খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাড়ার লোকজন নদী পাড়ি দিয়ে পালাতে শুরু করল। গ্রামের দক্ষিণে কর্ণফুলী, পশ্চিমে ও উত্তরেও খাল-কর্ণফুলী পার হতে পারলে বাঁচা যাবে, এরকম বিশ্বাস নিয়ে সবাই পালাতে শুরু করল। কিন্তু মিলিটারির নদী পেরিয়ে ওপারে গেলে তারপর কি হবে, তারপর তো পাহাড়ের রাজ্য শুরু, যুদ্ধ আর কতদিন চলতে পারে, বঙ্গবন্ধু কোথায়, শত্রর বিরুদ্ধে অবরোধ টিকবে কিনা—সে সম্পর্কে কারো পরিষ্কার ধারণা নেই। সবাই একটা আপাত-ব্যবস্থা হিসেবে পাকিস্তানি বাহিনীর তোপের মুখ থেকে পালাতে শুরু করেছে।
অন্য সময় হলে এত লোকের আনাগোনায় হৈচৈ ও হুল্লোড় পড়ে যেত, কিন্তু চিৎকার চেঁচামেচি নেই, ভয়ে শিশুরাও চুপচাপ, এমনকি একটা কুকুর বা দাঁড়কাকের শব্দ পর্যন্ত নেই, সবকিছু নীরবে সামাধা হচ্ছে। বেওয়ারিশ একটা কুকুর নৌকোর পেছন পেছন সাঁতরাতে শুরু করেছে। খেতের ওপর দিয়ে, বরজের ভেতর দিয়ে, ভিটে গোপটি ও বিলের খানাখন্দ পেরিয়ে মানুষ ছুটছে প্রাণভয়ে। কোলে শিশু, হাতে কোমরে বা মাথায় বোঁচকা ও পুটলি। সবার মুখে কে যেন ছিপি এটে দিয়েছে, শুধু নৌকার দাড়ের শব্দ, সাম্পানের বৈঠার ডাক আর মাঝির হম্বিতম্বি—ডুবে যাবে, অর নয়, আর একজনও উঠবে না —ইত্যাদি ইত্যাদি।
আধ ঘন্টার মধ্যে গ্রাম একেবারে ফাঁকা। সারা গ্রামে দশ-বিশ জন বুড়ো ছাড়া বোধ হয় কেউ নেই, কোনো কোনো বাড়ি ফাঁকা, গাছের একটি পাতাও নড়ছে না, আর সত্যি বলতে কি সেদিকে কেউ তাকিয়ে দেখেছে কিনা তাও বলা মুশকিল।
দুঃসংবাদটি নিয়ে এসেছে পল্টন। বাস-চলা রাস্তার ধারে বাজারে গিয়েছিল সে কোনো কাজ জোটাতে। চব্বিশে মার্চের পর থেকে কারখানা বন্ধ, দু’দিন অসুখে পড়েছিল বলে বেতনের টাকাও তুলতে পারে। নি। সবাই বেতন তুলে নিয়েছে, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ—ছাব্বিশ তারিখের মধ্যে শ্রমিকের বেতন দিতে হবে। পল্টন কাজ খুঁজতে গিয়েছিল থানার বাজারে। গ্রামের লোকজন তাকে পাগলা পল্টন বলে ডাকে। ভারী ভারী মােট বইতে পারে সে, দুই-আড়াই মণের বস্তা কাঁধে তুলে নিলে শুয়োরের মতো মাথা নিচু করে ছুটতে পারে, আর প্রাণ খুলে গান গাইতে জানে। সে গান কখনো নিজের বাঁধা, কখনো রেডিওর গানের সঙ্গে নিজের ইচ্ছেমাফিক জুড়ে দেওয়া কলির, তবে কীর্তনের দোহার হিসেবে পল্টনের নাম আছে তার সুরেলা ভারি গলার জন্য। ভোরের সিফটে কাজে যাওয়ার সময় সে পাড়া মাতিয়ে যায়, কুয়াশার অন্ধকার ভোরে তার গলা শুনে অনেকে ঘুম থেকে জাগে, এজন্য তাকে কেউ কেই পল্টন -ঘড়ি নামও দিয়েছে।
বাজার থেকে খবর নিয়ে যখন সে ছুটতে ছুটতে এল সবাই এক বাক্যে বিশ্বাস করে নিল। কেউ তার কথায় দ্বিতীয় প্রশ্ন তোলে নি, পাগল বলে কেউ তার কথা উড়িয়ে দেয় নি। সবাই জানে মিলিটারিরা শহর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছে, অার দশ-বিশ মিনিট আগে কামানের শব্দ তো সবাই শুনেছেই। দু দিন ধরে সবাই এ নিয়ে জল্পনা-কল্পনা করছে। কামনি ও মর্টারের শব্দ শুনেছে দূরে দূরে। অজি একেবারে পশ্চিমের মুড়ার কাছে গর্জে উঠেছে কামান। ঢাকা থেকে গাড়িতে ও পায়ে হেঁটে এবং নানা কাণ্ড করে বাড়িতে এসেছে উদয়ন, পুরো দু’টি দিন লেগেছে তার। তার বর্ণনা অনুযারী ঢাকার বস্তি, বিশ্ববিদ্যালয়ের হল, পুলিশ লাইন ও পত্রিকা অফিস তছনছ হয়ে গেছে। তরুণদের পেলেই গুলি করছে তারা, হন্যে হয়ে খুঁজছে অাওয়ামী লীগের লোকজন, বঙ্গবন্ধুকে বন্দী করে নিয়ে গেছে করাচীতে।
গ্রাম ফাঁকা হওয়ার পর পল্টন লোকের বাড়ির অনাচ-কানাচ দিয়ে ঝাড়-জঙ্গল পেরিয়ে প্রত্যেকের বাড়িতে বাড়িতে বিহারি মেয়েটির খোজ নিল। তিনদিন ধরে মেয়েটি গ্রামে আছে। তার মা-বাবা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে রাতের আঁধারে গ্রামে এসে আশ্রয় নিয়েছে। গ্রামের পথঘটি বা কাউকে চেনে না সে। সে জানে না তার মা-বাবা বেঁচে আছে কিনা, বেঁচে না থাকারই কথা। বঙ্গবন্ধুর পরিষ্কার নির্দেশ।
ছিল হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রীষ্টান সবাই বাঙালি, বিহারি ভাইদের গায়ে যেন কেউ হাত না তোলে। পল্টন মনে মনে সব ভেবে নিল, ভাবলো , মুন্নির কিছু হয় নি তাে? ওর মা-বাবাকে মেরে ফেলে নি তো কারখানার গুণ্ডারা?
তিনদিন আগে ভাের ফুটতে না ফুটতে গ্রামের বৌদ্ধ বিহারের বারান্দায় গুটি মেরে বসেছিল সে। বিহারের ভান্তে প্রতিদিনের অভ্যেস মতো ভোরে দিকচক্রমনের সময় মুন্নিকে প্রথম দেখতে পায়। ছোট একটি কাপড়ের পুঁটলি দু হাতে জড়িয়ে ধরে গুটিসুটি মেরে বসেছিল। ওর পাশে বিহারের স্থায়ী বাসিন্দা কুকুরগুলাে কুণ্ডলি পাকিয়ে ঘুমুচ্ছে। বিপদের রাতে একটা কুকুরও যদি সঙ্গী থাকে, মানুষ সাহস পায় লড়ে যাওয়ার। মুন্নি কী করে চার মাইল দূর থেকে এখানে এসে পৌঁছলো সে নিজেও জানে না। রাস্তার লােকজনের চোখ এড়িয়ে রাতের পথ চলা ও খুব মুশকিল। ভান্তের দরজা খোলার শব্দে সে চমকে আরো কুকড়ে যাচ্ছিল।
অদৃশ্য হওয়ার কোনো মন্ত্র জানা থাকলে সে নিজেকে ঠিক তাই করত। কিন্তু চোখের সামনে কমলা রঙের বস্ত্র পরিহিত ভিক্ষু অনিন্দকে দেখে সে দীর্ঘ নিংশ্বাস টেনে দাঁড়িয়ে দু’হাত জোড় করে বলল, আমাকে আশ্রয় দিন।
প্রথমে লাল মোহাম্মদের বাড়িতে আশ্রয় পেল সে। সেখান থেকে পঞ্চনদের পাশের বাড়িতে ছিল। পল্টন সারা গ্রাম তন্ন তন্ন করে
খুঁজল। গ্রামের রাস্তায় না নেমে ভিটে থেকে ভিটে পেরিয়ে সবখানে খুঁজল। কেউ তাকে দেখে নি। কারো সঙ্গে পালিয়েও যায় নি। কে তাকে সঙ্গে নিয়ে ঝামেলা বাড়াবে। গ্রামের সবচেয়ে সাহসী তরুণরা আগে থেকেই ঘর ছেড়ে পালিয়ে গেছে। কেউ গেছে বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকদের সাথে, কেউ কেউ সীমান্তের দিকে চলে গেছে, বাকি দু'-চার জন যারা ছিল তারাও মিলিটারির খবর পেয়ে যে-যার মত পালিয়ে গেছে।
খুঁজতে খুঁজতে পল্টন দেখল কারো ঘরের দরজা হাট করা অথবা রশি দিয়ে বেড়ার দরজাটা কোনাে মতে বেঁধে দিয়েছে। বুড়ো-বুড়ি বা যারা অাছে তারা ভয়ে কাঁপছে। তাদের একমাত্র ভরসা, বয়সের জন্য হানাদার পাকিস্তানিরা তাদের মাফ করে দেবে—তারা সবাই এক নিঃশ্বাসে পল্টনকে পালাতে বলল। কারাে কথা শুনল না পল্টন । পূর্ব থেকে পশ্চিম, উত্তর ও দক্ষিণ কোনাে বাড়ী বাদ দেয় নি সে। শেষে হতাশ হয়ে গেল বিহারে। বুড়ো অনিন্দ ভান্তে তখন দুপুরের প্রার্থনায় বসেছেন। সামনে গৌতম বুদ্ধের সৌম্য মুর্তি। পল্টন চুপচাপ ভান্তের পেছনে বসে পড়ল। প্রার্থনায় তার মন নেই। একবার ভাবল ডাকবে, কিন্তু পারল না। আবার উসখুসকরে, আবার অস্থির চিত্তে প্রার্থনা জানায় বুদ্ধের কাছে, বঙ্গবন্ধু ও মুন্নি যেন ভালো থাকে।
আবার উঠে দাঁড়ায়, বেরিয়ে উঠোনে গেল, উঠোন থেকে পুকুরের পাড় দিয়ে দূরে পুব দিকটা দেখল। সেদিক থেকেই হানাদার সৈন্যরা আসবে। বিলে ইরি ধনি একটুও কাপছে না, কে জানে শত্রুর ভয়ে নাকি প্রাকৃতিক নিয়মে। ধানখেতের পরই টিলাটিলার ঝোপ-ঝাড়ে শত্রুরা ওৎ পেতে বসে আছে কিনা দেখতে পেল না পল্টন । সে আবার ছুটল ভান্তের কাছে। ভান্তের কথা মতো মুন্নিকে লাল মোহাম্মদের বাড়িতে রেখেছিল প্রথমে। ভান্তে গ্রামের তরুণদের বলেছিলেন, সঙ্কটময় মুহর্তে স্থির থেকে কর্তব্য পালন করবে। মানবসভ্যতার ধ্বংস নিয়ে আসে যুদ্ধ,যুদ্ধ কোনাে সমস্যার স্থায়ী সমাধান দিতে পারে না, কিন্তু অনাদিকাল থেকে মানুষ যুদ্ধ এড়াতে পারে নি, মহামতি অশোকও পারে নি, বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলনও শেষ পর্যন্ত সশস্ত্র সংগ্রামে পরিণত হল।
মানুষ কত কি ভাবে! ফেব্রুয়ারি-মার্চের উত্তাল দিনগুলোতেও মানুষ নিজের হাতে আইন তুলে নেয় নি, সবার এক কথা—জাতীয় সংসদের বৈঠক বসুক, সংসদই সব সমস্যার সমাধান করবে, রাজনীতির প্রক্রিয়ায় সবকিছুর সমাধান করবে রাজনীতিকরা।
প্রার্থনা শেষে উঠলেন অনিন্দ ভান্তে। ঠিক তখনই পুব দিকে গুলির শব্দ শোনা গেল। পল্টনের বুক এক নিমেষে ফাঁকা, দুরু দুরু কাঁপতে শুরু করল। তার মা পালিয়ে গেছে, যাওয়ার আগে দেখাই হল না।
পল্টন ডাকল, ভান্তে।
ভিক্ষু অনিন্দের সৌম্য চেহারায় কালাে ছায়া দেখা দিল। কিছু বলার অাগে তিনি ভেবে নিতে চান সবকিছু। চোখ তুলে তিনি বললেন, তুই পালিয়ে যাস নি? যা, তাড়াতাড়ি লুকিয়ে পড়।
পল্টন বলল, মুন্নিকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না। কেউ তাকে সঙ্গে নিয়ে যায় নি শুনেছি, তাছাড়া আপনাকে না জানিয়ে তো যাওয়ার কথা নয়। অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর তিনি আবার বললেন, তুই তাড়াতাড়ি সরে পড়।
পল্টন বুঝতে পারে মিলিটারির মুখোমুখি হওয়া উচিত হবে না। কিন্তু মুন্নির জন্য মনটা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে, ঠিক তখনই আবার গোলাগুলির শব্দ আকাশ পাড়ি দিতে দিতে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। মাহুতের টিলার দিক থেকে শব্দটা আসছে মনে হয়, কিন্তু একটু পরে সবই পরিষ্কার হয়ে গেল -প্রামে ঢুকে পড়েছে ওরা। পুব পাড়ায়।
আগুন জ্বলছে। গ্রামে ঢুকেই ওরা আগুন দিয়েছে, গাছপালার ওপর দিয়ে ধোঁয়া ও আগুন দেখা যাচ্ছে। তিন লাফে পল্টন বিহারের উঠোন পেরিয়ে গড়ে নামল। উত্তর-পশ্চিম দু’দিকেই গড়, গড়ে বেতের ঝাড়, তারপর সুপুরি ও ছনের বন, সে গড় পেরিয়ে ছন বনে ঢুকে পড়ল। দম নিয়ে শুনতে চেষ্টা করল লোকজনের বা ঘর পোড়ার শব্দ। তার। বদলে শুনল খসখস অাওয়াজ, সে অাওয়াজ অসিছে আশপাশ থেকেই। কান পেতে শুনল, মুন্নি তার নাম ধরে ডাকছে। পল্টনের বুক আবার দুরু দুরু বেজে উঠল। আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল ছনের খোঁচা বাঁচিয়ে, তবুও হাত-পা ছড়ে গেছে, জ্বালা করছে।
মুন্নি মাথা নিচু করে বলল, পালিয়ে যাওয়ার সময় কেউ আমাকে সঙ্গে নিল না।
পল্টন বলল, তোমাকে খোঁজার জন্য... আমি সবার মতো পালিয়ে যাই নি।
রাখো তােমার বদান্যতা। এখন যদি আমি বের হই, তোমাদের শত্রদের কাছে গিয়ে আমার মা-বাবাকে হত্যা ও লুটপাটের কথা বলি তাহলে কি হবে একবার ভেবে দেখেছ? পুরো গ্রামটাই পুড়িয়ে দেবে।
জানি, সব জানি। কিন্তু তোমাকে সঙ্গে নিয়ে গেলেও তাে বিপদ থাকতে পারে। যার সঙ্গে নিয়ে যেতে পারত তারা গেছে যুদ্ধ করতে, ট্র্যানিং নিতে। এখন কে তোমার দায়িত্ব নেবে ঝুকি নিয়ে?
এখন যদি সব বলে দেই?
ওদের লালসার হাত থেকে তুমিও রেহাই পাবে না। তুমি ওদের চেন না।
কথাটা মুন্নি একবারও ভেবে দেখে নি। তার রূপ, যৌবন ও বয়সের কথা গণনায় ধরে নি। ভিক্ষু আনন্দের জন্য সে গ্রামের টাউট ও বদ লোকের হাত থেকে বেঁচে আছে তার হিসাব করে নি। পল্টনের কথায় সে আঁতকে উঠে বলল, তাহলে কি হবে?
ঘর পোড়ার শব্দ তখন হঠাৎ কমে এল। গোলাগুলির শব্দও নেই। নরপশুরা গুলি করবেই বা কাকে, সবাই তো পালিয়ে গেছে। পল্টন প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, বােধ’য় আর আগুন দিচ্ছে না।
অাগুন কে নেভাচ্ছে!
কে জানে। হয়তাে কেউ নয়।
ওরা কয় জন হবে বলতে পারো?
তা হবে বিশ-পঞ্চাশ জন। সঙ্গে কিছু রাজাকারও আছে। তারপর আবার শোনা গেল গুলি ও ঘর পোড়ার শব্দ। মুন্নি চুপ করে রইল। পটন একবার ডাকল, কিন্তু কোনো সাড়া পেল না। মাথা নিচু করে ছনের ডগা ছিড়তে ছিড়তে কাঁদো কাঁদো সে। ওর ভাব দেখে পল্টনের সব ওলােট-পালোট হয়ে গেল। কী বলে সত্বিনা দেবে, কী করবে ভেবে পেল না। মুন্নি মা-বাপকে হারিয়ে নিজের দেহ বাঁচানোর জন্য পালিয়ে বেড়াচ্ছে, অন্ধকার রাতে এই গ্রামে চলে এসেছে। পথ-ঘাট কিছুই জানা ছিল না, কাউকে চেনে না। তবুও এরাতো কয়দিন অশ্রিয় দিয়েছে, এখন না হয় সে-আশ্রয়ও খড়কুটোর মতো উড়ে গেল।
মুন্নি এবার মুখ তুলে বলল, তোমরা আমাকে মেরে ফেলতে পারো না? তাহলে অপদ চুকে যায়।
মুন্নি কথা শুনে কেঁপে উঠল পল্টন, কিন্তু সত্বিনা বা কোনো উত্তর মুখে এল না। যুদ্ধ শুরু হয়েছে এক মাস, শান্তির কোনাে অভিসি নেই। শান্তিরও বা কী দোষ, সে তাে আর উড়ে এসে মেঘের মতো ছায়া মেলে দিতে পারে না, অরি পারে না মেঘের মতো ঝরঝর বৃষ্টি হয়ে ঝরতে। মুন্নিকে সবাই দূরে সরিয়ে দিতে চায়, যুবতী বলে লালসার চোখে দেখে কেউ কেউ। কে আর এই বিপদের দিনে উটকো ঝামেলা কাঁধে নিতে চায়। খান সেনাদের হাতে পড়লে কী হাল হবে শুনেছে, ওর মা-বাবা কারখানার গুণ্ডাদের শিকার হয়েছে, কর্ণফুলীতে ভেসে যাওয়া লাশের মধ্যে তারাও হয়তো ছিল—মুন্নিকে নিয়ে কী করবে ভেবে উঠতে পারল না পল্টনও।
মুন্নি কাদছে। সে আবার বলল, কেউ দেখবে না, কেউ জানবে না , অপদ বিদেয় করাে। মুন্নির মুখে দ্বিতীয়বার মৃত্যুর কথা শুনে পল্টনের মনে সন্দেহ জাগল। সত্যিই তো, কেউ দেখবে না, কেউ জানতেও পারবে না, আর জানলেও সবাই চেপে যাবে না। শত্রুরা গ্রামে ঢুকে পড়েছে, আর লুকিয়ে রাখাও যাবে না। পল্টনকে ভাবতে দেখে মুন্নি আবার বলল, ভয় পাচ্ছি কেন? একটি মানুষ হত্যা করতে পারাে না তো কি পুরুষ হয়েছ? দেশ স্বাধীন করবে কি করে?
পল্টন আবার ধাধায় পড়ল। এভাবে কেউ কোনো দিন চোখে আঙুল দিয়ে কথা বলে নি, এরকম সমস্যায়ও কোনাে দিন পড়ে নি।। হাসান মাষ্টার যদি থাকত, অমর মাস্টার থেকে যদি জিজ্ঞেস করে নিতে পারত--কিন্তু তারাও তাে মুন্নিকে লুকিয়ে রাখতে পারত না। মুন্নির জীবনের নিশ্চয়তা তারাও কি দিতে পারত? তারা কোথায় গেছে কে জানে।
কিছু বলতে না পেরে আমতা আমতা করে চুপ করে রইল পল্টন। রবীন্দ্রনাথের তিন্নি ও দালিয়ার কথা মনে পড়ল। মাত্র গতকাল গল্পটি পড়েছে সে, হাসান মাষ্টার বইটি দিয়েছিল--এত গল্প থাকতে “দালিয়া গল্পের কথাই বা কেন মনে পড়ল বুঝতে পারল না সে।
চুপ করে আছ কেন, তাড়াতাড়ি করো। এভাবে কেউ হত্যা করতে পারে? তুমি পারবে আমাকে মারতে?
তোমার মতো হলে পারতাম। একটি মেয়েকে আশ্রয় দিতে না পারলে বিষ তুলে দিতাম হাতে।
পল্টন আবার চুপ করে গেল, আবার বলল, তোমাকে খুঁজতে খুঁজতে এখানে এসেছি।
খুঁজতে না নিজের জীবন বাঁচাতে। দুই-ই সত্য।
আমাকে বাঁচাতে পারবে?
কী করে রক্ষা করতে পারি সে চেষ্টা করছি। ভান্তেও তোমার জন্য উদ্বিগ্ন।
গুলিগোলার শব্দ থেমে গেল। ঘর পোড়ার শব্দও শোনা যাচ্ছে না। চারদিক থমথমে শব্দহীন। পল্টন সাহস করে ছনের ওপর দিয়ে দেখার চেষ্টা করল। কিন্তু কিছুই দেখার উপায় নেই। পুব দিকটায় ঘন মাদার গাছ, দক্ষিণে বেতের ঝাড়, উত্তর দিকেও। ঝোপঝাড়ে ভরা ও খালের পাড়–কোনােদিকে কিছুই দেখা যায় না, মুন্নিও তেমনি বসে রইল।
পল্টন হতাশ হয়ে বসে পড়ল। শত্রুরী চলে যাচ্ছে হয়তো অথবা গ্রাম তছনছ করছে। ওরা কলেজে ঘাটি করবে। টিলার ওপর। কলেজ, পাশে বড় রাস্তা—সামরিক দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
তারপর বলল, মুন্নি, তুমি একটু অপেক্ষা করাে, দেখি ওরা চলে গেছে কিনা।
মুন্নি সঙ্গে সঙ্গে ওর হাত ধরে বসিয়ে দিল। খবরদার এক পা-ও নড়বে না। ওরা এখনো যায় নি। ওদের চেনো না তুমি, এতক্ষণ পর তোমাকে দেখলে সঙ্গে সঙ্গে গুলি করবে, কতজন মরেছে এতক্ষণ কে জানে।
ওরা আবার চুপচাপ বসে রইল। পল্টনের বুকের মাঝে ঝড়। মুন্নির দিকে তাকাতে পারছে না। ওর ইচ্ছে করছে মুন্নিকে জড়িয়ে ধরে বুকের ভার লাঘব করে। মুন্নি হয়তো ভাবছে, এক গ্রাম লোকের মধ্যে তাকে রক্ষা করার কেউ নেই, কেউ সঙ্গে নিয়ে যেতে সাহস পেল না, মেয়ে বা বউয়ের মর্যাদা দিয়ে ঘরে তুলে নিতে পারল না কেউ। কী মানুষ এরা , এক ফোটা সাহস নেই, প্রতিরোধ করার ক্ষমতা নেই। তারপর শুধু বলল, স্বাধীন হলে দেশ রক্ষা করতে পারবে তাে !
পল্টন সে কথারও কোনাে উত্তর দিতে পারল না। সে বসে বসে মুন্নির হাত ও পায়ের আঙুল গুনছে। মুন্নির সব নখের গোড়ায় এক ফালি সাদা চাদ, খুব ইচ্ছে করছে আঙুল ধরে নাড়াচাড়া করে, কিন্তু হাঁটুর ওপর থুতনি রেখে চুপচাপ বসে রইল। মুন্নি হয়তাে ওর মনের ভাব বুঝতে পেরেছে; অথবা খেলাচ্ছলে পল্টনের বাঁ হাতটা তুলে নিল। পল্টনের হাত শক্ত, রেখা খুব কম ও কর্কশ! মুন্নির নরম হাত যেন নুয়ে পড়বে ভারে।
মুন্নি চোখ না তুলে বলল, আমার জন্য খুব ভাবছ জানি, তবুও তো কয়দিনের জন্য আশ্রয় পেয়েছি তোমাদের গ্রামে, ভান্তেও আমার জন্য খুব উদ্বিগ্ন। যে বিভীষিকা দেখে পালিয়ে এসেছি সে-কথা ভাবতেও হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসে--তারাও তোমাদের মানুষ, লুটপাট করছে ঘরের জিনিসপত্ন, খুন করেছে মা-বাবাকে--বলতে বলতে ঝরঝর কেঁদে দিল। কাঁদতে কাঁদতে বলল, কেন তারা শেখ মুজিবের নির্দেশ মানল না বলোতো?
মুন্নির কথায় পল্টনের চেতনা হল। মুন্নির বাবাকে মেরে নদীতে ফেলে দিয়েছে ? কে জানে কতদিন যুদ্ধ চলে, কতদিন পর আবার ঘরের দাওয়ায় নিশ্চিন্তে ঘুমুতে পারবে, সেসব দিন আবার কবে ফিরে আসবে, কবে আবার বঙ্গবন্ধু ডাক দেবে উদাত্ত কণ্ঠে, কবে আবার শুনব- ভায়েরা আমার... মুন্নি হঠাৎ বলল, সত্যি করে বলো তো তোমরা কেন যুদ্ধ করছ ?
পটন প্রায় চিৎকার করে বলল, আমরা স্বাধীনতা চাই।
কেন তােমরা কি পরাধিন ?
পাকিস্তানিরা অমাদের শত্র, আমরা বাঙালি, ওরা আমাদের শোষণ করেছে এতদিন, আমাদের বঞ্চিত করেছে ন্যায্য পাওনা থেকে।
স্বাধীন হলে অন্য কোনাে দেশ শোষণ করবে। না, পারবে না।
তাহলে নিজের দেশের উঠতি ধনীরা করবে। তুমি যে-গরীব সে গরীবই থাকবে। গরীবের কোনো বন্ধু নেই।
না, পারবে না। সমাজতন্ত্র আসিবে, বঙ্গবন্ধু বলেছে এদেশে কেউ না খেয়ে থাকবে না, শোষিত হবে না। ধর্ম-নিরপেক্ষ রাষ্ট্র হবে এই বাংলাদেশ। মুন্নি আবার বলল, তুমি বৌদ্ধ, তুমি নাস্তিক।
ঐ যে পাকিস্তানি মিলিটারিরাও তো আল্লা বিশ্বাস করে, তারা কেন বিনা দোষে মানুষ মারছে? তোমার বাবাকে যারা খুন করেছে তারাও খোদা বিশ্বাসী।
বাপের কথায় মুন্নি চুপ করে গেল। তার মনে দ্বন্দ্ব লেগে গেল। পল্টনরা যদি নাস্তিক হয় তাকে তো আশ্রয় দিয়েছে, বাঁচাতে চেষ্টা করছে, সে খুঁজতে খুঁজতে এখানে এসেছে। ভিক্ষু আনন্দ তার জন্য অনেক করেছে। তিনিও তাহলে স্রষ্টাকে বিশ্বাস করেন না? মুন্নি আরেক সমস্যায় পড়ল। পল্টন তাকে নির্জনে একা পেয়েও কিছু করছে না। অথচ তার বাবাকে যারা হত্যা করেছে, মাকে যারা ধরে নিয়ে গেছে তারা? তাকেও নিয়ে যেত, শেয়াল-শকুনের মতো ছিড়ে-খুঁড়ে খেত, সবাই তার দিকে লালসার চোখে তাকায় তাই সে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। কী অলৌকিকভাবেই না সে বেঁচে এসেছে। অমনিসে শােকে মুহ্যমান হয়ে পড়ল।
আস্তে আস্তে তার হাত তুলে নিল পটন। এতক্ষণ মুন্নি তার হাত ধরেই ছিল, এবার পল্টন হাত বুলাতে লাগল, মুন্নি অধীর হয়ে পড়ল। পটন তার মাথায় হাত রাখল, হঠাৎ পল্টনও কেঁপে উঠল। মুন্নি এটুকুই চেয়েছিল হয়তো, পল্টনও যেন এই চেয়েছিল, অথবা কে জানে মানুষের মন ও দেহ কখন কী চায়। মানুষের মাঝে কেউ কেউ হাজারাে সমস্যায় ভুবে কাজ করতে পারে, জটিলতা থেকে বেরিয়ে আসার পথও তারা ঠিক পেয়ে যায়। কেউ কেউ সুস্থ-স্বাভাবিক থেকেও কোনাে কাজ সঠিকভাবে শেষ করতে পারে না, অথচ অরেকজন সমস্যার অতলে ডুবেও সমাধান বের করে নিতে পারে। মুন্নি হলেও-বা পল্টন অসচরাচর ধাচের মানুষ নয়। দুর্যোগের আগেই সবাই মুক্তির পথ খুঁজতে থাকে, অার যুদ্ধ-বিগ্রহের মতো দুর্যোগে ভালো-মন্দ-বুদ্ধিমান সব মানুষকে কোনো না কোনােভাবে মূল্য দিতে হয়।
মুন্নিদের সমস্যাই ভিন্ন রকম, তারা বাঙালি নয়, মাথা নত করে সব মেনে নেয়া ছাড়া কোনো উপায়ই নেই। তারপর মুন্নি অস্তে আস্তে নিজের হাতের রুপাের আংটি খুলল, পল্টনকে বলল, আঙটিটা আমাকে পরিয়ে দাও তুমি।
পল্টন ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর মুন্নি বলল, চলো অামরা পালিয়ে যাই। শুনেছি, সবাই পালিয়ে যাচ্ছে সীমান্তের দিকে, আমরাও যাই। সেখানে অামরা জীবন শুরু করব। সেখান থেকে পশ্চিমবঙ্গ হয়ে আমাদের দেশে চলে যেতে পারব। পল্টন বলল, এটাই তো তোমার দেশ।
না, এ-দেশ আমার নয়। যদি আমার হত এ-অবস্থা হত না। অামাদের সবাই বিহারি বলে ঘৃণা করে।
তুমি এদেশী হয়ে যাও। বাঙালি হয়ে যাও। কেন বাঙালি হব? পল্টন আর কথা বাড়াল না। শুধু বলল, আমার মা অাছে।। তোমার মাকে সঙ্গে নাও।
মুন্নি যেন খড়কুটো ধরে হলেও আশ্রয় চায়। বাঁচতে চাইছে। জীবনের অর্থ খুঁজতে খুঁজতে নানা কথা বলছে। কিছুক্ষণ আগেও হত্যার কথা বলেছে, আবার নিজের দেশের কথা বলেছে, আবার পল্টনের হাতে নিজেকে সঁপে দিয়ে বাঁচতে চায়। এ জঙ্গল যদি শত্রুর নাগালের বাইরে হত, কেউ তাদের খুঁজে না পেত—বেঁচে থাকার মধ্যে কী যে মাধুর্য তা মুন্নি অনুভব করতে শুরু করেছে।
তারপর সে পল্টনের হাত তুলে নিল, বুকে জড়িয়ে ধরল, চুমোয় চুমোয় ভরে দিল, তার ইচ্ছে পল্টন তাকে আরাে আদর করুক, সমস্ত শরীর দখল করে নিক, দলিত করুক। তার বুকে ঘন্টার শব্দ, স্তনে রাইফেলের গর্জন, তারপর এক সময় পল্টনের শরীরে নিজের ভার তুলে দিল, নিজের বুকের মধ্যে পল্টনের মুখ চেপে ধরল। মুন্নিকে ছেড়ে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল পল্টন। খোঁজ-খবর নেওয়া দরকার, বিকেল হয়ে আসছে, চারদিক নিঃশন্দ, গাছপালা স্থির। মুন্নি আর বাধা দিল না। বিপদআপদ থেকে মানুষ নিজেকে ঠেকিয়ে রাখতে পারে না। যদি পারত তাহলে নিজের দেশগ্রাম ছেড়ে এই পরবাসে আসতে হত না মুন্নিকে। এক সময় পরবাসকেও নিজ বাসভূমি ভাবতে শুরু করেছিল, স্কুলে পড়তে পড়তে বাংলা ভাষা শিখেছে, কলেজে উঠে ছাত্র রাজনীতিতে যােগ দিয়েছে...এখন সে আবার উদ্বাস্তু।
পল্টনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে উঠতেই আরো বিপর্যয়ের চেহারা দেখতে শুরু করল। এর পরিণতি কি? পল্টনকে ছাড়তেও যন্ত্রণা--সারা শরীরে দুঃখ ও সুখের প্লাবন যুগপৎ আশা যাওয়া করছে।
ছনের জঙ্গল, গড় ও বেতঝাড় পেরিয়ে ভিক্ষু আনন্দের কাছে গেল পল্টন । ভিক্ষু অনিন্দও সবেমাত্র বিহারের উঠোনে পা দিয়েছেন। তার সৌম্য চেহারায় ক্লান্তি ও বিষন্নতার ছায়া, অল্প সময়ের মধ্যেই বার্ধক্য তাঁকে চেপে ধরেছে। ধীর পায়ে তিনি এগিয়ে আসছেন, তাঁর হাতে গান্ধীর রীতিতে আঁকা বুদ্ধের প্রতিকৃতি।
পল্টন হাত জোড় করে প্রশ্ন করল, ভান্তে, ওরা চলে গেছে ?
বিষণ্ণ গলায় তিনি বললেন ঘর পোড়ার কথা, মানুষ হত্যার কাহিনী, অত্যাচারের কথা--তিনি সংক্ষেপে বর্ণনা করলেন। বললেন, আমরা চীনা বৌদ্ধ বলে ওদের থামিয়েছি, বোধ হয় বিশ্বাস করেছে। বুদ্ধের এই ছবি দেখে চিনেছে হয়তো।
শুনতে শুনতে পল্টন শরীরের সব শক্তি যেন হারিয়ে ফেলছে। তবুও কোনো মতে প্রশ্ন করল, কে কে মরল ভান্তে।
বাবুল, জামাল, রশিদ। ওরা চলে গেছে এখন?
হ্যা। তবে আবার যে কোনো সময় অাসতে পারে। শান্তি কমিটি গঠন করতে বলে গেছে। মুক্তিফৌজের খবর দিতে হবে। গ্রামে নতুন কেউ এলে সঙ্গে সঙ্গে ওদের জানাতে হবে। কলেজে ওরা ঘাঁটি গেড়েছে। বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিক খুঁজে বেড়াচ্ছে।
তাহলে এখন কি হবে?
কি আর হবে ?--তারপর পল্টনকে প্রশ্ন করল, মুন্নি সম্পর্কে কি ভাবছ ?
পটনের বুকের ভেতর তোলপাড়। মনে মনে বলল, তাহলে কি তিনি সব জানেন? তারপর বলল, ওকে নিয়ে পালিয়ে যাবার কথা ভাবছি।
কোথায় যাবে ? এখন সোজা রামগড় যাব। কিন্তু পথে পথে মানুষকে কি জবাব দেবে?
সে তখন দেখা যাবে। তাছাড়া ওকে কোথায় লুকিয়ে রাখব? মিলিটারীরা জানতে পারলে পুরো গ্রাম পুড়ে ছাই করে দেবে। তোমার মা কোথায়?
পালিয়ে গেছে সবার সঙ্গে। নিজেকে কিছুতেই সংযত করতে পারছে না সে। হাঁটতে হাঁটতে বিহারের হলঘরে ঢুকে ভিক্ষু অনিন্দকে হাত জোড় করে বলল, ভান্তে, আমি মুন্নিকে বিয়ে করব।
ভিক্ষু অনিন্দ চোখ তুলে তাকালেন। পটন হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে অাছে অনুমতির জন্য। ভিক্ষু চুপচাপ, কী বলবেন, কী উপদেশ দেবেন ভাবছেন তিনি।
ভান্তে, অনুমতি করুন? ওকে নিয়ে আসি বিয়ে করে আজই পালিয়ে যাব, অনুমতি দিন।
অনেকক্ষণ পর ভিক্ষু আনন্দ কথা বললেন, ওর মত আছে? অাছে। এসময় কি বিয়ে করা ঠিক হবে ? অজই আমরা চলে যাব। কেউ জানবে না।
তুমি এমন সিদ্ধান্ত নেবার আগে ভালো করে ভেবে দ্যাখাে। ভেবে দেখেছি।
তুমি অনুমতি চাইলে দিতে হবে। তোমার স্বাধীন মতে আমি বাধা দেব না।
মুন্নির ইচ্ছা আছে। আমারও। ভিক্ষু অনিন্দ এবার বললেন, যাও। ওকে নিয়ে এসো।
সূর্য ডুবতে বসেছে। চারদিক শান্ত, শুধু গ্রামের একটি বাড়ি থেকে গরুর হাম্বা শব্দ শোনা গেল, বিহারের বড় বড় নাগকেশর গাছ থেকে শুকনো ফুল ঝরে পড়ছে, বাঁশ ঝাড় শরশর শব্দ তােলে, বাসায় ফেরা পাখিদের ডাক শোনা যায়, গ্রামখানি শান্ত নির্ভর হয়ে উঠতে চায় যেন, পল্টনের বুকের ভারি পাথরখানা সরতে শুরু করেছে সে অনুমতি পেয়েছে, মুন্নির শরীরের সুখ-স্পর্শ এবার তাকে প্রবলভাবে নাড়া দেয়।
আকাশ গাঢ় নীল। পটনের বুকের ভার অনেক হাল্কা । সে দ্রুত পায়ে গড় ও ঝাড় পেরিয়ে, দু হাতে ছন সরিয়ে মুন্নির কাছে ছুটল। মনে মনে ডাকল, মুন্নি মুন্নি। ওরা দু’জন যেখানে বসেছিল সেখানে মুন্নি নেই। ওরা বসেছিল বলে জায়গাটা পরিপাটি হয়ে অাছে। বুকের শব্দ শুনতে শুনতে পল্টন আস্তে আস্তে ডাকল, মুন্নি।
ভালােবাসায়, বেদনায়, ঐশ্বর্যে বুক উপচে পরছে তার। আবার আদর করে ডাকল, মুন্না, মুন্না।
দু' হাতে ছন সরিয়ে খুঁজতে খুঁজতে মুন্নিকে পেল অবশেষে। মুন্নি শুয়ে আছে। কাছে গিয়ে উপুর হয়ে থুতনিতে হাত দিতেই মুখের অনেকখানি লালা তার হাতে লাগল এবং বুঝতে পারল মুন্নি আর বেঁচে নেই।
অন্য সময় হলে এত লোকের আনাগোনায় হৈচৈ ও হুল্লোড় পড়ে যেত, কিন্তু চিৎকার চেঁচামেচি নেই, ভয়ে শিশুরাও চুপচাপ, এমনকি একটা কুকুর বা দাঁড়কাকের শব্দ পর্যন্ত নেই, সবকিছু নীরবে সামাধা হচ্ছে। বেওয়ারিশ একটা কুকুর নৌকোর পেছন পেছন সাঁতরাতে শুরু করেছে। খেতের ওপর দিয়ে, বরজের ভেতর দিয়ে, ভিটে গোপটি ও বিলের খানাখন্দ পেরিয়ে মানুষ ছুটছে প্রাণভয়ে। কোলে শিশু, হাতে কোমরে বা মাথায় বোঁচকা ও পুটলি। সবার মুখে কে যেন ছিপি এটে দিয়েছে, শুধু নৌকার দাড়ের শব্দ, সাম্পানের বৈঠার ডাক আর মাঝির হম্বিতম্বি—ডুবে যাবে, অর নয়, আর একজনও উঠবে না —ইত্যাদি ইত্যাদি।
আধ ঘন্টার মধ্যে গ্রাম একেবারে ফাঁকা। সারা গ্রামে দশ-বিশ জন বুড়ো ছাড়া বোধ হয় কেউ নেই, কোনো কোনো বাড়ি ফাঁকা, গাছের একটি পাতাও নড়ছে না, আর সত্যি বলতে কি সেদিকে কেউ তাকিয়ে দেখেছে কিনা তাও বলা মুশকিল।
দুঃসংবাদটি নিয়ে এসেছে পল্টন। বাস-চলা রাস্তার ধারে বাজারে গিয়েছিল সে কোনো কাজ জোটাতে। চব্বিশে মার্চের পর থেকে কারখানা বন্ধ, দু’দিন অসুখে পড়েছিল বলে বেতনের টাকাও তুলতে পারে। নি। সবাই বেতন তুলে নিয়েছে, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ—ছাব্বিশ তারিখের মধ্যে শ্রমিকের বেতন দিতে হবে। পল্টন কাজ খুঁজতে গিয়েছিল থানার বাজারে। গ্রামের লোকজন তাকে পাগলা পল্টন বলে ডাকে। ভারী ভারী মােট বইতে পারে সে, দুই-আড়াই মণের বস্তা কাঁধে তুলে নিলে শুয়োরের মতো মাথা নিচু করে ছুটতে পারে, আর প্রাণ খুলে গান গাইতে জানে। সে গান কখনো নিজের বাঁধা, কখনো রেডিওর গানের সঙ্গে নিজের ইচ্ছেমাফিক জুড়ে দেওয়া কলির, তবে কীর্তনের দোহার হিসেবে পল্টনের নাম আছে তার সুরেলা ভারি গলার জন্য। ভোরের সিফটে কাজে যাওয়ার সময় সে পাড়া মাতিয়ে যায়, কুয়াশার অন্ধকার ভোরে তার গলা শুনে অনেকে ঘুম থেকে জাগে, এজন্য তাকে কেউ কেই পল্টন -ঘড়ি নামও দিয়েছে।
বাজার থেকে খবর নিয়ে যখন সে ছুটতে ছুটতে এল সবাই এক বাক্যে বিশ্বাস করে নিল। কেউ তার কথায় দ্বিতীয় প্রশ্ন তোলে নি, পাগল বলে কেউ তার কথা উড়িয়ে দেয় নি। সবাই জানে মিলিটারিরা শহর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছে, অার দশ-বিশ মিনিট আগে কামানের শব্দ তো সবাই শুনেছেই। দু দিন ধরে সবাই এ নিয়ে জল্পনা-কল্পনা করছে। কামনি ও মর্টারের শব্দ শুনেছে দূরে দূরে। অজি একেবারে পশ্চিমের মুড়ার কাছে গর্জে উঠেছে কামান। ঢাকা থেকে গাড়িতে ও পায়ে হেঁটে এবং নানা কাণ্ড করে বাড়িতে এসেছে উদয়ন, পুরো দু’টি দিন লেগেছে তার। তার বর্ণনা অনুযারী ঢাকার বস্তি, বিশ্ববিদ্যালয়ের হল, পুলিশ লাইন ও পত্রিকা অফিস তছনছ হয়ে গেছে। তরুণদের পেলেই গুলি করছে তারা, হন্যে হয়ে খুঁজছে অাওয়ামী লীগের লোকজন, বঙ্গবন্ধুকে বন্দী করে নিয়ে গেছে করাচীতে।
গ্রাম ফাঁকা হওয়ার পর পল্টন লোকের বাড়ির অনাচ-কানাচ দিয়ে ঝাড়-জঙ্গল পেরিয়ে প্রত্যেকের বাড়িতে বাড়িতে বিহারি মেয়েটির খোজ নিল। তিনদিন ধরে মেয়েটি গ্রামে আছে। তার মা-বাবা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে রাতের আঁধারে গ্রামে এসে আশ্রয় নিয়েছে। গ্রামের পথঘটি বা কাউকে চেনে না সে। সে জানে না তার মা-বাবা বেঁচে আছে কিনা, বেঁচে না থাকারই কথা। বঙ্গবন্ধুর পরিষ্কার নির্দেশ।
ছিল হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রীষ্টান সবাই বাঙালি, বিহারি ভাইদের গায়ে যেন কেউ হাত না তোলে। পল্টন মনে মনে সব ভেবে নিল, ভাবলো , মুন্নির কিছু হয় নি তাে? ওর মা-বাবাকে মেরে ফেলে নি তো কারখানার গুণ্ডারা?
তিনদিন আগে ভাের ফুটতে না ফুটতে গ্রামের বৌদ্ধ বিহারের বারান্দায় গুটি মেরে বসেছিল সে। বিহারের ভান্তে প্রতিদিনের অভ্যেস মতো ভোরে দিকচক্রমনের সময় মুন্নিকে প্রথম দেখতে পায়। ছোট একটি কাপড়ের পুঁটলি দু হাতে জড়িয়ে ধরে গুটিসুটি মেরে বসেছিল। ওর পাশে বিহারের স্থায়ী বাসিন্দা কুকুরগুলাে কুণ্ডলি পাকিয়ে ঘুমুচ্ছে। বিপদের রাতে একটা কুকুরও যদি সঙ্গী থাকে, মানুষ সাহস পায় লড়ে যাওয়ার। মুন্নি কী করে চার মাইল দূর থেকে এখানে এসে পৌঁছলো সে নিজেও জানে না। রাস্তার লােকজনের চোখ এড়িয়ে রাতের পথ চলা ও খুব মুশকিল। ভান্তের দরজা খোলার শব্দে সে চমকে আরো কুকড়ে যাচ্ছিল।
অদৃশ্য হওয়ার কোনো মন্ত্র জানা থাকলে সে নিজেকে ঠিক তাই করত। কিন্তু চোখের সামনে কমলা রঙের বস্ত্র পরিহিত ভিক্ষু অনিন্দকে দেখে সে দীর্ঘ নিংশ্বাস টেনে দাঁড়িয়ে দু’হাত জোড় করে বলল, আমাকে আশ্রয় দিন।
প্রথমে লাল মোহাম্মদের বাড়িতে আশ্রয় পেল সে। সেখান থেকে পঞ্চনদের পাশের বাড়িতে ছিল। পল্টন সারা গ্রাম তন্ন তন্ন করে
খুঁজল। গ্রামের রাস্তায় না নেমে ভিটে থেকে ভিটে পেরিয়ে সবখানে খুঁজল। কেউ তাকে দেখে নি। কারো সঙ্গে পালিয়েও যায় নি। কে তাকে সঙ্গে নিয়ে ঝামেলা বাড়াবে। গ্রামের সবচেয়ে সাহসী তরুণরা আগে থেকেই ঘর ছেড়ে পালিয়ে গেছে। কেউ গেছে বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকদের সাথে, কেউ কেউ সীমান্তের দিকে চলে গেছে, বাকি দু'-চার জন যারা ছিল তারাও মিলিটারির খবর পেয়ে যে-যার মত পালিয়ে গেছে।
খুঁজতে খুঁজতে পল্টন দেখল কারো ঘরের দরজা হাট করা অথবা রশি দিয়ে বেড়ার দরজাটা কোনাে মতে বেঁধে দিয়েছে। বুড়ো-বুড়ি বা যারা অাছে তারা ভয়ে কাঁপছে। তাদের একমাত্র ভরসা, বয়সের জন্য হানাদার পাকিস্তানিরা তাদের মাফ করে দেবে—তারা সবাই এক নিঃশ্বাসে পল্টনকে পালাতে বলল। কারাে কথা শুনল না পল্টন । পূর্ব থেকে পশ্চিম, উত্তর ও দক্ষিণ কোনাে বাড়ী বাদ দেয় নি সে। শেষে হতাশ হয়ে গেল বিহারে। বুড়ো অনিন্দ ভান্তে তখন দুপুরের প্রার্থনায় বসেছেন। সামনে গৌতম বুদ্ধের সৌম্য মুর্তি। পল্টন চুপচাপ ভান্তের পেছনে বসে পড়ল। প্রার্থনায় তার মন নেই। একবার ভাবল ডাকবে, কিন্তু পারল না। আবার উসখুসকরে, আবার অস্থির চিত্তে প্রার্থনা জানায় বুদ্ধের কাছে, বঙ্গবন্ধু ও মুন্নি যেন ভালো থাকে।
আবার উঠে দাঁড়ায়, বেরিয়ে উঠোনে গেল, উঠোন থেকে পুকুরের পাড় দিয়ে দূরে পুব দিকটা দেখল। সেদিক থেকেই হানাদার সৈন্যরা আসবে। বিলে ইরি ধনি একটুও কাপছে না, কে জানে শত্রুর ভয়ে নাকি প্রাকৃতিক নিয়মে। ধানখেতের পরই টিলাটিলার ঝোপ-ঝাড়ে শত্রুরা ওৎ পেতে বসে আছে কিনা দেখতে পেল না পল্টন । সে আবার ছুটল ভান্তের কাছে। ভান্তের কথা মতো মুন্নিকে লাল মোহাম্মদের বাড়িতে রেখেছিল প্রথমে। ভান্তে গ্রামের তরুণদের বলেছিলেন, সঙ্কটময় মুহর্তে স্থির থেকে কর্তব্য পালন করবে। মানবসভ্যতার ধ্বংস নিয়ে আসে যুদ্ধ,যুদ্ধ কোনাে সমস্যার স্থায়ী সমাধান দিতে পারে না, কিন্তু অনাদিকাল থেকে মানুষ যুদ্ধ এড়াতে পারে নি, মহামতি অশোকও পারে নি, বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলনও শেষ পর্যন্ত সশস্ত্র সংগ্রামে পরিণত হল।
মানুষ কত কি ভাবে! ফেব্রুয়ারি-মার্চের উত্তাল দিনগুলোতেও মানুষ নিজের হাতে আইন তুলে নেয় নি, সবার এক কথা—জাতীয় সংসদের বৈঠক বসুক, সংসদই সব সমস্যার সমাধান করবে, রাজনীতির প্রক্রিয়ায় সবকিছুর সমাধান করবে রাজনীতিকরা।
প্রার্থনা শেষে উঠলেন অনিন্দ ভান্তে। ঠিক তখনই পুব দিকে গুলির শব্দ শোনা গেল। পল্টনের বুক এক নিমেষে ফাঁকা, দুরু দুরু কাঁপতে শুরু করল। তার মা পালিয়ে গেছে, যাওয়ার আগে দেখাই হল না।
পল্টন ডাকল, ভান্তে।
ভিক্ষু অনিন্দের সৌম্য চেহারায় কালাে ছায়া দেখা দিল। কিছু বলার অাগে তিনি ভেবে নিতে চান সবকিছু। চোখ তুলে তিনি বললেন, তুই পালিয়ে যাস নি? যা, তাড়াতাড়ি লুকিয়ে পড়।
পল্টন বলল, মুন্নিকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না। কেউ তাকে সঙ্গে নিয়ে যায় নি শুনেছি, তাছাড়া আপনাকে না জানিয়ে তো যাওয়ার কথা নয়। অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর তিনি আবার বললেন, তুই তাড়াতাড়ি সরে পড়।
পল্টন বুঝতে পারে মিলিটারির মুখোমুখি হওয়া উচিত হবে না। কিন্তু মুন্নির জন্য মনটা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে, ঠিক তখনই আবার গোলাগুলির শব্দ আকাশ পাড়ি দিতে দিতে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। মাহুতের টিলার দিক থেকে শব্দটা আসছে মনে হয়, কিন্তু একটু পরে সবই পরিষ্কার হয়ে গেল -প্রামে ঢুকে পড়েছে ওরা। পুব পাড়ায়।
আগুন জ্বলছে। গ্রামে ঢুকেই ওরা আগুন দিয়েছে, গাছপালার ওপর দিয়ে ধোঁয়া ও আগুন দেখা যাচ্ছে। তিন লাফে পল্টন বিহারের উঠোন পেরিয়ে গড়ে নামল। উত্তর-পশ্চিম দু’দিকেই গড়, গড়ে বেতের ঝাড়, তারপর সুপুরি ও ছনের বন, সে গড় পেরিয়ে ছন বনে ঢুকে পড়ল। দম নিয়ে শুনতে চেষ্টা করল লোকজনের বা ঘর পোড়ার শব্দ। তার। বদলে শুনল খসখস অাওয়াজ, সে অাওয়াজ অসিছে আশপাশ থেকেই। কান পেতে শুনল, মুন্নি তার নাম ধরে ডাকছে। পল্টনের বুক আবার দুরু দুরু বেজে উঠল। আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল ছনের খোঁচা বাঁচিয়ে, তবুও হাত-পা ছড়ে গেছে, জ্বালা করছে।
মুন্নি মাথা নিচু করে বলল, পালিয়ে যাওয়ার সময় কেউ আমাকে সঙ্গে নিল না।
পল্টন বলল, তোমাকে খোঁজার জন্য... আমি সবার মতো পালিয়ে যাই নি।
রাখো তােমার বদান্যতা। এখন যদি আমি বের হই, তোমাদের শত্রদের কাছে গিয়ে আমার মা-বাবাকে হত্যা ও লুটপাটের কথা বলি তাহলে কি হবে একবার ভেবে দেখেছ? পুরো গ্রামটাই পুড়িয়ে দেবে।
জানি, সব জানি। কিন্তু তোমাকে সঙ্গে নিয়ে গেলেও তাে বিপদ থাকতে পারে। যার সঙ্গে নিয়ে যেতে পারত তারা গেছে যুদ্ধ করতে, ট্র্যানিং নিতে। এখন কে তোমার দায়িত্ব নেবে ঝুকি নিয়ে?
এখন যদি সব বলে দেই?
ওদের লালসার হাত থেকে তুমিও রেহাই পাবে না। তুমি ওদের চেন না।
কথাটা মুন্নি একবারও ভেবে দেখে নি। তার রূপ, যৌবন ও বয়সের কথা গণনায় ধরে নি। ভিক্ষু আনন্দের জন্য সে গ্রামের টাউট ও বদ লোকের হাত থেকে বেঁচে আছে তার হিসাব করে নি। পল্টনের কথায় সে আঁতকে উঠে বলল, তাহলে কি হবে?
ঘর পোড়ার শব্দ তখন হঠাৎ কমে এল। গোলাগুলির শব্দও নেই। নরপশুরা গুলি করবেই বা কাকে, সবাই তো পালিয়ে গেছে। পল্টন প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, বােধ’য় আর আগুন দিচ্ছে না।
অাগুন কে নেভাচ্ছে!
কে জানে। হয়তাে কেউ নয়।
ওরা কয় জন হবে বলতে পারো?
তা হবে বিশ-পঞ্চাশ জন। সঙ্গে কিছু রাজাকারও আছে। তারপর আবার শোনা গেল গুলি ও ঘর পোড়ার শব্দ। মুন্নি চুপ করে রইল। পটন একবার ডাকল, কিন্তু কোনো সাড়া পেল না। মাথা নিচু করে ছনের ডগা ছিড়তে ছিড়তে কাঁদো কাঁদো সে। ওর ভাব দেখে পল্টনের সব ওলােট-পালোট হয়ে গেল। কী বলে সত্বিনা দেবে, কী করবে ভেবে পেল না। মুন্নি মা-বাপকে হারিয়ে নিজের দেহ বাঁচানোর জন্য পালিয়ে বেড়াচ্ছে, অন্ধকার রাতে এই গ্রামে চলে এসেছে। পথ-ঘাট কিছুই জানা ছিল না, কাউকে চেনে না। তবুও এরাতো কয়দিন অশ্রিয় দিয়েছে, এখন না হয় সে-আশ্রয়ও খড়কুটোর মতো উড়ে গেল।
মুন্নি এবার মুখ তুলে বলল, তোমরা আমাকে মেরে ফেলতে পারো না? তাহলে অপদ চুকে যায়।
মুন্নি কথা শুনে কেঁপে উঠল পল্টন, কিন্তু সত্বিনা বা কোনো উত্তর মুখে এল না। যুদ্ধ শুরু হয়েছে এক মাস, শান্তির কোনাে অভিসি নেই। শান্তিরও বা কী দোষ, সে তাে আর উড়ে এসে মেঘের মতো ছায়া মেলে দিতে পারে না, অরি পারে না মেঘের মতো ঝরঝর বৃষ্টি হয়ে ঝরতে। মুন্নিকে সবাই দূরে সরিয়ে দিতে চায়, যুবতী বলে লালসার চোখে দেখে কেউ কেউ। কে আর এই বিপদের দিনে উটকো ঝামেলা কাঁধে নিতে চায়। খান সেনাদের হাতে পড়লে কী হাল হবে শুনেছে, ওর মা-বাবা কারখানার গুণ্ডাদের শিকার হয়েছে, কর্ণফুলীতে ভেসে যাওয়া লাশের মধ্যে তারাও হয়তো ছিল—মুন্নিকে নিয়ে কী করবে ভেবে উঠতে পারল না পল্টনও।
মুন্নি কাদছে। সে আবার বলল, কেউ দেখবে না, কেউ জানবে না , অপদ বিদেয় করাে। মুন্নির মুখে দ্বিতীয়বার মৃত্যুর কথা শুনে পল্টনের মনে সন্দেহ জাগল। সত্যিই তো, কেউ দেখবে না, কেউ জানতেও পারবে না, আর জানলেও সবাই চেপে যাবে না। শত্রুরা গ্রামে ঢুকে পড়েছে, আর লুকিয়ে রাখাও যাবে না। পল্টনকে ভাবতে দেখে মুন্নি আবার বলল, ভয় পাচ্ছি কেন? একটি মানুষ হত্যা করতে পারাে না তো কি পুরুষ হয়েছ? দেশ স্বাধীন করবে কি করে?
পল্টন আবার ধাধায় পড়ল। এভাবে কেউ কোনো দিন চোখে আঙুল দিয়ে কথা বলে নি, এরকম সমস্যায়ও কোনাে দিন পড়ে নি।। হাসান মাষ্টার যদি থাকত, অমর মাস্টার থেকে যদি জিজ্ঞেস করে নিতে পারত--কিন্তু তারাও তাে মুন্নিকে লুকিয়ে রাখতে পারত না। মুন্নির জীবনের নিশ্চয়তা তারাও কি দিতে পারত? তারা কোথায় গেছে কে জানে।
কিছু বলতে না পেরে আমতা আমতা করে চুপ করে রইল পল্টন। রবীন্দ্রনাথের তিন্নি ও দালিয়ার কথা মনে পড়ল। মাত্র গতকাল গল্পটি পড়েছে সে, হাসান মাষ্টার বইটি দিয়েছিল--এত গল্প থাকতে “দালিয়া গল্পের কথাই বা কেন মনে পড়ল বুঝতে পারল না সে।
চুপ করে আছ কেন, তাড়াতাড়ি করো। এভাবে কেউ হত্যা করতে পারে? তুমি পারবে আমাকে মারতে?
তোমার মতো হলে পারতাম। একটি মেয়েকে আশ্রয় দিতে না পারলে বিষ তুলে দিতাম হাতে।
পল্টন আবার চুপ করে গেল, আবার বলল, তোমাকে খুঁজতে খুঁজতে এখানে এসেছি।
খুঁজতে না নিজের জীবন বাঁচাতে। দুই-ই সত্য।
আমাকে বাঁচাতে পারবে?
কী করে রক্ষা করতে পারি সে চেষ্টা করছি। ভান্তেও তোমার জন্য উদ্বিগ্ন।
গুলিগোলার শব্দ থেমে গেল। ঘর পোড়ার শব্দও শোনা যাচ্ছে না। চারদিক থমথমে শব্দহীন। পল্টন সাহস করে ছনের ওপর দিয়ে দেখার চেষ্টা করল। কিন্তু কিছুই দেখার উপায় নেই। পুব দিকটায় ঘন মাদার গাছ, দক্ষিণে বেতের ঝাড়, উত্তর দিকেও। ঝোপঝাড়ে ভরা ও খালের পাড়–কোনােদিকে কিছুই দেখা যায় না, মুন্নিও তেমনি বসে রইল।
পল্টন হতাশ হয়ে বসে পড়ল। শত্রুরী চলে যাচ্ছে হয়তো অথবা গ্রাম তছনছ করছে। ওরা কলেজে ঘাটি করবে। টিলার ওপর। কলেজ, পাশে বড় রাস্তা—সামরিক দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
তারপর বলল, মুন্নি, তুমি একটু অপেক্ষা করাে, দেখি ওরা চলে গেছে কিনা।
মুন্নি সঙ্গে সঙ্গে ওর হাত ধরে বসিয়ে দিল। খবরদার এক পা-ও নড়বে না। ওরা এখনো যায় নি। ওদের চেনো না তুমি, এতক্ষণ পর তোমাকে দেখলে সঙ্গে সঙ্গে গুলি করবে, কতজন মরেছে এতক্ষণ কে জানে।
ওরা আবার চুপচাপ বসে রইল। পল্টনের বুকের মাঝে ঝড়। মুন্নির দিকে তাকাতে পারছে না। ওর ইচ্ছে করছে মুন্নিকে জড়িয়ে ধরে বুকের ভার লাঘব করে। মুন্নি হয়তো ভাবছে, এক গ্রাম লোকের মধ্যে তাকে রক্ষা করার কেউ নেই, কেউ সঙ্গে নিয়ে যেতে সাহস পেল না, মেয়ে বা বউয়ের মর্যাদা দিয়ে ঘরে তুলে নিতে পারল না কেউ। কী মানুষ এরা , এক ফোটা সাহস নেই, প্রতিরোধ করার ক্ষমতা নেই। তারপর শুধু বলল, স্বাধীন হলে দেশ রক্ষা করতে পারবে তাে !
পল্টন সে কথারও কোনাে উত্তর দিতে পারল না। সে বসে বসে মুন্নির হাত ও পায়ের আঙুল গুনছে। মুন্নির সব নখের গোড়ায় এক ফালি সাদা চাদ, খুব ইচ্ছে করছে আঙুল ধরে নাড়াচাড়া করে, কিন্তু হাঁটুর ওপর থুতনি রেখে চুপচাপ বসে রইল। মুন্নি হয়তাে ওর মনের ভাব বুঝতে পেরেছে; অথবা খেলাচ্ছলে পল্টনের বাঁ হাতটা তুলে নিল। পল্টনের হাত শক্ত, রেখা খুব কম ও কর্কশ! মুন্নির নরম হাত যেন নুয়ে পড়বে ভারে।
মুন্নি চোখ না তুলে বলল, আমার জন্য খুব ভাবছ জানি, তবুও তো কয়দিনের জন্য আশ্রয় পেয়েছি তোমাদের গ্রামে, ভান্তেও আমার জন্য খুব উদ্বিগ্ন। যে বিভীষিকা দেখে পালিয়ে এসেছি সে-কথা ভাবতেও হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসে--তারাও তোমাদের মানুষ, লুটপাট করছে ঘরের জিনিসপত্ন, খুন করেছে মা-বাবাকে--বলতে বলতে ঝরঝর কেঁদে দিল। কাঁদতে কাঁদতে বলল, কেন তারা শেখ মুজিবের নির্দেশ মানল না বলোতো?
মুন্নির কথায় পল্টনের চেতনা হল। মুন্নির বাবাকে মেরে নদীতে ফেলে দিয়েছে ? কে জানে কতদিন যুদ্ধ চলে, কতদিন পর আবার ঘরের দাওয়ায় নিশ্চিন্তে ঘুমুতে পারবে, সেসব দিন আবার কবে ফিরে আসবে, কবে আবার বঙ্গবন্ধু ডাক দেবে উদাত্ত কণ্ঠে, কবে আবার শুনব- ভায়েরা আমার... মুন্নি হঠাৎ বলল, সত্যি করে বলো তো তোমরা কেন যুদ্ধ করছ ?
পটন প্রায় চিৎকার করে বলল, আমরা স্বাধীনতা চাই।
কেন তােমরা কি পরাধিন ?
পাকিস্তানিরা অমাদের শত্র, আমরা বাঙালি, ওরা আমাদের শোষণ করেছে এতদিন, আমাদের বঞ্চিত করেছে ন্যায্য পাওনা থেকে।
স্বাধীন হলে অন্য কোনাে দেশ শোষণ করবে। না, পারবে না।
তাহলে নিজের দেশের উঠতি ধনীরা করবে। তুমি যে-গরীব সে গরীবই থাকবে। গরীবের কোনো বন্ধু নেই।
না, পারবে না। সমাজতন্ত্র আসিবে, বঙ্গবন্ধু বলেছে এদেশে কেউ না খেয়ে থাকবে না, শোষিত হবে না। ধর্ম-নিরপেক্ষ রাষ্ট্র হবে এই বাংলাদেশ। মুন্নি আবার বলল, তুমি বৌদ্ধ, তুমি নাস্তিক।
ঐ যে পাকিস্তানি মিলিটারিরাও তো আল্লা বিশ্বাস করে, তারা কেন বিনা দোষে মানুষ মারছে? তোমার বাবাকে যারা খুন করেছে তারাও খোদা বিশ্বাসী।
বাপের কথায় মুন্নি চুপ করে গেল। তার মনে দ্বন্দ্ব লেগে গেল। পল্টনরা যদি নাস্তিক হয় তাকে তো আশ্রয় দিয়েছে, বাঁচাতে চেষ্টা করছে, সে খুঁজতে খুঁজতে এখানে এসেছে। ভিক্ষু আনন্দ তার জন্য অনেক করেছে। তিনিও তাহলে স্রষ্টাকে বিশ্বাস করেন না? মুন্নি আরেক সমস্যায় পড়ল। পল্টন তাকে নির্জনে একা পেয়েও কিছু করছে না। অথচ তার বাবাকে যারা হত্যা করেছে, মাকে যারা ধরে নিয়ে গেছে তারা? তাকেও নিয়ে যেত, শেয়াল-শকুনের মতো ছিড়ে-খুঁড়ে খেত, সবাই তার দিকে লালসার চোখে তাকায় তাই সে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। কী অলৌকিকভাবেই না সে বেঁচে এসেছে। অমনিসে শােকে মুহ্যমান হয়ে পড়ল।
আস্তে আস্তে তার হাত তুলে নিল পটন। এতক্ষণ মুন্নি তার হাত ধরেই ছিল, এবার পল্টন হাত বুলাতে লাগল, মুন্নি অধীর হয়ে পড়ল। পটন তার মাথায় হাত রাখল, হঠাৎ পল্টনও কেঁপে উঠল। মুন্নি এটুকুই চেয়েছিল হয়তো, পল্টনও যেন এই চেয়েছিল, অথবা কে জানে মানুষের মন ও দেহ কখন কী চায়। মানুষের মাঝে কেউ কেউ হাজারাে সমস্যায় ভুবে কাজ করতে পারে, জটিলতা থেকে বেরিয়ে আসার পথও তারা ঠিক পেয়ে যায়। কেউ কেউ সুস্থ-স্বাভাবিক থেকেও কোনাে কাজ সঠিকভাবে শেষ করতে পারে না, অথচ অরেকজন সমস্যার অতলে ডুবেও সমাধান বের করে নিতে পারে। মুন্নি হলেও-বা পল্টন অসচরাচর ধাচের মানুষ নয়। দুর্যোগের আগেই সবাই মুক্তির পথ খুঁজতে থাকে, অার যুদ্ধ-বিগ্রহের মতো দুর্যোগে ভালো-মন্দ-বুদ্ধিমান সব মানুষকে কোনো না কোনােভাবে মূল্য দিতে হয়।
মুন্নিদের সমস্যাই ভিন্ন রকম, তারা বাঙালি নয়, মাথা নত করে সব মেনে নেয়া ছাড়া কোনো উপায়ই নেই। তারপর মুন্নি অস্তে আস্তে নিজের হাতের রুপাের আংটি খুলল, পল্টনকে বলল, আঙটিটা আমাকে পরিয়ে দাও তুমি।
পল্টন ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর মুন্নি বলল, চলো অামরা পালিয়ে যাই। শুনেছি, সবাই পালিয়ে যাচ্ছে সীমান্তের দিকে, আমরাও যাই। সেখানে অামরা জীবন শুরু করব। সেখান থেকে পশ্চিমবঙ্গ হয়ে আমাদের দেশে চলে যেতে পারব। পল্টন বলল, এটাই তো তোমার দেশ।
না, এ-দেশ আমার নয়। যদি আমার হত এ-অবস্থা হত না। অামাদের সবাই বিহারি বলে ঘৃণা করে।
তুমি এদেশী হয়ে যাও। বাঙালি হয়ে যাও। কেন বাঙালি হব? পল্টন আর কথা বাড়াল না। শুধু বলল, আমার মা অাছে।। তোমার মাকে সঙ্গে নাও।
মুন্নি যেন খড়কুটো ধরে হলেও আশ্রয় চায়। বাঁচতে চাইছে। জীবনের অর্থ খুঁজতে খুঁজতে নানা কথা বলছে। কিছুক্ষণ আগেও হত্যার কথা বলেছে, আবার নিজের দেশের কথা বলেছে, আবার পল্টনের হাতে নিজেকে সঁপে দিয়ে বাঁচতে চায়। এ জঙ্গল যদি শত্রুর নাগালের বাইরে হত, কেউ তাদের খুঁজে না পেত—বেঁচে থাকার মধ্যে কী যে মাধুর্য তা মুন্নি অনুভব করতে শুরু করেছে।
তারপর সে পল্টনের হাত তুলে নিল, বুকে জড়িয়ে ধরল, চুমোয় চুমোয় ভরে দিল, তার ইচ্ছে পল্টন তাকে আরাে আদর করুক, সমস্ত শরীর দখল করে নিক, দলিত করুক। তার বুকে ঘন্টার শব্দ, স্তনে রাইফেলের গর্জন, তারপর এক সময় পল্টনের শরীরে নিজের ভার তুলে দিল, নিজের বুকের মধ্যে পল্টনের মুখ চেপে ধরল। মুন্নিকে ছেড়ে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল পল্টন। খোঁজ-খবর নেওয়া দরকার, বিকেল হয়ে আসছে, চারদিক নিঃশন্দ, গাছপালা স্থির। মুন্নি আর বাধা দিল না। বিপদআপদ থেকে মানুষ নিজেকে ঠেকিয়ে রাখতে পারে না। যদি পারত তাহলে নিজের দেশগ্রাম ছেড়ে এই পরবাসে আসতে হত না মুন্নিকে। এক সময় পরবাসকেও নিজ বাসভূমি ভাবতে শুরু করেছিল, স্কুলে পড়তে পড়তে বাংলা ভাষা শিখেছে, কলেজে উঠে ছাত্র রাজনীতিতে যােগ দিয়েছে...এখন সে আবার উদ্বাস্তু।
পল্টনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে উঠতেই আরো বিপর্যয়ের চেহারা দেখতে শুরু করল। এর পরিণতি কি? পল্টনকে ছাড়তেও যন্ত্রণা--সারা শরীরে দুঃখ ও সুখের প্লাবন যুগপৎ আশা যাওয়া করছে।
ছনের জঙ্গল, গড় ও বেতঝাড় পেরিয়ে ভিক্ষু আনন্দের কাছে গেল পল্টন । ভিক্ষু অনিন্দও সবেমাত্র বিহারের উঠোনে পা দিয়েছেন। তার সৌম্য চেহারায় ক্লান্তি ও বিষন্নতার ছায়া, অল্প সময়ের মধ্যেই বার্ধক্য তাঁকে চেপে ধরেছে। ধীর পায়ে তিনি এগিয়ে আসছেন, তাঁর হাতে গান্ধীর রীতিতে আঁকা বুদ্ধের প্রতিকৃতি।
পল্টন হাত জোড় করে প্রশ্ন করল, ভান্তে, ওরা চলে গেছে ?
বিষণ্ণ গলায় তিনি বললেন ঘর পোড়ার কথা, মানুষ হত্যার কাহিনী, অত্যাচারের কথা--তিনি সংক্ষেপে বর্ণনা করলেন। বললেন, আমরা চীনা বৌদ্ধ বলে ওদের থামিয়েছি, বোধ হয় বিশ্বাস করেছে। বুদ্ধের এই ছবি দেখে চিনেছে হয়তো।
শুনতে শুনতে পল্টন শরীরের সব শক্তি যেন হারিয়ে ফেলছে। তবুও কোনো মতে প্রশ্ন করল, কে কে মরল ভান্তে।
বাবুল, জামাল, রশিদ। ওরা চলে গেছে এখন?
হ্যা। তবে আবার যে কোনো সময় অাসতে পারে। শান্তি কমিটি গঠন করতে বলে গেছে। মুক্তিফৌজের খবর দিতে হবে। গ্রামে নতুন কেউ এলে সঙ্গে সঙ্গে ওদের জানাতে হবে। কলেজে ওরা ঘাঁটি গেড়েছে। বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিক খুঁজে বেড়াচ্ছে।
তাহলে এখন কি হবে?
কি আর হবে ?--তারপর পল্টনকে প্রশ্ন করল, মুন্নি সম্পর্কে কি ভাবছ ?
পটনের বুকের ভেতর তোলপাড়। মনে মনে বলল, তাহলে কি তিনি সব জানেন? তারপর বলল, ওকে নিয়ে পালিয়ে যাবার কথা ভাবছি।
কোথায় যাবে ? এখন সোজা রামগড় যাব। কিন্তু পথে পথে মানুষকে কি জবাব দেবে?
সে তখন দেখা যাবে। তাছাড়া ওকে কোথায় লুকিয়ে রাখব? মিলিটারীরা জানতে পারলে পুরো গ্রাম পুড়ে ছাই করে দেবে। তোমার মা কোথায়?
পালিয়ে গেছে সবার সঙ্গে। নিজেকে কিছুতেই সংযত করতে পারছে না সে। হাঁটতে হাঁটতে বিহারের হলঘরে ঢুকে ভিক্ষু অনিন্দকে হাত জোড় করে বলল, ভান্তে, আমি মুন্নিকে বিয়ে করব।
ভিক্ষু অনিন্দ চোখ তুলে তাকালেন। পটন হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে অাছে অনুমতির জন্য। ভিক্ষু চুপচাপ, কী বলবেন, কী উপদেশ দেবেন ভাবছেন তিনি।
ভান্তে, অনুমতি করুন? ওকে নিয়ে আসি বিয়ে করে আজই পালিয়ে যাব, অনুমতি দিন।
অনেকক্ষণ পর ভিক্ষু আনন্দ কথা বললেন, ওর মত আছে? অাছে। এসময় কি বিয়ে করা ঠিক হবে ? অজই আমরা চলে যাব। কেউ জানবে না।
তুমি এমন সিদ্ধান্ত নেবার আগে ভালো করে ভেবে দ্যাখাে। ভেবে দেখেছি।
তুমি অনুমতি চাইলে দিতে হবে। তোমার স্বাধীন মতে আমি বাধা দেব না।
মুন্নির ইচ্ছা আছে। আমারও। ভিক্ষু অনিন্দ এবার বললেন, যাও। ওকে নিয়ে এসো।
সূর্য ডুবতে বসেছে। চারদিক শান্ত, শুধু গ্রামের একটি বাড়ি থেকে গরুর হাম্বা শব্দ শোনা গেল, বিহারের বড় বড় নাগকেশর গাছ থেকে শুকনো ফুল ঝরে পড়ছে, বাঁশ ঝাড় শরশর শব্দ তােলে, বাসায় ফেরা পাখিদের ডাক শোনা যায়, গ্রামখানি শান্ত নির্ভর হয়ে উঠতে চায় যেন, পল্টনের বুকের ভারি পাথরখানা সরতে শুরু করেছে সে অনুমতি পেয়েছে, মুন্নির শরীরের সুখ-স্পর্শ এবার তাকে প্রবলভাবে নাড়া দেয়।
আকাশ গাঢ় নীল। পটনের বুকের ভার অনেক হাল্কা । সে দ্রুত পায়ে গড় ও ঝাড় পেরিয়ে, দু হাতে ছন সরিয়ে মুন্নির কাছে ছুটল। মনে মনে ডাকল, মুন্নি মুন্নি। ওরা দু’জন যেখানে বসেছিল সেখানে মুন্নি নেই। ওরা বসেছিল বলে জায়গাটা পরিপাটি হয়ে অাছে। বুকের শব্দ শুনতে শুনতে পল্টন আস্তে আস্তে ডাকল, মুন্নি।
ভালােবাসায়, বেদনায়, ঐশ্বর্যে বুক উপচে পরছে তার। আবার আদর করে ডাকল, মুন্না, মুন্না।
দু' হাতে ছন সরিয়ে খুঁজতে খুঁজতে মুন্নিকে পেল অবশেষে। মুন্নি শুয়ে আছে। কাছে গিয়ে উপুর হয়ে থুতনিতে হাত দিতেই মুখের অনেকখানি লালা তার হাতে লাগল এবং বুঝতে পারল মুন্নি আর বেঁচে নেই।
আরো নতুন নতুন valobasar Golpo পড়তে ভিজিট করুন
উত্তরমুছুনWWW.VALOBASARGOLPO2.XYZ
এত সুন্দর একটি পোস্ট আমাদেরকে উপহার করার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। ভালোবাসার ছন্দ পড়তে আমদের ওয়েবসাইট ভিজিট করুন।
উত্তরমুছুন