দীর্ঘ কুড়ি বছর স্বেচ্ছানির্বাসনে থেকে কোব্বাদ মিয়া ডাক্তার হয়ে গ্রামে ফিরে এসেছে। দেশে ডাক্তারের সংখ্যা খুব কম। দু-দশ গ্রামেও একজন এল. এম. এফ, ডাক্তার নেই, গ্রামের মানুষদের ডাক্তারি বিধান দেয় কবরেজ-হোমিওপ্যথিরা। তখন দেশে সবেমাত্র ধনন্তরি পেনিসিলিন এসেছে। হাতুড়ে ডাক্তাররা সাধারণ জ্বর ইত্যাদি সব রকম রোগে ঐ পেনিসিলিন দিতে শুরু করেছে। গ্রামের মানুষও একদিনে ভালো হয়ে মাঠে চলে যায় কাজকর্মে। সে-সময় অদ্ভুত স্বভাবের কোব্বাদ ডাক্তার এসে ডিসপেনসারি খুলে বসল বাজারের এক মাথায়। সারাক্ষণ চুরুট মুখে থাকে, আর লোক পেলেই শুরু করে বকবক গল্প।
ডাক্তারির কী বোঝেন কে জানে? কোথায় শিখেছে কেউ জানতে চাইলে লম্বা ফিরিস্তি দিয়ে বসে, সেই ফিরিস্তি থেকে আসল সত্য বের করা খুব কঠিন। কিন্তু তার দরাজ গলা, প্রাণ খুলে হাসির শব্দ কিংবা দেখা হলেই ভালো-মন্দ খোজ-খবর নেওয়ার জন্যে লোকজন দু দিনেই তাকে আপন করে নিল। ছোটকাল থেকেই তার এই স্বভাব। মাঝখানে দীর্ঘ কুড়ি বছর দেশের বাইরে থাকার জন্যে তার সম্পর্কে নানা কাহিনী গড়ে উঠেছে। এখন তো সে আর পনেরো বছরের কিশোর নেই, কিংবা বেকারও নয় যে সবাই করুনা করবে। বরং ডাক্তারহীনগ্রামে সে একজন ডাক্তার হয়ে ফিরে এসেছে, সকলেই তাই তাকে সমীহ করে, খাতির রাখতে চেষ্টা করে সবাই। রাতারাতি সে এভাবে শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে উঠল। কিন্তু দীর্ঘ বিশ বছর গ্রাম থেকে অনুপস্থিত সে, কেউ কিছু জানে না তার সম্পর্কে—আর জানে না বলেই কৌতূহল সবার। সেই কৌতুহলও একদিন থিতিয়ে পড়বে, কোব্বাদ ডাক্তারও হয়তো সবার মতো ভিড়ে হারিয়ে যাবে।
কারও বাড়িতে ডাক্তার হিসেবে রোগী দেখতে শুরু করার আগেই একটা কাণ্ড ঘটল। গরমের এক সকালে কোথা থেকে একটা খেঁকিকুকুর তার ডিসপেনসারির সামনে এসে মরতে বসল। কোব্বাদ ডাক্তারঘেন্নাপিতি বিসর্জন দিয়ে কুকুরটাকে কোলে করে ডিসপেনসারিতে তুলল। জলাতঙ্ক রোগ নয়, তাহলে তো পাগল হয়ে মানুষ কামড়াতে ছুটত।
সকালের বাজার জমে উঠেছে রোজকার মতো, লোকজন তরিতরকারি নিয়ে দোকান খুলে বসেছে, মুদি দোকানদার খদ্দেরের আশায় বসে আছে। লোকজনের ভিড় দেখে কোব্বাদ ডাক্তার তার স্বভাবসুলভ ধৈর্য হারিয়ে বকাবকি শুরু করল। সকলকে একে একে ডিসপেনসারি থেকে তাড়িয়ে দিয়ে কুকুরটাকে নিয়ে বসল। কম্পাউণ্ডার নেই তার, তাই সাহায্য করার জন্য অনিড়ি এক লোককে হাত ধরে টেনে ঘরের মেঝেয় বসিয়ে দিল। বলল, কুকুরটা ধরো। মরতে বসা কুকুরটাও চিৎপাত শুয়ে চুপ হয়ে রইল। কোব্বাদ ডাক্তার আলমারি খুলে ইনজেকশনের সিরিঞ্জ, ডিসটিল ওয়াটারের এ্যাম্পুল এবং পেনিসিলিন বের করে নিল। একজন মানুষকে পেনিসিলিন দিতে যা যা করতে হয় প্রত্যেকটি কাজ নিষ্ঠার সঙ্গে করল। স্পিরিটের বাতি জ্বেলে গরম জল করা, সিরিঞ্জ ধুয়ে বীজাণু মুক্ত করা—কোনাে কাজ বাদ দেয় নি। তারপর কুকুরটার পেছনের বা পায়র উরুর লোম সরিয়ে তিরিশ লাখ পেনিসিলিন পুরে দিল মমতা ভরে। সিফিলিস বা ভাইরাস রোগে তখন পেনিসিলিন মহৌষধ।
ইনজেকশন দেওয়ার সময় শার্টের আস্তিন গোটাতেই কোব্বাদ ডাক্তারের বাঁ হাতে দেখা গেল মাছের এক উল্কি। মীন রাশির দুটি মছি পাশাপাশি আঁকা। লােকটি হাঁ করে তাকিয়ে রইল ডাক্তারেরদিকে। গ্রামে উল্কি আঁকা লোক একটাও নেই। চা বাগানের মেথর সর্দারের বাড়িতে উল্কি আঁকা লোক আছে। আর উল্কিদার ঐ কুলি সর্দার সবার কাছে শ্রদ্ধেয় এবং অনেকটা রহস্যময় ও দুর্জেয় লোক। চা বাগানের কুলিরা প্রায় সবাই সঁওতাল। তারা উল্কি আঁকে না মেথরদের মতো। সাঁওতালদের কলো রঙের শরীরে উল্কি মানায় না। তবুও কেউ কেউ কচিৎ উল্কি আঁকতে চায় বৈকি ! কিন্তু উকি অাঁকতে জানা লোক এ তল্লাটে একজনও নেই। কোব্বাদ ডাক্তারের হাতে উল্কি দেখে তাই সমীহভরে তাকিয়ে রইল লোকটি।
কোব্বাদ ডাক্তারের কুকুরকে ইনজেকশন দেওয়া আর উল্কির কথা একদিনেই পাড়াময় রাষ্ট্র হয়ে গেল। পরদিন কুকুরটাও উঠে দাঁড়াল এবং দিব্যি সুস্থ হয়ে খাওয়া-দাওয়া, পা তুলে পেচ্ছাব করা ইত্যাদি কুকুরের স্বভাব মতো সব কাজ শুরু করল। কোব্বাদ ডাক্তারেরও নামডাক হয়ে গেল এক লহমায়। চা বাগানের বস্তিতে খবর রটে গেল, রােগীর ভিড় বাড়তে লাগল। ডিসপেনসারিতে একজন লোক রেখে কম্পাউণ্ডারি শেখাতে লাগল কোব্বাদ ভাক্তার।
বাজার থেকে মাইল খানেকের মধ্যেই বাগান, বাগানের কারখানা থেকে সারাদিন শোনা যায় ঘণ্টা পেটানোর শব্দ, রাত যত গভীর হয়। ঘন্টার শব্দ হয় আরও বড়, মাঝে মাঝে বাতাসের তোড়ে ভেসে অাসে শুকোতে দেওয়া চায়ের গন্ধ। ছুটির পর কারখানা থেকে কুলিমজুররা বেরিয়ে আসে হল্লা করে, আদিবাসীরা চলে যায় নিজেদের বস্তিতে, মদের দোকানে জমে ওঠে ভিড়। কোব্বাদ ডাক্তারেরও আনাগোনা শুরু হল বস্তিতে, কুকুরটিও ছায়ার মতো তাকে অনুসরণ করে সবখানে। কুকুর তো অকৃতজ্ঞ নয় ; প্রভু বলো, জীবনদাতা বলো, সেতো ঐ কোব্বাদ ডাক্তার কুকুরটি তার ডাক্তারি পেশায় প্রতিপত্তি বাড়িয়ে দিল প্রথম দিনেই, আর ডাক্তারও তাকে তাড়াতে পারল না। এভাবে শুরু হল তাদের পরস্পর পরস্পরের নির্ভরতা।
সেই নির্ভরশীলতার কোনাে সংজ্ঞা নেই, সীমরেখাও টানা যায় না। কোব্বাদ ডাক্তার বিয়ে-বউহীন মানুষ। ঘরে আছে সমবয়সী খুড়ো, খুড়োর পরিবারেই খায়-দায়। পাড়াপড়শী তাকে ভালোবাসে, রোগশোকে ডাকে, মাঝে মাঝে কাউন্সিলের বিচার-আচারেও ডাক পড়ে। তবে পারতপক্ষে সে ওসব ঝামেলা এড়িয়ে চলে।
বাগানে গরমের দিনে কলেরা, বর্ষায় আমাশয় বা মাঘ-ফাগুনে বসন্ত রােগের উৎপাত লেগেই আছে। বাগানের ডাক্তার থেকে ওরা ওষুধপত্র, বিধি-ব্যবস্থা পায়। কিন্তু কোব্বাদ ডাক্তারের প্রতিপত্তি সেই ডাক্তার ঠেকাতে পারল না। সে উল্কি আঁকতে জানে। তাই অনেকেই তার করুণা চায়। কিন্তু উল্কি অাঁকার ব্যাপারে সে কারও কথায় ওঠবস করে না। মেথরদের মধ্যে উল্কি অাকার রেওয়াজ তো আছে, দুএকজন করে সাঁওতালও উল্কি আঁকার জন্যে তার কাছে ধরনা দিতে শুরু করেছে। কিন্তু এ ব্যাপারে সে হিসেবের বাইরে এক পাও হাটবে না ।
কুলি সর্বদারের ছেলের গায়ে তীর-ধনুকের উল্কি একে দেওয়ার পর তার প্রতিপত্তি বেড়ে গেছে। ঝমরু সেই থেকে শিকারে গেলে কোনােদিন খালি হাতে ফেরে না। বন শুয়োর, বন মোরগ এমনকি একদিন অস্তি একটি হরিণ শিকার করে নিয়ে এল। যদিও হরিণের চেয়ে শুয়োরের মাংসই তাদের বেশি প্রিয় তবুও দুর্লভ হরিণ শিকার করার পর ঝমরুর নাম তার বাবার চেয়েও বেড়ে গেল।
কোব্বাদ ডাক্তারের মনে তবুও শান্তি নেই। তার ডাক্তারিবিদ্যা আর উল্কি আঁকা শেখার অনেক কাহিনী আছে। সেসব কথা সে কাউকে কোনোদিন বলে নি। মাঝে মাঝে বলতে খুব ইচ্ছে করে।
ছোটকাল থেকে সে অনেক দেখেছ, অনেক ঘুরছে। দীর্ঘ কুড়ি বছর সে দেশছাড়া ছিল। মাঝে মাঝে তার বুকের ভেতর হাহাকার ওঠে। যখন সে উল্কি আঁকা শেখে তখন তার গুরু একটি কথা বলত—উল্কি আঁকা সৌন্দর্যচর্চার অঙ্গ। এক সময় সে উল্কি আঁকতে শেখে। তার নিজের গায়ে যখন একে একে উল্কির সুইয়ের ফোঁড় লাগে, সিঁদুরের রঙে ডোবানো সুই যখন তাকে একে একে বিদ্ধ করে, সে-যন্ত্রণার মাঝেও তার একমাত্র অকাঙক্ষা সে উল্কি আঁকতে শিখবে। আদিম সমাজে কবে থেকে এর সুত্রপাত তা কোব্বাদ ডাক্তার জানে না। শুধু জানে যে এখনও আদিম সমাজের মানুষ উল্কি আঁকে।
সুন্দরী নারীর শরীরে একটি ছোট উল্কি কী মোহনীয় আকর্ষণ সৃষ্টি করে সে তার নির্বাসন জীবন কাটানোর সময় দেখেছে। উৎকল দেশ ঘুরতে ঘুরতে সে এই নিয়ে অনেক ভেবেছে। মাদ্রাজ ও পুরীর সমুদ্র তীরে সে খুজেছে সুন্দরী তরুণী। তার গুরু তাকে বলেছিল, খবরদার শুধু টাকার লোভে কারও গায়ে উকি আঁকিতে হাত বাড়াবে না। সৌন্দর্যচর্চার নামে তুমি এই বিদ্যা আমার কাছ থেকে শিখতে পেলে। গুরু তাকে আরও বলেছিল, কালো ছিপছিপে ভারী উরুর কোনাে মেয়ের শরীরে নির্লোভ একাগ্র মনে যদি উল্কির অকে, তবে সেই নারী পাবে উল্কির প্রাণীর সব গুণাগুণ। মন দিয়ে উকি আঁকবে, প্রতিটি ফোঁড় দেবে মমতা ভরে, আর মনে রাখবে এ-কাজ শিল্পকর্মের অঙ্গ, যে-নারীর গায়ে উকি আঁকবে তার প্রতি কখনও লালসার হাত বাড়াবে না। শুদ্ধ শিল্পে ও সৌন্দর্যচর্চাতেই মানুষের মুক্তি।
সেই থেকে কোব্বাদ ডাক্তার খুজে বেড়াচ্ছে তেমন একজন নারীকে, কিন্তু কোনো নারীর উরু দেখা তো সহজ নয়। একমাত্র অভিজ্ঞ লোকই শুধু পায়ের গোড়ালি দেখে উরুর লঘু-গুরু মপি আঁচ করতে পারে। পায়ের গোড়ালি যাদের একটু ভারি তাদের উরুও ভারী হতে বাধ্য। কোব্বাদ ডাক্তার নানা লোকের কাছে কম্পাউণ্ডারি ও ডাক্তারি শিখেছে। ডাক্তারি শিখতে শিখতে উল্কি অাকার কথা সে ভােলে নি। শরীরবিদ্যা তো একদিনে শেখা হয় না। আর শরীরের অন্ধিসন্ধি মনে রাখতে গিয়ে সে ভোলে নি উল্কি -গুরুর কথা। বাগানের কুলি মেয়েদের সে দেখে, ডাক্তারি করতে গিয়ে অনেক নারীর সংস্পর্শে আসে, কখনো। কখনাে মশারির বাইরে থেকে রোগীর সঙ্গে কথা বলে, রোগীকে ব্যবস্থাপত্র দেয়। পর্দানশীন মেয়েদের চিকিৎসা করার দুর্ভোগ এবং তাদের সংস্পর্শে এসেও তাদের দেখতে না পাওয়া—একমাত্র গ্রাম্য ডাক্তাররাই এই সমস্যার মুখোমুখি হয়। কিন্তু চোখ-কান সে বরাবরই খোলা রাখে।
এক সন্ধেয় কোব্বাদ ডাক্তার বস্তি থেকে ফিরছে। কুকুরটিও তার আগে আগে, পিছে পিছে। হঠাৎ তার পাশ দিয়ে এক তরুণী চলে গেল। ছিপছিপে গড়ন, গায়ের রঙ উজ্জল শ্যামল। বেণী দুটি ঝাঁপিয়ে পড়েছে পিঠ ছাড়িয়ে নিতম্বে। কুকুরটি সঙ্গে সঙ্গে এমন শব্দ করে উঠল যে, মেয়েটি তাই হয়তো ভয় পেয়ে আরাে জোরে হনহন করে চলে গেল । কেন যে কুকুরটি এভাবে ডেকে উঠল, বা কুকুরকে চুপ করতে বলার সময়ও সে পেল না। আর আলো-আঁধারেও সে আঁচ করে নেয় মেয়েটির উরু হবে সুগঠিত, সঙ্গে সঙ্গে তার শরীরে রোমাঞ্চকর অনুভূতি খেলে গেল। কিন্তু ভালাে করে দেখা এবং কথা বলার আগেই মেয়েটি বস্তির ঘর-বাড়ির উঠোন দিয়ে কোথায় হাওয়া হয়ে গেল।
ডিসপেনসারিতে ফেরার পর সে কাজে মন বসাতে পারল না। কম্পাউণ্ডারকে কিছু না বলে ছুটি দিয়ে দিল। কুকুরটাকে রীতিমাফিক আদর করে ভেতরের কামরায় ঢুকে চুরুট জ্বেলে আরাম কেদারায় গা এলিয়ে ভাবতে লাগল, বস্তিতে যখন দেখা পেয়েছি তাকে খুঁজে পাবই। ডিসপেনসারিতেই ডাকব, উল্কি একে দেব বললে সে স্বেচ্ছায় চলে আসবে, এসে উল্কির মধুর যন্ত্রণা হাসিমুখে গায়ে তুলে নেবে।...তারপর। উল্কির ছবির গুণাগুণ পেয়ে সে চা-বাগান দাপিয়ে বেড়াবে।
পরদিন...তারপরও কয়েকদিন কেটে গেল। কোব্বাদ ডাক্তার আর সেই মেয়েটিকে দেখতে পায় না। নামও জানে না যে কাউকে জিজ্ঞেস করবে। প্রতিদিন বস্তিতে চলে যায় সে, রােগী দেখার ডাক আসুক না আসুক বস্তির গলিতে গলিতে বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে সে খোঁজ-খবর নেয়। সবাই যখন চা বাগানে চলে যায় তখনও ছুটে যায় বস্তিতে। এক দুপুরে মংলু সর্দারের বাড়ির পাশে মেয়েটির সঙ্গে অবিার দেখা। অমনি তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করল, কাদের মেয়েগো তুমি?
ওমা তুমি চেনো না বুঝি, ঐ যে আমার বাড়ি, সর্দারের পাশের বাড়িই তো! এই বলে তাড়াতাড়ি তাকে ঘরে নিয়ে গেল। কথা বলতে বলতে ডাক্তার শুধু ভাবছে, এইতো সেই মেয়েটি যাকে সে দীর্ঘদিন ধরে খুঁজে বেড়াচ্ছে। পায়ের গোড়ালি দেখে আবার বিড়বিড় করে বলল, কী সুন্দর, কী সুন্দর! মেয়েটির শরীরের গড়নও অস্বাভাবিক সুন্দর। এমন সৌন্দর্য সচরাচর চোখে পড়ে না। মেয়েটি তাকে গুড় দিয়ে এক গ্লাস জল খেতে দিল। হাজার হোক ডাক্তার মানুষ, উল্কি আঁকিতে জানে।
লোকে বলে তার অসীম ক্ষমতা, সে ইচ্ছে করলে অদ্ভুত সব কাণ্ড করতে পারে। মানুষের শরীরে উল্কি একে অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী করে দিতে জানে।
চৈত্রের গরমের দুপুরে এক গ্লাস পানি ও গুড় তার শরীর জুড়িয়ে দিল। তারপর সে মেয়েটির নাম জেনে নিল, এবং আস্তে আস্তে লখিয়াকে বোঝাতে শুরু করল। লখিয়া তো নিজেই উল্কি অাকার কথা বলত, কিন্তু তার আগেই কোব্বাদ ডাক্তার তার ব্যাগ থেকে একটা ছবি বের করে দেখাল। ছবিটি রানী মৌমাছির। তারপর মেলে ধরল রানী পিপড়ের ছবি। তারপর একটি অতিকায় মাকড়সার ছবি বের করতেই লখিয়া চোখ বুজে চুপ করে গেল।
আরেকটি ছবিতে রানী মৌমাছি। পুরুষ মৌমাছিকে হুল ফুটিয়ে মেরে ফেলছে দেখেই লখিয়া কেঁপে উঠল। কোব্বাদ উক্তিার বলল, সঙ্গম শেষে পুরুষ মৌমাছির জীবনে নেমে আসে এই ভয়াবহ পরিণতি।
কোব্বাদ ডাক্তার জিজ্ঞেস করল, তুমি উল্কি আঁকবে? তোমার মতো মেয়েদের জন্ম হয়েছে পুরুষদের শাসিয়ে বেড়াবার জন্যে। তুমি চাও তাে মৌমাছি বা মাকড়সা যে-কোনাে একটি উকি অকতে পারো, তাদের শক্তি করায়ত্ত করতে পারো। পৃথিবীতে শক্তিমতী হয়ে বেঁচে থাকার মতো সুখ আর নেই।
শুনতে শুনতে লখিয়ার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল। বলল, না না, ও-কথা বলবেন না, আমি ঘর-সংসার নিয়ে সবার মধ্যে বেঁচে থাকতে চাই। কিন্তু মনে মনে সে লোভী হয়ে উঠল। পুরুষ মানুষকে হাতের মুঠোয় নিয়ে আসা...তার কুমারীদেহে এক অজানা শিহরণ খেলে গেল, সঙ্গে সঙ্গে অচেনা ভয়ও তাকে জাপটে ধরল। এই দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ডুবে সে বলল, অমন কথা বলবেন না, আমার খুব ভয় করছে। তারচেয়ে একটা মহুয়া ফুলের উকি একে দিন আমার হাতে।
বসন্ত শেষ হতে বসেছে। চা বাগানের কোথাও মহুয়া গাছ অাগের মতো নেই। আগে বাগানের কয়েকটি টিলা জুড়ে ছিল মহুয়ার বন। আদিবাসীরা মহুয়া খেয়ে নেশায় মেতে থাকত বলে বাগনি কতৃপক্ষ ধীরে ধীরে মহুয়ার বন শেষ করে দিয়েছে। কোব্বাদ ডাক্তার দেখল মেয়ের্টির মনের গভীরে সুপ্ত আকাঙক্ষা আছে। তাই আস্তে আস্তে সে তার মনের পর্দায় রঙ লাগাতে শুরু করল। বলল, হ্যা, মহুয়ার উকি আমি একে দিতে পারি, কিন্তু তুমি বোধ হয় জানাে না আমি যাকে তাকে উকি একে দিই না। সর্দারের ছেলের গায়ে এঁকে দিয়েছি। তুমি তো সাধারণ নও, তুমি সেই নারীর বংশ যে পুরুষের মুখে লাগাম দিয়ে দাশখত লেখাতে পারে। তােমার এই সৌন্দর্য দিয়ে তুমি হতে পারে সর্বশ্রেষ্ঠ নারী, এই বাগানের পুরুষ হবে তোমার করুণা-প্রাথী।
লাখিয়ার আদিম রক্তে ঢেউ খেলে গেল। মাতৃতান্ত্রিক সাঁওতাল সমাজে নারীই সর্বেসর্বা, কাজেই এই সুযােগ সে ছাড়তেও চায় না। সে লোভী হয়ে উঠল।
পরদিন লখিয়া কোব্বাদ ডাক্তারের ডিসপেনসারিতে গেল। নদীর ধারে বাজার, দুপুরের ঝাঁ ঝাঁ রোদ চারদিকে, লোকজন নেই। কম্পাউন্ডার বসে বসে ঝিমুচ্ছে, ডাক্তার ভেতরের ঘরে আরাম কেদারায় বসে চুরুট টানছে। লখিয়া তখন ঘরে ঢুকল। ডাক্তার বুঝল লখিয়র রক্তে উল্কির নেশা ধরেছে।
লখিয়া বলল, আমার বাবাকে বলেছি, তুমি আমাকে মহুয়ায় উকি একে দেবে ? কোব্বাদ ডাক্তার তবুও আশা ছাড়ে না, সে জানে একবার যখন উল্কির নেশায় পেয়েছে তখন লখিয়াকে ইচ্ছেমতো চালান যাবে। কোব্বাদ ডাক্তার তখন উঠে আলমারি থেকে একটা ছবি বের করল। রানী ক্লিওপেট্রার ছবি। লখিয়া জানে না ক্লিওপেট্রা কে। কিন্তু ছবির রাজরানী রূপ তার স্নায়ুতে শিহরণ জাগিয়ে দিল। কোব্বাদ ডাক্তার তাকে বলল, কে এই রানী জানো? পৃথিবীর সমস্ত পুরুষ একদিন এই নারীর অনুগ্রহ কামনা করত, সঙ্গ-কামনায় উন্মত্ত হয়ে উঠত। রানীও তার পছন্দমতো পুরুষকে বুকের কাছে টেনে নিত। পুতুলের মতো পুরুষরা রানীর ইচ্ছার কাছে লুটিয়ে দাসখত লিখে দিত।
লখিয়ার তরুণী দেহে শিহরণ খেলে গেল। শরীর থেকে স্বেদবিন্দু ঝরতে লাগল। সে কী করবে বুঝতে পারল না। তার মনের কোণে জমে আছে একটি সংসারের স্বপ্ন, চা বাগানের ছায়াচ্ছন্ন জীবন, উৎসবের দিনে মাদলের নৃত্য-গীত, তারপর অাকাঙিক্ষত পুরুষের সঙ্গে রাত্রিবাস... লখিয়া কোনোমতে জোর করে বলল, একটি মাদার ফুলের পাশে যদি মাদলের উল্কি আঁকতে চাই ? তুমি দেবে না?
সেদিনও কোব্বাদ ডাক্তার লখিয়াকে যেতে দিল দ্বিধা-দ্বন্দ্বের অবসান না ঘটিয়ে। লােকজন, বাজারবাসী সবাই জানে কোব্বাদ ডাক্তার ভালোমানুষ। পাড়া-পড়শীরা তাকে দেবতাতুল্য শ্রদ্ধা করে। চা বাগানের সর্দার, কুলি কেউ তার সাহায্য ছাড়া বাঁচতে পারে না। কোব্বাদ ডাক্তার দেখতে চায় তার নিজের সৃষ্টি। সৌন্দর্যের পাশাপাশি ধ্বংসের রূপ স্বচ্ছন্দে সহাবস্থান করতে পারে কিনা, তার দীর্ঘ ভবঘুরে জীবনের বিচিত্র শিক্ষার সঙ্গে এই স্থির জীবনের মিল কোথায় তা পরখ করে দেখতে চায়।
বসন্তের মহুয়া খেয়ে ভালুকও নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে, আদিবাসীরা উৎসবে মেতে ওঠে মহুয়ার গন্ধে-কোব্বাদ ডাক্তার লখিয়াকে নতুন করে গড়ে চা বাগানে ছেড়ে দিতে চায়। সে যে উল্কি আঁকা শিখেছে, সেই শিল্পের পরিণতি দেখতে চায়। সৌন্দর্যই পৃথিবীকে শাসন করবে, লখিয়াই চা বাগানের পুরুষশাসিত সমাজকে নিয়ন্ত্রিত করবে—কোব্বাদ ডাক্তার তা দেখতে চায়।
সেদিন চৈত্র পুণিমার উৎসব। চা বাগানে উৎসবের ধুম লেগে গেছে। লখিয়া তার মনস্থির করে নিল। সে ছবির ঐ রমণীর মতো রূপসী হয়ে উঠবে, রাজরানী হবে। পৃথিবীর সব রূপবান পুরুষ তার কামনায় অধীর হয়ে উঠবে। কোবাদ ডাক্তারও ছুটল লখিয়ার খোঁজে। উৎসবের উঠোনের বাইরে দু’জনের মুখোমুখি দেখা। মংলু সর্দারও অনুমতি দিয়েছে। আস্তে আস্তে ওরা লখিয়ার বাড়ির দিকে চলল। লখিয়ার মা তাদের ঘরে ডেকে নিল। রাত গভীর হচ্ছে। ডাক্তার ব্যাগ থেকে সই, রঙ আর উকির ছবি বের করল। তারপর বলল, লখিয়া তোমার সমস্ত শরীর-মন এখন উল্কির দিকে নিয়ে যাবে। তোমার মন এখন উকির যন্ত্রণার কথা ভাববে না, ভাববে তুমি সুন্দরী। ও শক্তিমতী হচ্ছ, তোমার রূপ ও গুণ বেড়ে বহুগুণ হচ্ছে, তুমি রাজরানী হতে যাচ্ছ।
কোব্বাদ ডাক্তার সুই তুলে সিঁদুরের রঙে ডোবাল, তারপর লখিয়ার পিঠের মসৃণ ত্বকে যত্ন করে প্রথম দাগ বসাল। সংগে সংগে লখিয়ার পিঠের ত্বকে মৃদু কাঁপন উঠল। সে-ব্যথা যেন কৌদি ডাক্তারের শরীরেও সঞ্চারিত হল। একের পর এক সুইয়ের ফেঁড়ে লখিয়ার পিঠে ভেসে উঠতে লাগল ছবি। যন্ত্রণায় মাঝে মাঝে কেঁপে ওঠে লখিয়া। কোব্বাদ ডাক্তার বলে, মনকে সজাগ করো, তােমার মধ্যে অলৌকিক শক্তি পুরে দিচ্ছি সুইয়ের প্রতিটি ফোঁড়ে। লখিয়ার চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে, আবার সে মনকে শক্ত করে। একাগ্র মনে ভাবে, সে চা বাগানের রানীর অসিনে বসে অাছে, মাথায় সেই ছবিটির মতো মুকুট, হাতে রাজদণ্ড। সে আর আগের মতাে নেই।
লখিয়ার মা পাশের ঘরে, ঘর থেকে কান পেতে শুনতে চায় মেয়ের যন্ত্রণার শব্দ আসে কিনা। একসময় সেও উৎসবে চলে যায়। লখিয়ার বাবা সেই থেকে উৎসবে নেশায় ডুবে আছে। লখিয়ার ভাইয়েরও সময় নেই আজ। মাদলের শব্দ অসিছে গুরু গুরু, গানের সুর ভেসে আসছে। পৃথিবীর যাবতীয় সৌন্দর্য লখিয়ার মাঝে পুরে দিতে চায় কোব্বাদ ডাক্তার। সে সবচেয়ে সুখী মানুষ আজ , সে মাঝে মাঝে থেমে যায়, দুই অঙুলের ডগায় সুই ধরে রেখে রানী মৌমাছির ভারী শরীরের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। হুলটা হওয়া চাই তীক্ষ্ণ। সমস্ত শরীরের মাঝে এই সূক্ষতম মাকড়সার ছবিও সে অাঁকতে পারত। মাকড়সার মধ্যেও সংহার শক্তি আছে। রানী মৌমাছির অায়ু মাত্র তিন বছর। তার মিলনের প্রয়োজন হয় বছরে একবার মাত্র। সুতরাং চাকের শত শত পুরুষ মৌমাছির মধ্যে একটিই মাত্র মিলনের দুর্লভ সুযোগ পায়।
আর এই মিলনের ফল পুরুষ মৌমাছির জন্যে মারাত্মক। কোব্বাদ ডাক্তারও চায় রানী মৌমাছির মতো যে পুরুষ তার সংস্পর্শে আসবে তার পরিণতি হবে ভয়াবহ! সে পুরুষ হবে তার আজ্ঞাবহ, তার জীবন হবে লখিয়ার পায়ের তলায়। কাঁকড়া বিছেও আঁকতে পারত। লখিয়ার পিঠ জুড়ে। একটি অতিকায় কাঁকড়া বিছের ছবি, আর তা দেখে ভয়ে কাঁপতে থাকা পুরুষ--এসব ভেবে শেষ পর্যন্ত রানী মৌমাছির ছবিই আঁকতে শুরু করল।
ভোর হতে হতে কোব্বাদ ডাক্তার তার কাজ শেষ করল। সুই অরি ছবি তুলতে তুলতে বলল, এবার তুমি উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে। ঘুম থেকে উঠবে দুপুর নাগাদ, এর মধ্যে পিঠে কাপড় লাগবে না, কিছু খাবে না। তারপর তোমাকে চান করতে হবে, সিঁদুর গোলা পানিতে চান করার পর তুমি মুক্ত।
তুমি নতুন কাপড় পরবে, খাবে। তারপর তুমি দেখবে সৌন্দর্য তােমার হাতের মুঠোয়, সকল পুরুষের কাম্য নারী তুমি। তখন লখিয়ীর মা এসেছে, বাবা এসেছে। মা এসে দেখল লখিয়া শুয়ে আছে। ওর মা-বাবা ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলল, খেতে দিল বাটি ভরা চা। রাতের উৎসবের পর ওরা ক্লান্ত, তবুও ডাক্তারকে আপ্যায়ন করতে ভুলল না। চৈত্রের ফুরফুরে হাওয়ায় চা বাগান মেতে উঠল, শিমুল-গোটা থেকে তুলাে উড়ছে বাতাসে, কলি আসতে শুরু করেছে বাগানের কৃষ্ণচূড়া গাছে।
কোব্বাদ ডাক্তার এক ঝাক শালিকের ডাক শুনতে শুনতে বাগান ছেড়ে চলল ডিসপেনসারির দিকে। একটু ঘুম দরকার। আরাম । কেদারায় বসে বসে কিছুক্ষণ ঘুমালেই শরীর চাঙ্গা হয়ে উঠবে। অজি তার জীবনের শ্রেষ্ঠ দিন। সে তার জীবনের দীর্ঘদিনের আশা পূরণ করেছে। দুপুরে রঙ-গোলা পানিতে লখিয়াকে চান করলে তার কাজ শেষ।
এক সময় কোব্বাদ ডাক্তার ঘুমিয়ে পড়ল আরাম কেদারায়। দুপুর বারোটা নাগাদ ধড়ফড় করে উঠে বসল। তাড়াতাড়ি ডাক্তারি-বক্স হাতে নিয়ে বাজারের ওপর দিয়ে কোনোদিকে না তাকিয়ে ছুটল। সহজ-সরল আদিবাসী মেয়েটি কত কষ্ট পেয়েছে। হয়তাে এখন সে স্বপ্ন দেখছে, বালিশের ওপর মুখ রেখে হয়তো এখনো ঘুমুচ্ছে। বাজার ফেলে নদীর ধার দিয়ে, বাগানের গাছ, গাছপালার ছায়ায় ছায়ায় কুকুরকে সঙ্গী করে কোব্বাদ ডাক্তার ছুটল হনহন করে।
লখিয়ার মা ঘুমুচ্ছে, বাবা ঘুমুচ্ছে। কোব্বাদ ডাক্তার লখিয়াকে চান করতে পাঠিয়ে দিল। মাটির বড় জালায় রঙ গুলিয়ে চানের জল করে দিল কোব্বাদ ডাক্তার। চান শেষ করে নতুন পোষাক পরে যখন ঘরে আসিবে সে-রূপটি দেখতে চায় কোব্বাদ ডাক্তার। তখন তরুণী খিয়ার রূপ কেমন ঝলমল করে, তার মুখে কী লাবণ্য ফুটে ওঠে, কোন্ রূপে সে তার নতুন জীবন শুরু করবে—তার সুচনা দেখে তবেই কেবিদি ডাক্তারের ছুটি। কোব্বাদ ডাক্তারের কুকুটিরও তখন পাড়ার কুকুরদের সঙ্গে ভাব জমিয়ে ছোটাছুটি করছে।
মাটির বড় গামলায় রঙ-গোলা পানিতে লখিয়া যখন তার শরীর ডোবাল মনে হল তার পিঠ জ্বলছে। যন্ত্রণার কুকড়ে গেল সে। প্রতিটি ক্ষত জলের ছোঁয়ায় জ্বলতে লাগল। তবে সব যন্ত্রণার যেমন শেষ আছে লখিয়ার জ্বালাও এক সময় সহ্যের মধ্যে চলে এল। তারপর শরীর জুড়ে নেমে এল প্রশান্তি। পিঠ তো আর সে দেখতে পায় না, তাছাড়া হাত দিয়ে ঘষতেও নেই। বিন্দু বিন্দু রক্তের দাগগুলো কোব্বাদ ডাক্তার মুছে দিয়েছিল উল্কি আঁকার সময়।
গুরু যেমন তার শিষ্যকে অনেক যত্নে পরিপূর্ণ শিক্ষা দেয় তেমনি মমতা ভরে উকি করে দিয়েছে কোব্বাদ ডাক্তার।চান শেষে গভীর তৃপ্তি নিয়ে ঘরে এল লখিয়া। বসন্তোৎসবের জন্য কেনা নতুন হলুদ রঙের শাড়িখানা পরল। নতুন সাজে লখিয়াকে চেনাই যায় না। যন্ত্রণার অনুভূতি হয়তো তার মুখে লেগে আছে, অরি সেই আনন্দ-বিষাদে লখিয়া হয়ে উঠেছে রাজরানী। ঘরে ঢুকেই সে দেখে কোব্বাদ ডাক্তার পায়চারি করছে। তার চোখে-মুখে বিস্ময়, এবং নিজের সৃষ্টি দেখে কৌদি ডাক্তার মনে মনে উল্লসিত হয়ে উঠল। বলল, তোমার অনেক যন্ত্রণা সইতে হয়েছে, এখন ভালো তো?
কোব্বাদ ডাক্তারকে দেখে ঘুমভাঙা বাঘিনীর মতো অড়িমোড়া ভেঙে জেগে উঠল লখিয়া। দৃঢ় অথচ ছন্দময় পা ফেলে লখিয়া এগিয়ে গেল ডাক্তারের দিকে, শিকারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার পূর্ব মুহর্তে চিতাবাঘ যেমন সবকিছু হিসাব করে নেয়, যেমন স্থির নিশ্চিত হয় যে শিকার অরি পালাতে পারবে না, ঠিক তেমনি এগিয়ে গেল লখিয়া।
সে অার ভীরু, লাজুক বা দ্বিধাগ্রস্ত নয়। রাজরানীর মতো গ্রীবা উচু করে কোব্বাদ ডাক্তারের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, তুমিই আমার প্রথম শিকার।
ডাক্তারির কী বোঝেন কে জানে? কোথায় শিখেছে কেউ জানতে চাইলে লম্বা ফিরিস্তি দিয়ে বসে, সেই ফিরিস্তি থেকে আসল সত্য বের করা খুব কঠিন। কিন্তু তার দরাজ গলা, প্রাণ খুলে হাসির শব্দ কিংবা দেখা হলেই ভালো-মন্দ খোজ-খবর নেওয়ার জন্যে লোকজন দু দিনেই তাকে আপন করে নিল। ছোটকাল থেকেই তার এই স্বভাব। মাঝখানে দীর্ঘ কুড়ি বছর দেশের বাইরে থাকার জন্যে তার সম্পর্কে নানা কাহিনী গড়ে উঠেছে। এখন তো সে আর পনেরো বছরের কিশোর নেই, কিংবা বেকারও নয় যে সবাই করুনা করবে। বরং ডাক্তারহীনগ্রামে সে একজন ডাক্তার হয়ে ফিরে এসেছে, সকলেই তাই তাকে সমীহ করে, খাতির রাখতে চেষ্টা করে সবাই। রাতারাতি সে এভাবে শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে উঠল। কিন্তু দীর্ঘ বিশ বছর গ্রাম থেকে অনুপস্থিত সে, কেউ কিছু জানে না তার সম্পর্কে—আর জানে না বলেই কৌতূহল সবার। সেই কৌতুহলও একদিন থিতিয়ে পড়বে, কোব্বাদ ডাক্তারও হয়তো সবার মতো ভিড়ে হারিয়ে যাবে।
কারও বাড়িতে ডাক্তার হিসেবে রোগী দেখতে শুরু করার আগেই একটা কাণ্ড ঘটল। গরমের এক সকালে কোথা থেকে একটা খেঁকিকুকুর তার ডিসপেনসারির সামনে এসে মরতে বসল। কোব্বাদ ডাক্তারঘেন্নাপিতি বিসর্জন দিয়ে কুকুরটাকে কোলে করে ডিসপেনসারিতে তুলল। জলাতঙ্ক রোগ নয়, তাহলে তো পাগল হয়ে মানুষ কামড়াতে ছুটত।
সকালের বাজার জমে উঠেছে রোজকার মতো, লোকজন তরিতরকারি নিয়ে দোকান খুলে বসেছে, মুদি দোকানদার খদ্দেরের আশায় বসে আছে। লোকজনের ভিড় দেখে কোব্বাদ ডাক্তার তার স্বভাবসুলভ ধৈর্য হারিয়ে বকাবকি শুরু করল। সকলকে একে একে ডিসপেনসারি থেকে তাড়িয়ে দিয়ে কুকুরটাকে নিয়ে বসল। কম্পাউণ্ডার নেই তার, তাই সাহায্য করার জন্য অনিড়ি এক লোককে হাত ধরে টেনে ঘরের মেঝেয় বসিয়ে দিল। বলল, কুকুরটা ধরো। মরতে বসা কুকুরটাও চিৎপাত শুয়ে চুপ হয়ে রইল। কোব্বাদ ডাক্তার আলমারি খুলে ইনজেকশনের সিরিঞ্জ, ডিসটিল ওয়াটারের এ্যাম্পুল এবং পেনিসিলিন বের করে নিল। একজন মানুষকে পেনিসিলিন দিতে যা যা করতে হয় প্রত্যেকটি কাজ নিষ্ঠার সঙ্গে করল। স্পিরিটের বাতি জ্বেলে গরম জল করা, সিরিঞ্জ ধুয়ে বীজাণু মুক্ত করা—কোনাে কাজ বাদ দেয় নি। তারপর কুকুরটার পেছনের বা পায়র উরুর লোম সরিয়ে তিরিশ লাখ পেনিসিলিন পুরে দিল মমতা ভরে। সিফিলিস বা ভাইরাস রোগে তখন পেনিসিলিন মহৌষধ।
ইনজেকশন দেওয়ার সময় শার্টের আস্তিন গোটাতেই কোব্বাদ ডাক্তারের বাঁ হাতে দেখা গেল মাছের এক উল্কি। মীন রাশির দুটি মছি পাশাপাশি আঁকা। লােকটি হাঁ করে তাকিয়ে রইল ডাক্তারেরদিকে। গ্রামে উল্কি আঁকা লোক একটাও নেই। চা বাগানের মেথর সর্দারের বাড়িতে উল্কি আঁকা লোক আছে। আর উল্কিদার ঐ কুলি সর্দার সবার কাছে শ্রদ্ধেয় এবং অনেকটা রহস্যময় ও দুর্জেয় লোক। চা বাগানের কুলিরা প্রায় সবাই সঁওতাল। তারা উল্কি আঁকে না মেথরদের মতো। সাঁওতালদের কলো রঙের শরীরে উল্কি মানায় না। তবুও কেউ কেউ কচিৎ উল্কি আঁকতে চায় বৈকি ! কিন্তু উকি অাঁকতে জানা লোক এ তল্লাটে একজনও নেই। কোব্বাদ ডাক্তারের হাতে উল্কি দেখে তাই সমীহভরে তাকিয়ে রইল লোকটি।
কোব্বাদ ডাক্তারের কুকুরকে ইনজেকশন দেওয়া আর উল্কির কথা একদিনেই পাড়াময় রাষ্ট্র হয়ে গেল। পরদিন কুকুরটাও উঠে দাঁড়াল এবং দিব্যি সুস্থ হয়ে খাওয়া-দাওয়া, পা তুলে পেচ্ছাব করা ইত্যাদি কুকুরের স্বভাব মতো সব কাজ শুরু করল। কোব্বাদ ডাক্তারেরও নামডাক হয়ে গেল এক লহমায়। চা বাগানের বস্তিতে খবর রটে গেল, রােগীর ভিড় বাড়তে লাগল। ডিসপেনসারিতে একজন লোক রেখে কম্পাউণ্ডারি শেখাতে লাগল কোব্বাদ ভাক্তার।
বাজার থেকে মাইল খানেকের মধ্যেই বাগান, বাগানের কারখানা থেকে সারাদিন শোনা যায় ঘণ্টা পেটানোর শব্দ, রাত যত গভীর হয়। ঘন্টার শব্দ হয় আরও বড়, মাঝে মাঝে বাতাসের তোড়ে ভেসে অাসে শুকোতে দেওয়া চায়ের গন্ধ। ছুটির পর কারখানা থেকে কুলিমজুররা বেরিয়ে আসে হল্লা করে, আদিবাসীরা চলে যায় নিজেদের বস্তিতে, মদের দোকানে জমে ওঠে ভিড়। কোব্বাদ ডাক্তারেরও আনাগোনা শুরু হল বস্তিতে, কুকুরটিও ছায়ার মতো তাকে অনুসরণ করে সবখানে। কুকুর তো অকৃতজ্ঞ নয় ; প্রভু বলো, জীবনদাতা বলো, সেতো ঐ কোব্বাদ ডাক্তার কুকুরটি তার ডাক্তারি পেশায় প্রতিপত্তি বাড়িয়ে দিল প্রথম দিনেই, আর ডাক্তারও তাকে তাড়াতে পারল না। এভাবে শুরু হল তাদের পরস্পর পরস্পরের নির্ভরতা।
সেই নির্ভরশীলতার কোনাে সংজ্ঞা নেই, সীমরেখাও টানা যায় না। কোব্বাদ ডাক্তার বিয়ে-বউহীন মানুষ। ঘরে আছে সমবয়সী খুড়ো, খুড়োর পরিবারেই খায়-দায়। পাড়াপড়শী তাকে ভালোবাসে, রোগশোকে ডাকে, মাঝে মাঝে কাউন্সিলের বিচার-আচারেও ডাক পড়ে। তবে পারতপক্ষে সে ওসব ঝামেলা এড়িয়ে চলে।
বাগানে গরমের দিনে কলেরা, বর্ষায় আমাশয় বা মাঘ-ফাগুনে বসন্ত রােগের উৎপাত লেগেই আছে। বাগানের ডাক্তার থেকে ওরা ওষুধপত্র, বিধি-ব্যবস্থা পায়। কিন্তু কোব্বাদ ডাক্তারের প্রতিপত্তি সেই ডাক্তার ঠেকাতে পারল না। সে উল্কি আঁকতে জানে। তাই অনেকেই তার করুণা চায়। কিন্তু উল্কি অাঁকার ব্যাপারে সে কারও কথায় ওঠবস করে না। মেথরদের মধ্যে উল্কি অাকার রেওয়াজ তো আছে, দুএকজন করে সাঁওতালও উল্কি আঁকার জন্যে তার কাছে ধরনা দিতে শুরু করেছে। কিন্তু এ ব্যাপারে সে হিসেবের বাইরে এক পাও হাটবে না ।
কুলি সর্বদারের ছেলের গায়ে তীর-ধনুকের উল্কি একে দেওয়ার পর তার প্রতিপত্তি বেড়ে গেছে। ঝমরু সেই থেকে শিকারে গেলে কোনােদিন খালি হাতে ফেরে না। বন শুয়োর, বন মোরগ এমনকি একদিন অস্তি একটি হরিণ শিকার করে নিয়ে এল। যদিও হরিণের চেয়ে শুয়োরের মাংসই তাদের বেশি প্রিয় তবুও দুর্লভ হরিণ শিকার করার পর ঝমরুর নাম তার বাবার চেয়েও বেড়ে গেল।
কোব্বাদ ডাক্তারের মনে তবুও শান্তি নেই। তার ডাক্তারিবিদ্যা আর উল্কি আঁকা শেখার অনেক কাহিনী আছে। সেসব কথা সে কাউকে কোনোদিন বলে নি। মাঝে মাঝে বলতে খুব ইচ্ছে করে।
ছোটকাল থেকে সে অনেক দেখেছ, অনেক ঘুরছে। দীর্ঘ কুড়ি বছর সে দেশছাড়া ছিল। মাঝে মাঝে তার বুকের ভেতর হাহাকার ওঠে। যখন সে উল্কি আঁকা শেখে তখন তার গুরু একটি কথা বলত—উল্কি আঁকা সৌন্দর্যচর্চার অঙ্গ। এক সময় সে উল্কি আঁকতে শেখে। তার নিজের গায়ে যখন একে একে উল্কির সুইয়ের ফোঁড় লাগে, সিঁদুরের রঙে ডোবানো সুই যখন তাকে একে একে বিদ্ধ করে, সে-যন্ত্রণার মাঝেও তার একমাত্র অকাঙক্ষা সে উল্কি আঁকতে শিখবে। আদিম সমাজে কবে থেকে এর সুত্রপাত তা কোব্বাদ ডাক্তার জানে না। শুধু জানে যে এখনও আদিম সমাজের মানুষ উল্কি আঁকে।
সুন্দরী নারীর শরীরে একটি ছোট উল্কি কী মোহনীয় আকর্ষণ সৃষ্টি করে সে তার নির্বাসন জীবন কাটানোর সময় দেখেছে। উৎকল দেশ ঘুরতে ঘুরতে সে এই নিয়ে অনেক ভেবেছে। মাদ্রাজ ও পুরীর সমুদ্র তীরে সে খুজেছে সুন্দরী তরুণী। তার গুরু তাকে বলেছিল, খবরদার শুধু টাকার লোভে কারও গায়ে উকি আঁকিতে হাত বাড়াবে না। সৌন্দর্যচর্চার নামে তুমি এই বিদ্যা আমার কাছ থেকে শিখতে পেলে। গুরু তাকে আরও বলেছিল, কালো ছিপছিপে ভারী উরুর কোনাে মেয়ের শরীরে নির্লোভ একাগ্র মনে যদি উল্কির অকে, তবে সেই নারী পাবে উল্কির প্রাণীর সব গুণাগুণ। মন দিয়ে উকি আঁকবে, প্রতিটি ফোঁড় দেবে মমতা ভরে, আর মনে রাখবে এ-কাজ শিল্পকর্মের অঙ্গ, যে-নারীর গায়ে উকি আঁকবে তার প্রতি কখনও লালসার হাত বাড়াবে না। শুদ্ধ শিল্পে ও সৌন্দর্যচর্চাতেই মানুষের মুক্তি।
সেই থেকে কোব্বাদ ডাক্তার খুজে বেড়াচ্ছে তেমন একজন নারীকে, কিন্তু কোনো নারীর উরু দেখা তো সহজ নয়। একমাত্র অভিজ্ঞ লোকই শুধু পায়ের গোড়ালি দেখে উরুর লঘু-গুরু মপি আঁচ করতে পারে। পায়ের গোড়ালি যাদের একটু ভারি তাদের উরুও ভারী হতে বাধ্য। কোব্বাদ ডাক্তার নানা লোকের কাছে কম্পাউণ্ডারি ও ডাক্তারি শিখেছে। ডাক্তারি শিখতে শিখতে উল্কি অাকার কথা সে ভােলে নি। শরীরবিদ্যা তো একদিনে শেখা হয় না। আর শরীরের অন্ধিসন্ধি মনে রাখতে গিয়ে সে ভোলে নি উল্কি -গুরুর কথা। বাগানের কুলি মেয়েদের সে দেখে, ডাক্তারি করতে গিয়ে অনেক নারীর সংস্পর্শে আসে, কখনো। কখনাে মশারির বাইরে থেকে রোগীর সঙ্গে কথা বলে, রোগীকে ব্যবস্থাপত্র দেয়। পর্দানশীন মেয়েদের চিকিৎসা করার দুর্ভোগ এবং তাদের সংস্পর্শে এসেও তাদের দেখতে না পাওয়া—একমাত্র গ্রাম্য ডাক্তাররাই এই সমস্যার মুখোমুখি হয়। কিন্তু চোখ-কান সে বরাবরই খোলা রাখে।
এক সন্ধেয় কোব্বাদ ডাক্তার বস্তি থেকে ফিরছে। কুকুরটিও তার আগে আগে, পিছে পিছে। হঠাৎ তার পাশ দিয়ে এক তরুণী চলে গেল। ছিপছিপে গড়ন, গায়ের রঙ উজ্জল শ্যামল। বেণী দুটি ঝাঁপিয়ে পড়েছে পিঠ ছাড়িয়ে নিতম্বে। কুকুরটি সঙ্গে সঙ্গে এমন শব্দ করে উঠল যে, মেয়েটি তাই হয়তো ভয় পেয়ে আরাে জোরে হনহন করে চলে গেল । কেন যে কুকুরটি এভাবে ডেকে উঠল, বা কুকুরকে চুপ করতে বলার সময়ও সে পেল না। আর আলো-আঁধারেও সে আঁচ করে নেয় মেয়েটির উরু হবে সুগঠিত, সঙ্গে সঙ্গে তার শরীরে রোমাঞ্চকর অনুভূতি খেলে গেল। কিন্তু ভালাে করে দেখা এবং কথা বলার আগেই মেয়েটি বস্তির ঘর-বাড়ির উঠোন দিয়ে কোথায় হাওয়া হয়ে গেল।
ডিসপেনসারিতে ফেরার পর সে কাজে মন বসাতে পারল না। কম্পাউণ্ডারকে কিছু না বলে ছুটি দিয়ে দিল। কুকুরটাকে রীতিমাফিক আদর করে ভেতরের কামরায় ঢুকে চুরুট জ্বেলে আরাম কেদারায় গা এলিয়ে ভাবতে লাগল, বস্তিতে যখন দেখা পেয়েছি তাকে খুঁজে পাবই। ডিসপেনসারিতেই ডাকব, উল্কি একে দেব বললে সে স্বেচ্ছায় চলে আসবে, এসে উল্কির মধুর যন্ত্রণা হাসিমুখে গায়ে তুলে নেবে।...তারপর। উল্কির ছবির গুণাগুণ পেয়ে সে চা-বাগান দাপিয়ে বেড়াবে।
পরদিন...তারপরও কয়েকদিন কেটে গেল। কোব্বাদ ডাক্তার আর সেই মেয়েটিকে দেখতে পায় না। নামও জানে না যে কাউকে জিজ্ঞেস করবে। প্রতিদিন বস্তিতে চলে যায় সে, রােগী দেখার ডাক আসুক না আসুক বস্তির গলিতে গলিতে বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে সে খোঁজ-খবর নেয়। সবাই যখন চা বাগানে চলে যায় তখনও ছুটে যায় বস্তিতে। এক দুপুরে মংলু সর্দারের বাড়ির পাশে মেয়েটির সঙ্গে অবিার দেখা। অমনি তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করল, কাদের মেয়েগো তুমি?
ওমা তুমি চেনো না বুঝি, ঐ যে আমার বাড়ি, সর্দারের পাশের বাড়িই তো! এই বলে তাড়াতাড়ি তাকে ঘরে নিয়ে গেল। কথা বলতে বলতে ডাক্তার শুধু ভাবছে, এইতো সেই মেয়েটি যাকে সে দীর্ঘদিন ধরে খুঁজে বেড়াচ্ছে। পায়ের গোড়ালি দেখে আবার বিড়বিড় করে বলল, কী সুন্দর, কী সুন্দর! মেয়েটির শরীরের গড়নও অস্বাভাবিক সুন্দর। এমন সৌন্দর্য সচরাচর চোখে পড়ে না। মেয়েটি তাকে গুড় দিয়ে এক গ্লাস জল খেতে দিল। হাজার হোক ডাক্তার মানুষ, উল্কি আঁকিতে জানে।
লোকে বলে তার অসীম ক্ষমতা, সে ইচ্ছে করলে অদ্ভুত সব কাণ্ড করতে পারে। মানুষের শরীরে উল্কি একে অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী করে দিতে জানে।
চৈত্রের গরমের দুপুরে এক গ্লাস পানি ও গুড় তার শরীর জুড়িয়ে দিল। তারপর সে মেয়েটির নাম জেনে নিল, এবং আস্তে আস্তে লখিয়াকে বোঝাতে শুরু করল। লখিয়া তো নিজেই উল্কি অাকার কথা বলত, কিন্তু তার আগেই কোব্বাদ ডাক্তার তার ব্যাগ থেকে একটা ছবি বের করে দেখাল। ছবিটি রানী মৌমাছির। তারপর মেলে ধরল রানী পিপড়ের ছবি। তারপর একটি অতিকায় মাকড়সার ছবি বের করতেই লখিয়া চোখ বুজে চুপ করে গেল।
আরেকটি ছবিতে রানী মৌমাছি। পুরুষ মৌমাছিকে হুল ফুটিয়ে মেরে ফেলছে দেখেই লখিয়া কেঁপে উঠল। কোব্বাদ উক্তিার বলল, সঙ্গম শেষে পুরুষ মৌমাছির জীবনে নেমে আসে এই ভয়াবহ পরিণতি।
কোব্বাদ ডাক্তার জিজ্ঞেস করল, তুমি উল্কি আঁকবে? তোমার মতো মেয়েদের জন্ম হয়েছে পুরুষদের শাসিয়ে বেড়াবার জন্যে। তুমি চাও তাে মৌমাছি বা মাকড়সা যে-কোনাে একটি উকি অকতে পারো, তাদের শক্তি করায়ত্ত করতে পারো। পৃথিবীতে শক্তিমতী হয়ে বেঁচে থাকার মতো সুখ আর নেই।
শুনতে শুনতে লখিয়ার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল। বলল, না না, ও-কথা বলবেন না, আমি ঘর-সংসার নিয়ে সবার মধ্যে বেঁচে থাকতে চাই। কিন্তু মনে মনে সে লোভী হয়ে উঠল। পুরুষ মানুষকে হাতের মুঠোয় নিয়ে আসা...তার কুমারীদেহে এক অজানা শিহরণ খেলে গেল, সঙ্গে সঙ্গে অচেনা ভয়ও তাকে জাপটে ধরল। এই দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ডুবে সে বলল, অমন কথা বলবেন না, আমার খুব ভয় করছে। তারচেয়ে একটা মহুয়া ফুলের উকি একে দিন আমার হাতে।
বসন্ত শেষ হতে বসেছে। চা বাগানের কোথাও মহুয়া গাছ অাগের মতো নেই। আগে বাগানের কয়েকটি টিলা জুড়ে ছিল মহুয়ার বন। আদিবাসীরা মহুয়া খেয়ে নেশায় মেতে থাকত বলে বাগনি কতৃপক্ষ ধীরে ধীরে মহুয়ার বন শেষ করে দিয়েছে। কোব্বাদ ডাক্তার দেখল মেয়ের্টির মনের গভীরে সুপ্ত আকাঙক্ষা আছে। তাই আস্তে আস্তে সে তার মনের পর্দায় রঙ লাগাতে শুরু করল। বলল, হ্যা, মহুয়ার উকি আমি একে দিতে পারি, কিন্তু তুমি বোধ হয় জানাে না আমি যাকে তাকে উকি একে দিই না। সর্দারের ছেলের গায়ে এঁকে দিয়েছি। তুমি তো সাধারণ নও, তুমি সেই নারীর বংশ যে পুরুষের মুখে লাগাম দিয়ে দাশখত লেখাতে পারে। তােমার এই সৌন্দর্য দিয়ে তুমি হতে পারে সর্বশ্রেষ্ঠ নারী, এই বাগানের পুরুষ হবে তোমার করুণা-প্রাথী।
লাখিয়ার আদিম রক্তে ঢেউ খেলে গেল। মাতৃতান্ত্রিক সাঁওতাল সমাজে নারীই সর্বেসর্বা, কাজেই এই সুযােগ সে ছাড়তেও চায় না। সে লোভী হয়ে উঠল।
পরদিন লখিয়া কোব্বাদ ডাক্তারের ডিসপেনসারিতে গেল। নদীর ধারে বাজার, দুপুরের ঝাঁ ঝাঁ রোদ চারদিকে, লোকজন নেই। কম্পাউন্ডার বসে বসে ঝিমুচ্ছে, ডাক্তার ভেতরের ঘরে আরাম কেদারায় বসে চুরুট টানছে। লখিয়া তখন ঘরে ঢুকল। ডাক্তার বুঝল লখিয়র রক্তে উল্কির নেশা ধরেছে।
লখিয়া বলল, আমার বাবাকে বলেছি, তুমি আমাকে মহুয়ায় উকি একে দেবে ? কোব্বাদ ডাক্তার তবুও আশা ছাড়ে না, সে জানে একবার যখন উল্কির নেশায় পেয়েছে তখন লখিয়াকে ইচ্ছেমতো চালান যাবে। কোব্বাদ ডাক্তার তখন উঠে আলমারি থেকে একটা ছবি বের করল। রানী ক্লিওপেট্রার ছবি। লখিয়া জানে না ক্লিওপেট্রা কে। কিন্তু ছবির রাজরানী রূপ তার স্নায়ুতে শিহরণ জাগিয়ে দিল। কোব্বাদ ডাক্তার তাকে বলল, কে এই রানী জানো? পৃথিবীর সমস্ত পুরুষ একদিন এই নারীর অনুগ্রহ কামনা করত, সঙ্গ-কামনায় উন্মত্ত হয়ে উঠত। রানীও তার পছন্দমতো পুরুষকে বুকের কাছে টেনে নিত। পুতুলের মতো পুরুষরা রানীর ইচ্ছার কাছে লুটিয়ে দাসখত লিখে দিত।
লখিয়ার তরুণী দেহে শিহরণ খেলে গেল। শরীর থেকে স্বেদবিন্দু ঝরতে লাগল। সে কী করবে বুঝতে পারল না। তার মনের কোণে জমে আছে একটি সংসারের স্বপ্ন, চা বাগানের ছায়াচ্ছন্ন জীবন, উৎসবের দিনে মাদলের নৃত্য-গীত, তারপর অাকাঙিক্ষত পুরুষের সঙ্গে রাত্রিবাস... লখিয়া কোনোমতে জোর করে বলল, একটি মাদার ফুলের পাশে যদি মাদলের উল্কি আঁকতে চাই ? তুমি দেবে না?
সেদিনও কোব্বাদ ডাক্তার লখিয়াকে যেতে দিল দ্বিধা-দ্বন্দ্বের অবসান না ঘটিয়ে। লােকজন, বাজারবাসী সবাই জানে কোব্বাদ ডাক্তার ভালোমানুষ। পাড়া-পড়শীরা তাকে দেবতাতুল্য শ্রদ্ধা করে। চা বাগানের সর্দার, কুলি কেউ তার সাহায্য ছাড়া বাঁচতে পারে না। কোব্বাদ ডাক্তার দেখতে চায় তার নিজের সৃষ্টি। সৌন্দর্যের পাশাপাশি ধ্বংসের রূপ স্বচ্ছন্দে সহাবস্থান করতে পারে কিনা, তার দীর্ঘ ভবঘুরে জীবনের বিচিত্র শিক্ষার সঙ্গে এই স্থির জীবনের মিল কোথায় তা পরখ করে দেখতে চায়।
বসন্তের মহুয়া খেয়ে ভালুকও নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে, আদিবাসীরা উৎসবে মেতে ওঠে মহুয়ার গন্ধে-কোব্বাদ ডাক্তার লখিয়াকে নতুন করে গড়ে চা বাগানে ছেড়ে দিতে চায়। সে যে উল্কি আঁকা শিখেছে, সেই শিল্পের পরিণতি দেখতে চায়। সৌন্দর্যই পৃথিবীকে শাসন করবে, লখিয়াই চা বাগানের পুরুষশাসিত সমাজকে নিয়ন্ত্রিত করবে—কোব্বাদ ডাক্তার তা দেখতে চায়।
সেদিন চৈত্র পুণিমার উৎসব। চা বাগানে উৎসবের ধুম লেগে গেছে। লখিয়া তার মনস্থির করে নিল। সে ছবির ঐ রমণীর মতো রূপসী হয়ে উঠবে, রাজরানী হবে। পৃথিবীর সব রূপবান পুরুষ তার কামনায় অধীর হয়ে উঠবে। কোবাদ ডাক্তারও ছুটল লখিয়ার খোঁজে। উৎসবের উঠোনের বাইরে দু’জনের মুখোমুখি দেখা। মংলু সর্দারও অনুমতি দিয়েছে। আস্তে আস্তে ওরা লখিয়ার বাড়ির দিকে চলল। লখিয়ার মা তাদের ঘরে ডেকে নিল। রাত গভীর হচ্ছে। ডাক্তার ব্যাগ থেকে সই, রঙ আর উকির ছবি বের করল। তারপর বলল, লখিয়া তোমার সমস্ত শরীর-মন এখন উল্কির দিকে নিয়ে যাবে। তোমার মন এখন উকির যন্ত্রণার কথা ভাববে না, ভাববে তুমি সুন্দরী। ও শক্তিমতী হচ্ছ, তোমার রূপ ও গুণ বেড়ে বহুগুণ হচ্ছে, তুমি রাজরানী হতে যাচ্ছ।
কোব্বাদ ডাক্তার সুই তুলে সিঁদুরের রঙে ডোবাল, তারপর লখিয়ার পিঠের মসৃণ ত্বকে যত্ন করে প্রথম দাগ বসাল। সংগে সংগে লখিয়ার পিঠের ত্বকে মৃদু কাঁপন উঠল। সে-ব্যথা যেন কৌদি ডাক্তারের শরীরেও সঞ্চারিত হল। একের পর এক সুইয়ের ফেঁড়ে লখিয়ার পিঠে ভেসে উঠতে লাগল ছবি। যন্ত্রণায় মাঝে মাঝে কেঁপে ওঠে লখিয়া। কোব্বাদ ডাক্তার বলে, মনকে সজাগ করো, তােমার মধ্যে অলৌকিক শক্তি পুরে দিচ্ছি সুইয়ের প্রতিটি ফোঁড়ে। লখিয়ার চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে, আবার সে মনকে শক্ত করে। একাগ্র মনে ভাবে, সে চা বাগানের রানীর অসিনে বসে অাছে, মাথায় সেই ছবিটির মতো মুকুট, হাতে রাজদণ্ড। সে আর আগের মতাে নেই।
লখিয়ার মা পাশের ঘরে, ঘর থেকে কান পেতে শুনতে চায় মেয়ের যন্ত্রণার শব্দ আসে কিনা। একসময় সেও উৎসবে চলে যায়। লখিয়ার বাবা সেই থেকে উৎসবে নেশায় ডুবে আছে। লখিয়ার ভাইয়েরও সময় নেই আজ। মাদলের শব্দ অসিছে গুরু গুরু, গানের সুর ভেসে আসছে। পৃথিবীর যাবতীয় সৌন্দর্য লখিয়ার মাঝে পুরে দিতে চায় কোব্বাদ ডাক্তার। সে সবচেয়ে সুখী মানুষ আজ , সে মাঝে মাঝে থেমে যায়, দুই অঙুলের ডগায় সুই ধরে রেখে রানী মৌমাছির ভারী শরীরের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। হুলটা হওয়া চাই তীক্ষ্ণ। সমস্ত শরীরের মাঝে এই সূক্ষতম মাকড়সার ছবিও সে অাঁকতে পারত। মাকড়সার মধ্যেও সংহার শক্তি আছে। রানী মৌমাছির অায়ু মাত্র তিন বছর। তার মিলনের প্রয়োজন হয় বছরে একবার মাত্র। সুতরাং চাকের শত শত পুরুষ মৌমাছির মধ্যে একটিই মাত্র মিলনের দুর্লভ সুযোগ পায়।
আর এই মিলনের ফল পুরুষ মৌমাছির জন্যে মারাত্মক। কোব্বাদ ডাক্তারও চায় রানী মৌমাছির মতো যে পুরুষ তার সংস্পর্শে আসবে তার পরিণতি হবে ভয়াবহ! সে পুরুষ হবে তার আজ্ঞাবহ, তার জীবন হবে লখিয়ার পায়ের তলায়। কাঁকড়া বিছেও আঁকতে পারত। লখিয়ার পিঠ জুড়ে। একটি অতিকায় কাঁকড়া বিছের ছবি, আর তা দেখে ভয়ে কাঁপতে থাকা পুরুষ--এসব ভেবে শেষ পর্যন্ত রানী মৌমাছির ছবিই আঁকতে শুরু করল।
ভোর হতে হতে কোব্বাদ ডাক্তার তার কাজ শেষ করল। সুই অরি ছবি তুলতে তুলতে বলল, এবার তুমি উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে। ঘুম থেকে উঠবে দুপুর নাগাদ, এর মধ্যে পিঠে কাপড় লাগবে না, কিছু খাবে না। তারপর তোমাকে চান করতে হবে, সিঁদুর গোলা পানিতে চান করার পর তুমি মুক্ত।
তুমি নতুন কাপড় পরবে, খাবে। তারপর তুমি দেখবে সৌন্দর্য তােমার হাতের মুঠোয়, সকল পুরুষের কাম্য নারী তুমি। তখন লখিয়ীর মা এসেছে, বাবা এসেছে। মা এসে দেখল লখিয়া শুয়ে আছে। ওর মা-বাবা ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলল, খেতে দিল বাটি ভরা চা। রাতের উৎসবের পর ওরা ক্লান্ত, তবুও ডাক্তারকে আপ্যায়ন করতে ভুলল না। চৈত্রের ফুরফুরে হাওয়ায় চা বাগান মেতে উঠল, শিমুল-গোটা থেকে তুলাে উড়ছে বাতাসে, কলি আসতে শুরু করেছে বাগানের কৃষ্ণচূড়া গাছে।
কোব্বাদ ডাক্তার এক ঝাক শালিকের ডাক শুনতে শুনতে বাগান ছেড়ে চলল ডিসপেনসারির দিকে। একটু ঘুম দরকার। আরাম । কেদারায় বসে বসে কিছুক্ষণ ঘুমালেই শরীর চাঙ্গা হয়ে উঠবে। অজি তার জীবনের শ্রেষ্ঠ দিন। সে তার জীবনের দীর্ঘদিনের আশা পূরণ করেছে। দুপুরে রঙ-গোলা পানিতে লখিয়াকে চান করলে তার কাজ শেষ।
এক সময় কোব্বাদ ডাক্তার ঘুমিয়ে পড়ল আরাম কেদারায়। দুপুর বারোটা নাগাদ ধড়ফড় করে উঠে বসল। তাড়াতাড়ি ডাক্তারি-বক্স হাতে নিয়ে বাজারের ওপর দিয়ে কোনোদিকে না তাকিয়ে ছুটল। সহজ-সরল আদিবাসী মেয়েটি কত কষ্ট পেয়েছে। হয়তাে এখন সে স্বপ্ন দেখছে, বালিশের ওপর মুখ রেখে হয়তো এখনো ঘুমুচ্ছে। বাজার ফেলে নদীর ধার দিয়ে, বাগানের গাছ, গাছপালার ছায়ায় ছায়ায় কুকুরকে সঙ্গী করে কোব্বাদ ডাক্তার ছুটল হনহন করে।
লখিয়ার মা ঘুমুচ্ছে, বাবা ঘুমুচ্ছে। কোব্বাদ ডাক্তার লখিয়াকে চান করতে পাঠিয়ে দিল। মাটির বড় জালায় রঙ গুলিয়ে চানের জল করে দিল কোব্বাদ ডাক্তার। চান শেষ করে নতুন পোষাক পরে যখন ঘরে আসিবে সে-রূপটি দেখতে চায় কোব্বাদ ডাক্তার। তখন তরুণী খিয়ার রূপ কেমন ঝলমল করে, তার মুখে কী লাবণ্য ফুটে ওঠে, কোন্ রূপে সে তার নতুন জীবন শুরু করবে—তার সুচনা দেখে তবেই কেবিদি ডাক্তারের ছুটি। কোব্বাদ ডাক্তারের কুকুটিরও তখন পাড়ার কুকুরদের সঙ্গে ভাব জমিয়ে ছোটাছুটি করছে।
মাটির বড় গামলায় রঙ-গোলা পানিতে লখিয়া যখন তার শরীর ডোবাল মনে হল তার পিঠ জ্বলছে। যন্ত্রণার কুকড়ে গেল সে। প্রতিটি ক্ষত জলের ছোঁয়ায় জ্বলতে লাগল। তবে সব যন্ত্রণার যেমন শেষ আছে লখিয়ার জ্বালাও এক সময় সহ্যের মধ্যে চলে এল। তারপর শরীর জুড়ে নেমে এল প্রশান্তি। পিঠ তো আর সে দেখতে পায় না, তাছাড়া হাত দিয়ে ঘষতেও নেই। বিন্দু বিন্দু রক্তের দাগগুলো কোব্বাদ ডাক্তার মুছে দিয়েছিল উল্কি আঁকার সময়।
গুরু যেমন তার শিষ্যকে অনেক যত্নে পরিপূর্ণ শিক্ষা দেয় তেমনি মমতা ভরে উকি করে দিয়েছে কোব্বাদ ডাক্তার।চান শেষে গভীর তৃপ্তি নিয়ে ঘরে এল লখিয়া। বসন্তোৎসবের জন্য কেনা নতুন হলুদ রঙের শাড়িখানা পরল। নতুন সাজে লখিয়াকে চেনাই যায় না। যন্ত্রণার অনুভূতি হয়তো তার মুখে লেগে আছে, অরি সেই আনন্দ-বিষাদে লখিয়া হয়ে উঠেছে রাজরানী। ঘরে ঢুকেই সে দেখে কোব্বাদ ডাক্তার পায়চারি করছে। তার চোখে-মুখে বিস্ময়, এবং নিজের সৃষ্টি দেখে কৌদি ডাক্তার মনে মনে উল্লসিত হয়ে উঠল। বলল, তোমার অনেক যন্ত্রণা সইতে হয়েছে, এখন ভালো তো?
কোব্বাদ ডাক্তারকে দেখে ঘুমভাঙা বাঘিনীর মতো অড়িমোড়া ভেঙে জেগে উঠল লখিয়া। দৃঢ় অথচ ছন্দময় পা ফেলে লখিয়া এগিয়ে গেল ডাক্তারের দিকে, শিকারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার পূর্ব মুহর্তে চিতাবাঘ যেমন সবকিছু হিসাব করে নেয়, যেমন স্থির নিশ্চিত হয় যে শিকার অরি পালাতে পারবে না, ঠিক তেমনি এগিয়ে গেল লখিয়া।
সে অার ভীরু, লাজুক বা দ্বিধাগ্রস্ত নয়। রাজরানীর মতো গ্রীবা উচু করে কোব্বাদ ডাক্তারের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, তুমিই আমার প্রথম শিকার।
আরো নতুন নতুন valobasar Golpo পড়তে ভিজিট করুন
উত্তরমুছুনWWW.VALOBASARGOLPO2.XYZ
নতুন নতুন ভালোবাসার এসএমএস এবং কবিতা পেতে WWW.SMSBD.TOP
উত্তরমুছুনভালবাসার এস এম এস
উত্তরমুছুনভালোবাসার কষ্টের গল্প কাহিনী
Bangla Love Sms 2021
রোমান্টিক প্রেমের গল্প
সত্যিকারের ভালবাসার গল্প
এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।
উত্তরমুছুনvalo laglo. post korte thakun. vromon, golpo, kobita, technology and health related pot porte tripretreatBD blog visit korun. valo lagle share korun.
উত্তরমুছুনNice post. Thanks for sharing. Please visit my bangla tech blog as well. Techitunes BD bangla blog is solely dedicated to technology news, bangla tutorials and tips, bangla tech-review and software download link.
উত্তরমুছুনlove the story. keep posting. Visit my travel blog as well Wikistravel
উত্তরমুছুনঅনেক সুন্দর পোস্ট।
উত্তরমুছুনFind pdf
এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।
উত্তরমুছুনছোটদের গল্প রূপকথার গল্প ছোটদের রূপকথার গল্প বাংলালিংক নাম্বার চেক
উত্তরমুছুনপ্রচন্ড হাসির গল্প