বাসে দেখা গেল তিনজন যাত্রী ভাগ্যবান। তাদের পানির কষ্ট নেই। তবে বাড়িওয়ালা রেশন করে পানি দিতে আরম্ভ করেছে। ট্যাঙ্কে সব সময় অর্ধেক পানি রিজার্ভ রাখছে। জিয়াদ ও সবাই তাদের মনে মনে ঈর্ষা করে গেল।
বাসায় পৌছল সে। ট্যাঙ্কের মুখ খােলা। তলা পর্যন্ত খাঁ খাঁ করছে। দলমা দরজা খুলল গোমরা মুখে। ছেলেমেয়েদের স্কুল থেকে এনে খাইয়ে দিয়েছে। এক গ্লাস পানিতে মুখ-হাত ধুয়ে সেও খেতে বসল। ব্যস, প্রথম দফা দু জনে। পানির কষ্ট শুরু হওয়ার পর থেকে ওদের মধ্যে কথাবার্তা কমে গেছে। কথা বললেই ঘুরে-ফিরে চলে আসে পানির প্রসঙ্গ। সরকারের বননীতির সমালোচনা করে কয়েক দফা। একটি দেশের জন্যে কত ভাগ বনের দরকার, পরিবেশের ভারসাম্য ইত্যাদি কত কথা।
বিকেলে অঙুর এল পানি এসেছে কিনা দেখতে। না, আসে নি। তার হাতে দুটি প্লাস্টিকের গ্যালন। তাদের বস্তির অবস্থা একেবারে কাহিল। তারও আমার মতাে প্রাণ-চাঞ্চল্য নেই, কথায় কথায় হাসি নেই। আধ মাইল দূরে বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকায় কিন্তু পানির অভাব নেই। ওরা কলের মুখ বন্ধ করে না বললেই চলে। সেখান থেকে কেউ কেউ কলসিতে করে পানি অানে। এক দিন দু দিন চাইলে পানি দেয়। তৃতীয় দিন মুখ গোমরা করে বিরক্তি দেখায়। তারপর নিশ্চয়ই সোজা না করে দেবে।
আঙুরদের বস্তির পাশেই একটা নতুন বাড়ি উঠছে । চারতলায় গাঁথুনি চলছে। বাড়ির মালিকের দয়ার শরীর। যে কেউ পানি নিতে গেলে এক কলসি দেবে। সারা দিন বাড়ির কাজ তদারক করবে আর কাকে একবার পানি দিয়েছে চেহারা দেখেই মনে রাখতে পারে। একবারের বেশি কাউকে পানি দেবে না। মহল্লার সবার বাড়ি ও নম্বর তার মুখস্ত। জিয়াদ একটা বালতি নিয়ে বের হল। ভদ্রলােক পানি উঠিয়ে দিল লোক দিয়ে এবং বলল, এক বালতির বেশি কাউকে দেই না। জিয়াদ ভাবল আঙুরকে পাঠাবে কলসি নিয়ে, শিখিয়ে দেবে কি বলতে হবে না হবে। তারপর অাঙুরকে পাঠাল এবং যথারীতি ধরা পরে ফেরত এল।
বিকেল কাটত অস্বস্তিতে, দলমার সঙ্গে মন খুলে কথা হয়। না। ট্যাঙ্কে পানি আসছে না। পানির চিন্তায় দলমার রক্তচাপ বেড়ে গেল। সে সটান শুয়ে পড়ল। দলমাও কী আর করবে। আঙুর অাগে প্রতিদিন কাজ শেষে দু গ্যালন পানি নিয়ে যেত। সেদিন সে মুখ ভার করে বলল, ঘরে একটুকও পানি নাই। কেউই আর পানি দিবার চায় না। দিন দিন দুইন্ন্যাই কেমুন হইলা যাইতেছে।
দলমা বলল, কি আর করবে। পানি তো আমাদেরও নেই। থাকলে তাে পেতে।
আঙ্গুর মেয়েটি বিশ্বাসী। জিয়াদ ভাবে তাকে সারা দিনের জন্যে রাখতে পারলে ভালো হত। তাতে করে তাকে দু বেলা ভাত। দিতে হবে। তার ওপর চা-পানি ও এক শ' টাকা আছে। দুই ঈদে কাপড় দিতে হবে। এক ঈদে শাড়ি দিলে অন্য ঈদে বলাউজ-পেটিকোট। এভাবে হুট করে খরচ বাড়ালে সামলাতে বেগ পেতে হবে। বিলাসিতা হয়ে যায় আঙুরকে সারা দিনের জন্যে রাখলে। সে বলেছে তা না হলে পোশাক তৈরির কারখানায় চাকরি খুঁজবে। ছুটা কাজের মেয়েও পাওয়া মুশকিল।
বিশ্বাসী বলে আঙুরকে ছাড়াও যায় না। ওকে ঠকানো হচ্ছে সেটাও ঠিক। মাত্র ষাট টাকার বদলে ধােয়ামোছার কাজ, মরিচ-মশল্লা বাটা, মাঝে মাঝে মাছ কোটা-বলতে গেলে তাকে শোষণ করার সামিল। বেচারী না করে না। এজন্যে তোষামোদ করতে হয়। দলমাকে না জানিয়ে পাঁচ-দশ টাকা বকশিস দেয়। কত কম দামে শ্রম বেচে ওরা। বিয়ে হয় নি বলেই হয়তো এসবের পাত্তা দেয় না সে। যে কাজ তাকে দেওয়া হয় কোনো প্রতিবাদ ছাড়া সে তা শেষ করে। ছেলেমেয়ে দুটিকেও মাঝে মাঝে দেখাশোনা করে। ওরা পাশের বাড়ির উঠোনে খেলতে যায়। বিকেলটা ওদের জন্য মুক্তি। সারা দিন ওরা। এই বিকেলের জন্যে হাঁ করে থাকে। শহুরে জীবনে এর বেশি মুক্তি অরি কোথায়?
শুধু ঘর ঝাড় দিয়ে আঙুর চলে গেল। কাপড়-চোপড় স্তুপ হয়ে আছে। হাঁড়ি-পাতিল থেক চামচ দিয়ে নিয়ে খাওয়া সারতে হয়। একটা বাটি ধােওয়াও অভাবের দিনে বাড়তি বোঝা।
রাত একটা নাগাদ ট্যাঙ্কে পানি আসবে। সম কাটাবার জন্যে। জিয়াদ বই নিয়ে বসে। পড়ায় মন বসে না। ছেলেমেয়েরা ঘুমিয়ে পড়েছে। মাথায় পানির চিন্তা নিয়ে উপন্যাস পড়াও এগোয় না। “মুক্তিযুদ্ধের গল্প’ বইটি টেনে নিল। মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীরাই তো তার অফিস দখল করে আছে। বাছাই করে করে তাদের উচু আসনে বসান হয়েছে। তার মতো চুনোপুটিদের কথা কে মানে। ইন্দোনেশিয়ার মুখতার লুবিশ -এর ‘ভয় উপন্যাসটি মুখ বাড়িয়ে আছে। মাহমুদুল হক-এর প্রতিদিন একটি রুমাল’ গল্পটি কয় দিন আগে পড়েছিল। তার কোনো গল্প সঙ্কলন নেই। খুব আস্তে আস্তে পানি আসতে শুরু করেছে ভূগর্ভের ট্যাঙ্কে।
ঘড়িও চলে যেন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। চোখে ঘুম নেমে আসে। কিন্তু ঘুমোলে চলবে না। রাত যত হোক একবার পানি দেবে। নিচে নেমে দেখে অাসবে কিনা ভাবল। পাঁচ তলা বাড়ি। দশটা ফ্লাট। সব বাসায় একজন দু জন জেগে আছে পানি ধরবে বলে। বালতি, হাঁড়ি-পাতিল, ড্রাম সব খালি। এক ড্রাম পানি পেলে এই অকালে দু দিন চালান যেত।
অত পানি একেবারে পাওয়া মানে তো সমস্যার সমাধান। মাঝে এক বার কুকুরের ডাক থেমে গেল। শহরের বড় রাস্তায় গজরাতে গজরাতে ট্রাক চলে গেল। পুলিশ লাইনে লোহার পাতে ঘন্টা পেটানর শব্দ হয়। ঠিক সাড়ে তিনটায় পানি এল যেন লাজলজ্জা ভুলে। একটা ছোট ড্রাম আর চারটে বালতি ভরতে পারলে হয়। দলমা সেই ফাঁকে কাপড় কেচে নিতে চায়। দুটো বড় হাঁড়ি আছে। কিন্তু সব কাজ শেষ করার আগে পানি বন্ধ হয়ে যাবে বুঝতে পারল দলমা। সে বলল, ঐ শোনো, মেশিন বন্ধ হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি করো। জিয়া বলল, কত আর তাড়াতাড়ি করব। আস্তে আস্তে অাসছে পানি।
জিয়াদ নিচে গিয়ে দেখে এল। ট্যাঙ্কে পানি আসা বন্ধ হয়ে গেছে। অর্থাৎ আগামী দিন আবার একই অবস্থা। 'না, এভাবে চলা যায় না। আর দু দিন দেখে দলমাদের গ্রামে পাঠিয়ে দিতে হবে। পানির এ অবস্থার জন্যে সে ছেলেমেয়েদের ওপর পর্যন্ত চেটিপাট শুরু করেছে। অথচ ওদের কী দোষ! জিয়াদ সব বোঝে। দলম বলে, ওদের রাগ দেখাচ্ছে কেন বলো তো।
ঠিক তাই। গ্রামে পাঠাবার আগে ছেলেমেয়েদের খুব অদিরসােহাগ করল। দলমাকে চুমো খেতে খেতে বলল, ওদের সাঁতার শেখাতে চেষ্টা করে। দশ-বিশ বছর বাদে হয়তাে সাঁতার কাটার মতো পানিই দেশে থাকবে না, তবু।
দলমী বলল, বর্ষাও বুঝি হবে না। তুমি এত হতাশ হয়ে পড়ছে কেন?
কে জানে! আমার মনে হয় বর্ষার পাঠও বুঝি উঠে যাবে। পাগলামাে বন্ধ করো। ঠিক আছে। তবে ওদের পুকুর থেকে সামলে রেখো। ঘাট খুব খারাপ। তুমিও সাবধানে নেমে।
আরাে নানা উপদেশ দিয়ে সামাদের গ্রামে পাঠিয়ে দিল। স্টেশন থেকে অফিসে ফিরে চট্টগ্রামে ফোন করে দিল দলমার ভাইকে। বাসায় ফিরে একা একা কতক্ষণ বই ঘাঁটাঘাঁটি করল। সচিত্র আরব্য রজনী বইটির ছবিগুলো উল্টোপাল্টে দেখল। বইটি মূল থেকে সরাসরি অনুবাদ। দেহকে ওরা কতভাবে যে নাড়াচাড়া করেছে, নরনারীর দৈহিক সম্পর্কে কত অকপট, গল্পের অবাধ যাত্রা । তিন শ’ একানব্বইতম রাতে তরুণ ও তরুণীর দেহ-সৌষ্ঠব বর্ণনায় সে আটকে গেল। পড়ল, নারীর আকাক্ষাতেই সুক্ষ মসলিন আবিস্কৃত হয়েছিল।
যত সুক্ষ সুচীকর্ম দেখেন তা শুধুমাত্র নারীর মনােরঞ্জনের জন্যেই তৈরি হয়। নারীর রূপ, তারপর আবার পানির সমস্যায় ডুবে গেল। আলো না থাকলে কোনো মতে চলে। অলো না থাকলে পাখা ঘুরবে না, গরমে সেদ্ধ হতে হবে। তবুও তো বাঁচা যায়। পানি না হলে যে একেবারেই চলে না। নদীর ধারে জিয়াদের বাড়ি। পৃথিবীর সমস্ত প্রাচীন সভ্যতা নদীর কূল-কেন্দ্রিক। ছেলেবেলা থেকে সে নদীতে সাঁতরে দুরন্তপনা করেছে। বাজি ধরে ঘন্টার পর ঘন্টা নদীতে ভেসেছে। বর্ষার নদীর পলিমাখা পানিতে ফিটকিরি দিয়ে খাবার পানি করেছে।
তখন তাদের গ্রামে একটিও চাপকলা ছিল না। গাঙের কুলে ঘর বলে গরম কালে পুকুরের পানি কমে যায়, কিন্তু সেটা কখনো খুব বড় সমস্যা ছিল না। বর্ষায় নদী পুকুর বিল থই থই করে। বান হত কোনো কোনো বছর। পলি পড়ে চরের জমি হত উর্বর। পরের বছর সে জমি থেকে দ্বিগুণ ফসল উঠত। এখন আর তেমন করে বান হয় না। কালেভদ্রে বান হলেও চর ডোবে না। সেই জিয়াদের এক জীবনে পানির জন্যে জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। অনেক গ্রামেও এখন পানির সমস্যা।
দলমাদের গ্রামে পাঠিয়ে জিয়াদ অনেকখানি মুক্ত। দু-এক বালতিতে দিন কাটিয়ে দিতে পারে। বালতিতে পানি নিয়ে মাথা ধুয়ে সে পানি গায়ে ঢলে। গামছা ভিজিয়ে গা মুছে নেয় রাতে। গরম পড়ছে যেন রাগ পুষে। এক দিন তাপ উঠল একচল্লিশ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সেদিন রাত তিনটেয় চার বালতি পানি ধরে চমৎকার একটা চান সেরে বিছানায় গেল ঘুমোতে। ক্লান্ত শরীরে ঘুম নামে তাড়াতাড়ি। সকালে অফিসে যাওয়ার আগে আর চান কর না। অনেক দিন পর হালকা শরীর নিয়ে অফিসে গেল। বিকেলে আঙুর এল। ওদের অবস্থা আরো খারাপ হচ্ছে দিন দিন। কলে দিনেরাতে একটুও পানি আসে না। আশপাশ ঘুড়ে পানি সংগ্রহ করে।
আবার দু'দিন নাওয়া নেই। দু রাত বলতে গেলে পানি আসেই নি। মেশিন চালিয়ে পানি তােলা যায় না। বালতিতে রশি বেঁধে সব বাসায় দু’ বালতি করে পানি ভাগ করে দিয়েছে বাড়িওয়ালা। জিয়াদ হােটেলে খেয়ে আসে। মেয়েটি এসে শুধু ঘর ঝাঁট দিয়ে যায়। পানি নেই এ ভাবনাটিই বেশি কাহিল করে দেয়। পত্রিকায় লেখা লেখি চলে। উত্তরবঙ্গে মরুপ্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞ এক রিপাের্টার তার ভাষ্য ছাপে। আর কুড়ি বছরের মধ্যে রাজশাহী অঞ্চল মরুভূমিতে পরিণত হয়ে যাবে, এই মুহর্ত থেকে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। বর্ষায় যে-সব নদী পানিতে খলবল করে সে-সব এখন একে বারে খা খা। এ-গ্রাম থেকে ও-গ্রামে লোকজন ছুটছে। খাবার পানির জন্যে। পদ্মা ও যমুনায় নতুন চর জাগছে ইত্যাদি ইত্যাদি।
সেদিন অঙুির এসে বলল, ভাইজান, আমাগো বস্তির মানুষ। দ্যাশে চইলা যাইতাছে। আমরাও যামু। তিন দিন গোসল নাই। বাঁচনের আর পথও নাই। জিয়াদ বলল, আমিও চান করি না।
সে বলল, আমাগো বস্তির লগে একটা পুকুর আছে। টলটল পানি। মস্ত বড় পুকুর। তার মালিক দিনভর চাবুক লইয়া পাহারায় থাকে। পুকুর পাড়েই চা খায়, সিগারেট খায়। দুপুরে খাইতে গেলে বড় মাইয়ারে রাইখা যায়। এক বদনা পানিও লইবার দেয় না। কাইল ফজর সময়ে অন্ধার থাকতে থাকতে আলীর মা কাপড় ধুইবার গেছিল। ধোওয়াও শেষ কইরা অনিছিল। কিন্তু কপাল খারাপ। ধরা পইড়া গেল। পাষণ্ডটা বেবাক কাপড় কাঁচি দিয়া কাইটা ফ্যাল ফ্যাল কইরা পুকুরে ফেইলা দিল। বালতিখানও এককেরে পুকুরের মইধ্যে।
পরদিন শুরু হল পানির লাইন খোঁড়াখুঁড়ি। ট্যাঙ্কও পরিষ্কার করল। জিয়াদ-এর বুকটা হু হু করে ওঠে। ট্যাঙ্কের তলানির পানিটুকুও নেই। আঙুর এসে বলল, আমারে কিছু ট্যাহা দিবেন ? মাস ত শেষ হয় নাই, যে-কয় দিনের পাই দেন। দ্যাশে চইলা যামু। মায়ও যাইব। ভাইডা শুধু থাকব। ব্যবসাপাতির ট্যাহা আটকা পইড়া আছে। অহন চইলা গেলে সব শেষ হইয়া যাইব।
গ্রামে তোর কে আছে রে ?
বড় ভাইজান আছে। সে জুদা। অরি চাচায় আছে। মাসের শেষ সপ্তাহ চলছে। হাতে টাকা নেই বললেই চলে। তার ওপর দলমার জন্য একটা আটপৌরে শাড়ি কিনেছে। অঙুিরকে বলল, আর কয়টা দিন অপেক্ষা কর। এই দু দিন। পুরো মাসের টাকাই দেব। অঙুিরও বলল গরম শেষ না হলে ওরা ফিরে। আসবে না। দেশ-গ্রামে কাজ নেই। গার্মেন্টসে তার কাজ পাওয়ার অশি। অাছে। কিন্তু পানির কষ্টের সুরাহা না হলে শহরে থাকবে কী করে।
সপ্তাহের শেষ দিনটি আর কাটতে চায় না। পানির লাইনের খোড়াখুড়ি শেষ। দু’ ফুট নিচু করেছে। জিয়াদ পার্কে বসে বিকেলটা কাটাল। বন্ধু ও আত্মীয়ের বাসায় যাওয়ার কথা মনে পড়েছিল। অন্য সময় হলে যেত। মাথায় পানির চিন্তা নিয়ে কারু কাছে গেল না। পার্কে খুব ভালো লাগল না। গাছগুলো কেমন নেতিয়ে পড়েছে। নাগকেশর, অশোক ও জারুল ফুল কেমন ঝিমিয়ে আছে মনে হল। পার্কের পুকুরে অনেক লোক। পাখিরাও নাইছে। ওদের জন্যে শনি বাঁধান ঘাটের দরকার পড়ে না। সে ঘাটের সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেল। ওপরের পানি গরম। একবার ভাবল গায়ের কাপড় সুদ্ধ নেমে পড়বে কিনা! লুঙ্গি ও গামছা আনলে শরীর জুড়োতে পারত। শেষে মুখে ও ঘাড়ে পানি দিল। শার্ট খুলে গায়ে ভালো করে দিল। আবার শাট গায়ে দিল। শার্টের অনেকখানি ভিজে গেছে।
এক মেয়ে। শাড়ির নিচে হাত দিয়ে ভরা বুক মাজছে। ফাক দিয়ে মাঝে মাঝে পূর্ণতা দেখা দেয়। ওদিকে নেমেছে অারো দু জন। সিঁড়িতে কাগড় ধুচ্ছে পুরুষরা। সেই মেয়েটি কাপড় বদলাত বদলাত জিয়াদের দিকে তাকাল। চোখে চোখ পড়ল। প্রায় অঙুিরের বয়েসী, কিন্তু বিবাহিতা মনে হয়। মেয়েটি হাসল না, কিন্তু শাসন করল। নিজেকেও শাসালো ঘুরে দাঁড়িয়ে। জিয়াদ তথন প্যান্ট গুটিয়ে হাঁটছে। সে নাগকেশরের গন্ধ পায়। অশথ গাছে কয়েকটা দাঁড়কাক চুপচাপ বসে আছে। বেশ কয়েক মিনিট ধরে ওরা ডাকছে না। এরকম মৌনব্রত নিলে ওদের গরম কমে কিনা ওরাই জানে। চুপচাপ থাকলে কি অয় বাড়ে ? সেও অনেকক্ষণ কথা বলছে না। কার সঙ্গেই বা বলবে, একা একা কি কথা বলা চলে?
হঠাৎ তার খুব গান গাইতে ইচ্ছে করল। চৈত্র পবনে মম চিত্ত বনে’ গানটি কেন মনে পড়ল কে জানে! দলমা না থাকলেই শরীর টাটাতে থাকে। মাহবুবের প্রস্তাবের কথা মনে পড়ে। একা একা থাকলে অনেক মুখ মনে পড়ে যায়। পুরনাে প্রেম, পথের দেখা নারীর সঙ্গ কামনায় অকিৗশ-কুসুম গড়ে। শুধু ভাবে কে যেন আসবে। এসে ডাকবে দরজা খুলতে। পার্কে দেখা প্রতিটি নারীকে সুন্দরী ও ভালোবাসার যোগ্য ভাবে। দু' দিন আগে মাহবুবের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল ওর দোকানে। খুব সস্তায় একখানা শাড়ি দিয়েছিল। বলেছিল পানি সমস্যার কথা। দলমাদের গ্রামের পাঠানর কথা। মাহবুব বলেছিল, একা আছিস ? সময় কাটে কি করে ? সঙ্গী চাই তাে বল। ঐ যে দেখছিস পেছন ঘুরে আছে মেয়েটি। সে খবর নিতে এসেছে। ওকেও নিতে পারিস। বাসায় চলে যাবে। সারা দিনও রাখতে পারিস, রাতেও।
পার্কে সন্ধে কাটিয়ে হোটেলে গেল খেতে। কোনো মতে এক থালা খেয়ে বাসায় ফিরল। পানি আসে নি। অারো এক দফা ক্লান্তি জাপটে ধরল। এত ক্লান্ত যে বিছানায় পড়াই শুধু বাকি। বিছানাও ডাকছে। তবুও জাগতে হবে। বাড়ির দু' নম্বর মালিক বয়সে তরুণ। জিয়াদ থেকে অনেক ছোট। সে অশ্বাস দিয়ে গেল পানি আসবে বলে। ভােরে পানি পাওয়া যাবে। রাতটা নিশ্চিন্তে ঘুমুতে বলল। সপ্তাহের শেষ দিন। ছুটির দিন ঘুম থেকে উঠে পানি মিলবে বলে গভীর আশ্বাস দিয়ে গেল । জিয়াদও আর রাত জাগবে না ভেবে বিছানায় গিয়ে টানাটান হয়ে শুয়ে পড়ল। তারপর বালিশটী কোলে টেনে নিল। ঘুম আসবে বৈকি! পার্কের স্নানরতার ছবি মনে পড়ে চকিতে। মাহবুবের সেই মেয়েটিও কম কি । একা থাকলে কত ভাবনা।
ঘুম ভাঙা দেরিতে। সূর্য উঠতে উঠতেই চরাচর গরম করে তুলছে। জিয়াদ ক্লান্তি নিয়ে আরো কিছুক্ষণ পড়ে রইল। বিছানা ছাড়তেও ভয়। যদি পানি না আসে! কনের মুখ বন্ধ করে রেখেছে। মেশিন ছাড়ার শব্দও পায় নি। ঘুম হচ্ছে মৃত্যুর যমজ ভাই। শরীরে এক মুঠো জোর নেই। তার চেয়ে ভয় যদি পানি না আসে। এমন সময় দরজার কড়া নড়ে উঠা। ছুটির দিনে কে এত সকাল সকাল কড়া নাড়তে পারে ভাবতে ভাবতে জিয়াদ উঠল। মাথার ওপর পাখা ঘুরছে বনবন। গেঞ্জিটা-লুঙ্গিটা পাশ থেকে টেনে নিল। একা থাকলে সে এরকম শোয়। উলঙ্গ শোওয়াটা তার বিলাস।
দরজা খুলতেই দেখে আঙুর। এক ঝলক মোহনীয় হাসিতে মুহর্তের মধ্যে জিয়াদের শরীরে ঝড় বইয়ে দিল। থর থর করে কেঁপে উঠল সেই ভুবনমােহিনী হাসিতে। দলমার সঙ্গে প্রথম পরিচয় ও হাসির মুহর্তগুলো ছবির মতো ছুটে এল। জিয়াদকে এক রকম ঠেলে আঙুর ঢুকল। দরজা বন্ধ করতে করতে বলল, পানি আইছে, পানি আইছে।
পানি এসেছে ? পানি? সত্যি !--আর এক মুহুর্তও দেরি না করে আঙুরকে এক রকম ধাক্কা দিয়ে ঠেলে এক টানে গেঞ্জি খুলে, ছুড়ে ফেলে এক লাফে বাথরুমে ঢুকে পড়ল। দরজা বন্ধ করে এক মোচড়ে ঝর্ণা খুলে দু হাত তুলে দাঁড়িয়ে পড়ল। আফ্রিকার আদিবাসীরা প্রকৃতির কাছে যেমন প্রার্থনা জানায় তেমনি দু হাত তুলে দাঁড়াল। পানি অসাও প্রকৃতির আশীর্বাদ। জিয়াদ মনে করে প্রকৃতি ছাড়া মানুষের বাচার আর কোনো উপায় নেই।
মানুষ প্রকৃতি থেকে দু হাতে গ্রহণ করে নিষ্ঠুরের মতো, কিন্তু প্রকৃতিকে দিতে চায় কৃপণের মতাে। প্রকৃতিও এক সময় রুদ্র রূপ নিয়ে এক হাত দেখে নেয় মানুষকে। আনন্দে উল্লাসে জিয়াদ হাত তুলল, ফুর্তিতে গান ধরল, জলতরঙ্গ বাজে..••••। কেন এ গানটি মনে পড়ল সে জানে না। সারা গায়ে দু' হাত খেলা শুরু করছে। চোখ-মুখ-কপাল ঘষল। কানের পেছনের ঘাম তুলল। বগলের নিচে সাবান মাখল। বুকের ছাতি ফোলাল। নিজের উদোম শরীরটা বার বার দেখল। একান্ত অন্তরঙ্গ অঙ্গে সাবান দিতে দিতে কিছুক্ষণ খেলা করল। মাথার ওপর ঝমঝম ঝর্ণা আর শরীরনিয়ে খেলায় সুখ খুঁজল।
দলমা না থাকলে শরীর নিয়ে নাড়াচাড়া করতে ভালো লাগে। মনে পড়ল গ্রামের নদীতে সাঁতার কাটার স্মৃতি। ভাদ্রের গরমে নদীতে সাঁতার কাটার মতাে দুরন্ত অনিন্দ আর কিছুতেই হয় না। সারা শরীর জলের স্পর্শে রোমাঞ্চিত হয়ে ভেঙে ভেঙে পড়ে। এ জন্যেই বুঝি মানবসভ্যতা নদীকেন্দ্রিক। এজন্যে জলই জীবন। এজন্যে পানির অভাবে এত উত্তেজনা, এত বিষাদ, এত উদ্বেগ। পানি আসার সঙ্গে সঙ্গে তাই সে শরীর নিয়ে পড়ল।
মুহূর্তে মুহর্তে মনে পড়ে একেক কথা। ছেলেবেলার কথা, কৈশােরের কথা, দলমার। গ্রামে ফেলে আসা সেই মেয়েটি তাকে বার বার কাছে ডেকে চুমু খেত। এক বার মাত্র শোনা একটি গানের কথা মনে পড়ল। একদিনের খাওয়ার কথা মনে পড়তেই হঠাৎ খুব খিদে পেল। আঙুরকে বললেও হত। ডিম ও আলু সেদ্ধ বসতি। বয়ামে টমেটোর জেলি থাকতে পারে। মিরতিঙ্গা চা বাগান থেকে একজন কিছু উৎকৃষ্ট চা পাঠিয়েছে ক'দিন আগে। আর মেয়েটি কেমন তাও ভাবল মনে মনে। সে কি করছে এখন ? অাবার গান গেয়ে উঠল, আমার এ ভালোবাসা কি যে তার নাম...।
কতক্ষণ কল খুলে শরীর জুড়িয়েছে...কতক্ষণ আকাশপাতাল ভেবেছে...। তারপর মনে পড়ল লুঙ্গি তোয়ালে কিছুই নেয় নি। অঙুিরকে ডাকতে তো হবেই। গলা খুলে ডাকল, আঙুর, একটা লুঙ্গি আর গামছা দে। মনে আর কোনো অলসতা বুঝি নেই। কোনাে গ্লানি বা অভিযােগ নেই কারো প্রতি। শুধু অঙুিরের ভাবনা মনের ভেতর খচখচ করছে। তাই তাড়াতাড়ি ঠিক করল দলমী ও ছেলেমেয়েদের নিয়ে আসার কথা।
একটা চিঠি লিখবে দলমাকে। কতদিন দলমাকে চিঠি লেখার সুযোগ হয় না। দলমার প্রতি তীব্র আকর্ষণ অনুভব করল। দরজা খুলে বের হতেই দেখে আঙুরের চোখে-মুখে করুণা। টেবিলে খাবার পরিবেশন করছে সে। এক জোড়া ডিম পোচ। একসঙ্গে এক জোড়া ডিম দিল কেন? সে তো এক জোড়া ডিম কোনাে দিন খায় না। রাঙা আলু সেদ্ধ থেকে ধোঁয়া উড়ছে।
খোসা খুলে পরিপাটি করে চিনো মাটির বাটিতে রেখেছে। ঢাকা দিয়েছে কাচের প্লেট দিয়ে। খাবার ঢাকাও হল আবার দেখাও যায়। এত সুন্দর করে পরিবেশন করেছে যে জিয়াদের চোখে পড়ল। পাশে জেলির বয়াম। তলায় পড়ে আছে। বিস্কিটও আছে। আরেকটা টিনে কি আছে কে জানে। চা বানিয়ে পটে ঢেকে রেখেছে। চিরুণি হাতে দাঁড়াতেই আঙুরের সঙ্গে অয়নায় চোখাচোখি হল। সে বাথরুমে মাজছে । এইমাত্র সে বলেছে ওদের পানির কষ্ট মিটবে না। একটা ডোবা থেকে পানা সরিয়ে ধোয়ার কাজ সারে। ওদের বস্তির মালিক বলে দিয়েছে পানি আসার কোনো সম্ভাবনা নেই।
খুশির চোটে একটা ডিম অঙরের জন্যে রেখে দিল। রাঙা আলুর ভাগ রাখল। এক বার ভাবল দলমার জন্যে কেনা শাড়িটা আঙুরকে দেবে কিনা। তাহলে সে চান করতে পারবে। গায়ের ঘাম কত দিন পরিষ্কার করতে পারে না সে-ও ! মেয়েটি ভালো। আবার ভাবল, নতুন শাড়ি দেওয়ায় যদি অন্য অর্থ করে। ঘরে ঢোকার সময় হাসির অর্থ কি শুধু পানি আসার জন্যে! নাকি আচ্ছন্নতা ? দ্বিধা ও দ্বন্দ্ব শেষ করে সে উঠল।
অলিমারী খুলে শাড়ি খানা নিল। নতুন কাপড়ের একরকম গন্ধ আছে, একরকম মাদকতা অাছে, অাছে আনন্দ। পায়ে পায়ে বাথরুমের দরজায় গিয়ে দাঁড়াতেই বুকের দুরু দুরু। শুনল। শরীরে শিহরণ খেলে গেল। আর...হাতের চাপে নতুন শাড়ি শব্দ করে উঠল।
Post Comment
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন