ভোর হতেই পুটলিটা গলির মুখে অবির্জনার স্তুপে পড়ে থাকতে দেখা গেল। প্রতিদিনের মতো ভোরের কাকগুলো রাস্তায় নামল খাবার খুঁজতে। মেথর-ঝাড়দাররা ঝাড়, ঠেলা বালতি নিয়ে কাজে নেমেছে, রোজকার মতো শ্রাবণের ভোর থমথমে মুখ নিয়ে আকাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। গলির ওপারে বড় রাস্তার পাশে মাথা উচু করে বঙ্কিমচন্দ্রের পাগড়ির মতো মস্ত বড় জলের ট্যাঙ্ক চারদিক তাকিয়ে আছে। পত্রিকা নিয়ে হকার তখনো পথে নামে নি। কে একজন প্রাতঃভ্রমণ-বিলাসী ছড়ি হাতে ক্যাবিশের জুতাে পায়ে হনহন করে গলি থেকে বেরিয়ে গেল। মতিঝিলের বড়বড় ইমারতগুলো দিবিজয়ী বীরের মতো বুক টানটান করে মাথা উচিয়ে লুপ্তপ্রায় ঝিল ও আশপাশের বস্তির ওপর নজর দিয়েছে।
তবে মনে রাখবেন পৃথিবীর অনেক কিছুই বা এসব দৃশ্যাবলী সব সময় সুন্দর নয়, শহরের সব দৃশ্যও আবার কৃত্রিম বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
পুঁটলিটা? হ্যা, কাগজের ঐ পুঁটলিটা মতিঝিলের বস্তির কাগজকুড়িয়ে এক ছেলে আবর্জনার ওপর প্রথম দেখতে পায়। দেখেই। মোড়কটি কুড়িয়ে নেয়, তারপর রাজপথ ধরে হাঁটতে থাকে। বেশ সুন্দর ও যত্ন করে বাঁধা। ওপরটা পত্রিকা দিয়ে মােড়া। পত্রিকা খুলে সে বস্তার মধ্যে পুরে নেয়। আবার কাগজ এবং তার ওপর প্লাষ্টিকের রশি দিয়ে বাঁধা। বেঁধেছে সুন্দর করে, প্রতিটি পেঁচ আর গিটের মধ্যে যত্ন লুকিয়ে আছে। পত্রিকার ওপর বিরাট একটা পাখির ছবির আধখানা দেখা যাচ্ছে, ওদিকে মিল্কভিটার গরুর চিন্তিত মুখ। ছেলেটি সুতোর গিট খুলতে খুলতে হাঁটছে। মাঝে মঝে দাড়িয়ে পড়ে, খোলা হলে হাঁটতে থাকে, অবিার দাঁড়ায়, আবার হাঁটে। রাস্তা প্রায় ফাকা, কচিৎ দু-একটা রিক্সা রাস্তা জুড়ে ছুটে যাচ্ছে টেশনের দিকে, নিশ্চয়ই সুন্দরবন মেল বা উল্কা ধরবে। তাছাড়া এত ভোরে রিক্সায় চড়ে কে কোথায় যাবে। রাস্তার কলতলায় ভিখিরি মেয়ে স্নান করছে। ফুটপাতের ওপর তার বোচকা-টলি। তার এক বছরের মেয়েটি ফুটপাতে বসে বসে মায়ের পবিত্র হওয়া দেখছে।
লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আরো দুটি ছোট মেয়ে। দক্ষিণ আকাশে জলভরা মেঘ, তার ছায়ায় শহরের ওপাশটা আচ্ছন্ন হয়ে আছে, সেদিকে বড় রাস্তায় কয়েকটি কৃষ্ণচূড়া দেখা যাচ্ছে, কদম গাছও একটি হবে। ওদিকটা ডি. আই. টি. এভিনিউ -এর পাশে পনের ময়দান, যেখানে একদিন বড় বড় নেতারা ঐতিহাসিক জনসভা করে জনপ্রিয় হয়েছেন এবং একদিন যাদের পায়ের তলায় ফ্যাসিস্ট পাকিস্তানি বাহিনী মাখা নুয়ে দিয়েছিল।
হ্যা জনগণ, জনগণই চুড়ান্ত ক্ষমতার অনন্ত উৎস।
আর হা-ঘরে নেতারা বুঝতে না পেরে নিজেদের ইচ্ছে মতো জনগণকে ব্যবহার করত চায় তার উচিত শিক্ষাও জনগণ দিয়েছে ঐ ময়দানে। ছেলেটি সেই পল্টন ময়দানের দিকে যেতে যেতে হঠাৎ ডানদিকে একটা গলির মুখ পেয়ে ঢুকে পড়ল। ইতিমধ্যে সে হাতের পােটলীর সুতোর বাঁধন খুলছে, পত্রিকাটি বস্তায় পুরল। মোড়কটি তখন ফ্যাকাসে ও খসখসে রঙের মােটা কাগজে মোড়া, তার ওপর টেপ দিয়ে সুন্দর করে। অটিকান। ছেলেটি বাড়ির রকে কেন বসে পড়ল বোঝা গেল না।
এবার সে মায়ামমতা না দেখিয়ে মোটা কাগজটি ছিড়ে ফেলল। তারপর বেরিয়ে এল ওষুধ কোম্পানির চৌকো ছোট্ট বাক্স। ছেলেটি। এবার বিরক্ত হয়ে উঠল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত না দেখে তো আর ফেলা। যায় না। সে ভাবতে লাগল বোধহয়--ভেতরে কি থাকতে পারে? বেশ ভারিই মনে হচ্ছে। খোলার আগে সে ঝুনাে নারকেল নাড়ার মতো বাক্সতা ঝাঁকুনি দিয়ে নেড়ে দেখল, কেমন যেন থলথল করে এপাশ-ওপাশ হল। ধুত্তুরি, কুত্তির বাচ্চাটাচ্চা নয় তো? তবুও কেন যেন মনটা আবার খুশিতে জ্বলজ্বল হয়ে উঠল, কী জানি কী জিনিস আছে ওতে। ভাবতে ভাবতে আরাে মনোযােগী হয়ে উঠল। মনে মনে গলি দিল। আবার ভাবল, ভেতরে যদি তেমন কিছু থাকে। খুশি মনে ওপাশের দোতলা বাড়ির দিকে একবার তাকাল।
ছােট্ট গলি। দু পাশে বাড়ি। বাড়িগুলো উঠেছে খুব বেশিদিন হয় নি। কোথাও নতুন বাড়ি উঠছে। কোনোটা এক তলী, কোনােটা তিনতলা উঠে থেমে গেছে। ছাদের ওপর লোহা ও থাম দেখা যায়, তার পাশে বুকের পাঁজরের মতাে টি ভি-র এনটেনা তো রয়েছে। প্রায় প্রতিটি বাড়ির চৌহদ্দিতে আছে নারকেল পেয়ারা বাগানবিলাস, বেটপ হয়ে ঝুলে আছে ইলেকট্রিকের তারগুলো, অাছে নতুন ওঠা বাড়ির অগ্নিকোণে একটা লম্বা বাঁশের মাথায় মাটি কাটার ভাঙা ঝুড়ি ও ঝাড়। সবকিছুই রাতের বৃষ্টিতে ভিজে ঝলমল অচ্ছিন্নতায় দাঁড়িয়ে আছে অার নেমে আসা মেঘভারনত থমথমে আকাশ।
গলির মোড়ে বাঁ দিকে একটা বড় গাছে ঝাঁক বেঁধে কদম ফুটে আছে। ছেলেটি যদি পুটলিটা নিয়ে মগ্ন না হত তাহলে এতক্ষণ সে নির্ঘাত কদম ফুল তুলত, তারপর কিছুক্ষণ ‘ফুল চাই, কদম ফুল’, ডেকে ডেকে খদ্দের খুঁজত। বস্তির ছেলে সে, এই দশ কি বারো বছর বয়স, অফিসে ভাত নেওয়ার ঠিকে কাজ করে, কাগজ কুড়োয়, কখনাে ফুল বেচে আর সিনেমাও দেখে। শহরের এদিকটা সম্পর্কে তার অাছে নখদর্পণ জ্ঞান। কাগজের বাক্সের ভেতর কি থাকতে পারে ? রাস্তাঘাটে মানুষ নামতে থাকে। লোকজন দেখে ফেলবে তা সে বেমালুম ভুলে যায়। ভেতরে যদি যাচ্ছেতাই আজেবাজে জিনিস থাকে? বােমী-টোমা কিছু? আজকাল আবার যখন তখন বোমাবাজি হচ্ছে শহরে।
অথবা ? ওপাশে যে দোতলা বাড়িটা, বাড়ির জানালার পর্দাটা কেন একটু কেঁপে উঠল? নারকেল গাছের চিকচিক পাতার ফাঁক দিয়ে এক তরুণী চোখ তুলে তাকিয়েছে, তাকিয়ে-তাকিয়ে তাকে দেখছে, তার বুকের ভেতর হাতুড়ির শব্দ হচ্ছে, চিনচিন ব্যথা, বিষন্ন ভার--কিছুই দেখছে না ছেলেটি। আস্তে আস্তে লোক চলাচল বাড়ছে, রোজকার মতো দুধওয়ালা পানি মেশানাে দুধ নিয়ে বাড়ি বাড়ি ছুটছে, নিত্যদিনের মতো মরণচাদের মিষ্টির দোকানে দই-এর ভার নিয়ে ভুড়িওয়ালা লোকটি হেলেদুলে চলেছে। ছেলেটির দিকে আড় চোখে একবার তাকাল সে। বেওয়ারিশ কুকুর ও কাক নেমেছে অবর্জনার স্তুপে, লাইটপোস্ট থেকে এইমাত্র বাতি নিভেছে, পেয়ারা গাছে যে-কটি গুটি পােকা বাস করেছে তারা একটু মেতেছে। গলিটা এইমাত্র ঘুম থেকে উঠে অড়িমােড়া ভাঙল। যেভাবে সে প্রতিদিন ঘুম থেকে জেগে চারদিক চোখ তুলে তাকায়, যেভাবে সকালের কাজে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়, যেভাবে তার সাজবদল হয়—গলিটা সব কিছুই একে একে সেরে নিল।
ছেলেটিও বাজিখেলায় মেতেছে। খেলাটা কিছুই নয়। হয়তো একটা বাচ্চা ছেলে খেলতে খেলতে এমন অকম্মটি করেছে, অথবা বেড়ালের মরা বাচ্চাকে কোনো ছেলে এভাবে মমি করে ফেলে দিয়েছে। যাক গে কাগজগুলো তাে পাওয়া গেল, তাও কম লাভ?
তা কি করে হয়? তবে এবার সত্যি কথাটি বলা যাক। শহরের ঘুম ভাঙার পর মেথর ও বাসার কাজের মেয়েদের মতো গৃহশিক্ষকরাও। বেরিয়ে পড়ে। আমিও ছাত্রী পড়াতে বেরিয়ে এই ঘটনার সঙ্গে ক্ষণিকের জন্য জড়িয়ে পড়লাম—সেটা বর্ণনা করা যায় কিনা দেখা যাক। সবাই গল্পের শেষটা আগে শুনতে চায়, অথবা আমরা সবাই শকুনের মতাে, মানুষের দুর্দশা দেখলে আনন্দ পাই। আচ্ছা আচ্ছা মানলাম, সবাই নয়। কেউ কেউ তো বটেই !
দেখা যাক সাত সকালে ছেলেটি কী করছে। ঘুমের আলসামিটা কাটানর জন্য ছেলেটির দিকে মন দিলাম। ছেলেটি কোনো দিকে তাকাচ্ছে না, ওদিক থেকে একজন অাসছে, ঝি-মেয়েটি দোতলা বাসায় ঢুকল। আমি ছেলেটির কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম আর তক্ষুণি ছেলেটি রঙিন পলিথিনের মোড়কের শেষ গিটটি খুলে সুতোখানা কোলের পাশে রাখল। হাঁ করা মুখর্টি দেখে সবকিছু পরিষ্কার হয়ে গেল, সারা শরীরে শিরশির শীত বয়ে গেল, চোখের ভুরু কুঁচকে গেল—একটি অপূর্ব মানব-শিশু!
ছেলেটি মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগল, একটা ঝাকুনি দিয়ে নেড়ে দিল, একবার যেন শিশুর মুখে হাত রেখে আদর করল, আবার হাত দিয়ে নাভিরুচ্ছু দেখল, দেখল চোখ দুটো চোখ দুটো বোজা, গম্ভীর, বিমর্ষ-ভাব বুঝিমুঠো-করা হাতে যেন অন্য জগতের কিছু একটা ধরে আছে, ফিনফিনে পাতলা চুল, গায়ের রঙ ফ্যাকাশে শাদা, মাথার পেছনটা একটু বড় ও উচু নিচু সবকিছু সে মন দিয়ে দেখে নিল, দেখতে দেখতে তার মুখের ভঙ্গিও পাল্টে গেল, কী এক জান্তব আকর্ষণে তাকিয়ে আছে সে তার কাছে সবকিছু বিস্ময়, এত কাছ থেকে এরকম কিছু সে আগে দেখে নি, তারপর কী একটা অচেনা ও অজানা শিহরণ সারা শরীরে খেলে গেল, হঠাৎ সে চোখ তুলে তাকাল। আমার সঙ্গে চোখাচোখিতে বিদ্যুৎ শিহরণ খেলে গেল।
আর আমি কিছু বুঝে বা না বুঝে কেন যে ছেলেটির কান ধরে চিৎকার করে উঠলাম, যেন সমস্ত অপরাধ ঐ ছেলেটির—এই, রাখ, কোথায় পেয়েছিল বল '''কোথায়?
কথাগুলো সত্যিই কি আমি বলেছিলাম, অথবা খুব একটা ভেবেও বােধ হয় বলি নি! অথবা আদৌ কিছু বলি নি, সবই অমার ভাবনা শুধু। ছেলেটি বসা-অবস্থায় আমাকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দেখল, অথবা ছেলেটি চোখের পলকে হ্রণশিশুটি দলামোচা করে আমার মুখের ওপর ছুড়ে মেরে খিলখিল করে হেসে দৌড় দিল। অামার ফুসফুসের ভেতর দম আটকে গেল, বমি ছুটে এল, মাথা ঘুরে উঠল—ততক্ষণে ছেলেটি গলি থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছে। ততক্ষণে স্থানকাল সম্পর্কে আমার জ্ঞান হল, একজন লোক এসে আমার পাশে দাঁড়াল, আরাে একজন এল, তারপর আরাে একজন। তারপর জল্পনা-কল্পনা, অস্তে অাস্তে ভিড় বেড়ে যাওয়া, নানা জনের নানা উক্তি...। তারপর মেথরেও শিশুটি নিতে চাইবে না, তারপর পুলিশে ডায়েরী করা, টানাপোড়েন, গলির বাড়িতে বাড়িতে অবিবাহিত মেয়েদের সম্পর্কে আন্দাজ অনুমান যুক্তিতর্ক খাড়া করা, ঝি-চাকরানীদের মুখে মুখে পাচার হওয়া কাহিনী...তারপর সবকিছু একদিন শেষ হয়ে যাবে, হ্যা, একদিন ধামাচাপা পড়ে যাবেতবে পাঠকগণ জানেন পৃথিবীটা শুধু এরকম নয়, এরকম ঘটনা হরহামেশা ঘটে না, এই দৃশ্যটিই গলির একমাত্র পরিচয় নয়। আমাকেও দায়ী ভেবে বসবেন না যেন। আমি একেবারে ধোয়া তুলসী পাতা।
এবার ওপাশের দোতলা বাড়ির পর্দার ফাঁকে দাঁড়ান কুমারী মেয়েটির অবস্থা কী হল জানা দরকার। মেয়েটি খুব কষ্টে জানালায় দাঁড়িয়ে অাছে। শ্রাবণের আকাশের মতো ওখানে দাঁড়িয়েছিল। হয়তাে তার অালো-হাওয়া দরকার, অথবা শ্রাবণের আকাশটাই তার দোসর, অথবা এসব তার অভ্যেস...ঝি-গিরির মতো প্রতি ভোরে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছেলেমেয়ে পড়াতে যাওয়া যুবককে দেখতে দাড়িয়েছে, মানুষের কত রকম সখ-অভ্যেস আছে।
মেয়েটি প্রথমে আকাশের চেয়ে বেশি থমথম হয়ে গেল, তারপর নিচের দিকে তাকাতেই তার স্নায়ু এক পায়ে দাঁড়িয়ে এক সঙ্গে বেজে উঠল, তখন ছেলেটি কাগজের পুটলি খুলে ঐ শিশু দেখছে। দেখে মেয়েটির বুক, বুকের ভেতর হৃদপিণ্ড, হৃদপিণ্ডের ভেতর শব্দ, শরীরের লক্ষ লক্ষ জীবকোষ, স্নায়ুতন্ত্র, স্নায়ুর রাজা মস্তিষ্ক, একে একে সকলেই বিদ্রোহী হয়ে উঠল। তার সমস্ত ভালোবাসা ঐ ছোট দুর্বল অপুর্ণ মৃত শিশুটির জন্য...এই ভালোবাসার মাঝেই নিহিত আছে অপরিসীম দুঃখ...কোনো এক লজ্জাকর পরিস্থিতি? অথচ কয়েক ঘন্টা অাগেও ভুণটি কত আপন ছিল। প্রতি ঘটা, প্রতি সেকেণ্ড, প্রতিটি পলঅনুপল একজনের রক্ত থেকে শক্তি নিয়ে বেঁচেছিল, ভালোবাসা ও কষ্ট দিয়েছিল। ছেলেটির এতটুকু দয়ামায়া নেই আর তার পাশে দাঁড়ান যুবক? সে কেন দাড়িয়ে, ছেলেটি অমন করে পালাল কেন? পালাবার আগে যখন থপ করে মাটিতে ফেলল তখন.. তখন মেয়েটির সন্তান ধারণক্ষম গর্ভাশয়টি কে যেন হাত দিয়ে চিরতরে নষ্ট করে দিল...তার কাল্পনিক গর্ভপাতের আশঙ্কা অর্থাৎ তেমন এক নিষ্ঠুর যন্ত্রণার ছায়া তাকে জাপটে ধরল।
সে দাঁত দিয়ে তার নিচের ঠোট কামড়ে ধরল, রক্তের নোনতা স্বাদ পেল এবং অমনি তার সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল। তখন মেয়েটির প্রচণ্ড কামনা জেগে উঠল—একবার শুধু একবার ঐ শিশুকে চুমু খেতে, দু হাতে আগলে ধরে অনুভব করতে, অশেষ ভালোবাসায় কোলে তুলে বুকের বোতাম খুলে দুধ খাওয়াতে, শুধু একবার যদি বুকের ভালোবাসা বিলিয়ে দেওয়া যেত! মেয়েটির বুক সত্যি ভারি হয়ে উঠল। আস্তে আস্তে জানালার শিক ধরা দু হাত শিথিল হয়ে গেল, তারপর আরো আস্তে আস্তে দেয়াল ঘেঁষে মেঝের ওপর মেয়েটি লুটিয়ে পড়ল। তারপর ঘর হাওয়া শহর প্রকৃতি বাল্যপ্রণয় কুমারীজীবন এবং পৃথিবীর যাবতীয় শোক-সঙ্গীত তার বোধে ঝড় তুলল। সে যখন পা ছড়িয়ে চিৎপাত পড়ে গেল, তার মানানসই বুক, তার নিজের ইচ্ছের অপরিণত শিশু, গর্ভের ভেতরকার দস্যিপণা করা ছেলে, তার প্রেমিক... স্বপ্নে স্বপ্নে সারা শরীরে এক মধুর যন্ত্রণাময় আকুতি ছড়িয়ে পড়ল। বুকের গভীরে তিরতির করে দুধের অন্তঃসলিল নিঃসরণ কী তৃপ্তিকর...কী মিষ্টি লঘু নিঃশ্বাস! সেই লঘু নিঃশ্বাস...যা পৃথিবী থেকে আস্তে আস্তে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে, যে লঘু নিঃশ্বাস এক সময় সবার বুক থেকে সুখে।বেরিয়ে তাকে আরো সুখী করে তুলত...আঃ, আহা! আর আমি? আমার কথা এখন থাক। ক্ষমা করুন, ক্ষমা করবেন।
তবে মনে রাখবেন পৃথিবীর অনেক কিছুই বা এসব দৃশ্যাবলী সব সময় সুন্দর নয়, শহরের সব দৃশ্যও আবার কৃত্রিম বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
পুঁটলিটা? হ্যা, কাগজের ঐ পুঁটলিটা মতিঝিলের বস্তির কাগজকুড়িয়ে এক ছেলে আবর্জনার ওপর প্রথম দেখতে পায়। দেখেই। মোড়কটি কুড়িয়ে নেয়, তারপর রাজপথ ধরে হাঁটতে থাকে। বেশ সুন্দর ও যত্ন করে বাঁধা। ওপরটা পত্রিকা দিয়ে মােড়া। পত্রিকা খুলে সে বস্তার মধ্যে পুরে নেয়। আবার কাগজ এবং তার ওপর প্লাষ্টিকের রশি দিয়ে বাঁধা। বেঁধেছে সুন্দর করে, প্রতিটি পেঁচ আর গিটের মধ্যে যত্ন লুকিয়ে আছে। পত্রিকার ওপর বিরাট একটা পাখির ছবির আধখানা দেখা যাচ্ছে, ওদিকে মিল্কভিটার গরুর চিন্তিত মুখ। ছেলেটি সুতোর গিট খুলতে খুলতে হাঁটছে। মাঝে মঝে দাড়িয়ে পড়ে, খোলা হলে হাঁটতে থাকে, অবিার দাঁড়ায়, আবার হাঁটে। রাস্তা প্রায় ফাকা, কচিৎ দু-একটা রিক্সা রাস্তা জুড়ে ছুটে যাচ্ছে টেশনের দিকে, নিশ্চয়ই সুন্দরবন মেল বা উল্কা ধরবে। তাছাড়া এত ভোরে রিক্সায় চড়ে কে কোথায় যাবে। রাস্তার কলতলায় ভিখিরি মেয়ে স্নান করছে। ফুটপাতের ওপর তার বোচকা-টলি। তার এক বছরের মেয়েটি ফুটপাতে বসে বসে মায়ের পবিত্র হওয়া দেখছে।
লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আরো দুটি ছোট মেয়ে। দক্ষিণ আকাশে জলভরা মেঘ, তার ছায়ায় শহরের ওপাশটা আচ্ছন্ন হয়ে আছে, সেদিকে বড় রাস্তায় কয়েকটি কৃষ্ণচূড়া দেখা যাচ্ছে, কদম গাছও একটি হবে। ওদিকটা ডি. আই. টি. এভিনিউ -এর পাশে পনের ময়দান, যেখানে একদিন বড় বড় নেতারা ঐতিহাসিক জনসভা করে জনপ্রিয় হয়েছেন এবং একদিন যাদের পায়ের তলায় ফ্যাসিস্ট পাকিস্তানি বাহিনী মাখা নুয়ে দিয়েছিল।
হ্যা জনগণ, জনগণই চুড়ান্ত ক্ষমতার অনন্ত উৎস।
আর হা-ঘরে নেতারা বুঝতে না পেরে নিজেদের ইচ্ছে মতো জনগণকে ব্যবহার করত চায় তার উচিত শিক্ষাও জনগণ দিয়েছে ঐ ময়দানে। ছেলেটি সেই পল্টন ময়দানের দিকে যেতে যেতে হঠাৎ ডানদিকে একটা গলির মুখ পেয়ে ঢুকে পড়ল। ইতিমধ্যে সে হাতের পােটলীর সুতোর বাঁধন খুলছে, পত্রিকাটি বস্তায় পুরল। মোড়কটি তখন ফ্যাকাসে ও খসখসে রঙের মােটা কাগজে মোড়া, তার ওপর টেপ দিয়ে সুন্দর করে। অটিকান। ছেলেটি বাড়ির রকে কেন বসে পড়ল বোঝা গেল না।
এবার সে মায়ামমতা না দেখিয়ে মোটা কাগজটি ছিড়ে ফেলল। তারপর বেরিয়ে এল ওষুধ কোম্পানির চৌকো ছোট্ট বাক্স। ছেলেটি। এবার বিরক্ত হয়ে উঠল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত না দেখে তো আর ফেলা। যায় না। সে ভাবতে লাগল বোধহয়--ভেতরে কি থাকতে পারে? বেশ ভারিই মনে হচ্ছে। খোলার আগে সে ঝুনাে নারকেল নাড়ার মতো বাক্সতা ঝাঁকুনি দিয়ে নেড়ে দেখল, কেমন যেন থলথল করে এপাশ-ওপাশ হল। ধুত্তুরি, কুত্তির বাচ্চাটাচ্চা নয় তো? তবুও কেন যেন মনটা আবার খুশিতে জ্বলজ্বল হয়ে উঠল, কী জানি কী জিনিস আছে ওতে। ভাবতে ভাবতে আরাে মনোযােগী হয়ে উঠল। মনে মনে গলি দিল। আবার ভাবল, ভেতরে যদি তেমন কিছু থাকে। খুশি মনে ওপাশের দোতলা বাড়ির দিকে একবার তাকাল।
ছােট্ট গলি। দু পাশে বাড়ি। বাড়িগুলো উঠেছে খুব বেশিদিন হয় নি। কোথাও নতুন বাড়ি উঠছে। কোনোটা এক তলী, কোনােটা তিনতলা উঠে থেমে গেছে। ছাদের ওপর লোহা ও থাম দেখা যায়, তার পাশে বুকের পাঁজরের মতাে টি ভি-র এনটেনা তো রয়েছে। প্রায় প্রতিটি বাড়ির চৌহদ্দিতে আছে নারকেল পেয়ারা বাগানবিলাস, বেটপ হয়ে ঝুলে আছে ইলেকট্রিকের তারগুলো, অাছে নতুন ওঠা বাড়ির অগ্নিকোণে একটা লম্বা বাঁশের মাথায় মাটি কাটার ভাঙা ঝুড়ি ও ঝাড়। সবকিছুই রাতের বৃষ্টিতে ভিজে ঝলমল অচ্ছিন্নতায় দাঁড়িয়ে আছে অার নেমে আসা মেঘভারনত থমথমে আকাশ।
গলির মোড়ে বাঁ দিকে একটা বড় গাছে ঝাঁক বেঁধে কদম ফুটে আছে। ছেলেটি যদি পুটলিটা নিয়ে মগ্ন না হত তাহলে এতক্ষণ সে নির্ঘাত কদম ফুল তুলত, তারপর কিছুক্ষণ ‘ফুল চাই, কদম ফুল’, ডেকে ডেকে খদ্দের খুঁজত। বস্তির ছেলে সে, এই দশ কি বারো বছর বয়স, অফিসে ভাত নেওয়ার ঠিকে কাজ করে, কাগজ কুড়োয়, কখনাে ফুল বেচে আর সিনেমাও দেখে। শহরের এদিকটা সম্পর্কে তার অাছে নখদর্পণ জ্ঞান। কাগজের বাক্সের ভেতর কি থাকতে পারে ? রাস্তাঘাটে মানুষ নামতে থাকে। লোকজন দেখে ফেলবে তা সে বেমালুম ভুলে যায়। ভেতরে যদি যাচ্ছেতাই আজেবাজে জিনিস থাকে? বােমী-টোমা কিছু? আজকাল আবার যখন তখন বোমাবাজি হচ্ছে শহরে।
অথবা ? ওপাশে যে দোতলা বাড়িটা, বাড়ির জানালার পর্দাটা কেন একটু কেঁপে উঠল? নারকেল গাছের চিকচিক পাতার ফাঁক দিয়ে এক তরুণী চোখ তুলে তাকিয়েছে, তাকিয়ে-তাকিয়ে তাকে দেখছে, তার বুকের ভেতর হাতুড়ির শব্দ হচ্ছে, চিনচিন ব্যথা, বিষন্ন ভার--কিছুই দেখছে না ছেলেটি। আস্তে আস্তে লোক চলাচল বাড়ছে, রোজকার মতো দুধওয়ালা পানি মেশানাে দুধ নিয়ে বাড়ি বাড়ি ছুটছে, নিত্যদিনের মতো মরণচাদের মিষ্টির দোকানে দই-এর ভার নিয়ে ভুড়িওয়ালা লোকটি হেলেদুলে চলেছে। ছেলেটির দিকে আড় চোখে একবার তাকাল সে। বেওয়ারিশ কুকুর ও কাক নেমেছে অবর্জনার স্তুপে, লাইটপোস্ট থেকে এইমাত্র বাতি নিভেছে, পেয়ারা গাছে যে-কটি গুটি পােকা বাস করেছে তারা একটু মেতেছে। গলিটা এইমাত্র ঘুম থেকে উঠে অড়িমােড়া ভাঙল। যেভাবে সে প্রতিদিন ঘুম থেকে জেগে চারদিক চোখ তুলে তাকায়, যেভাবে সকালের কাজে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়, যেভাবে তার সাজবদল হয়—গলিটা সব কিছুই একে একে সেরে নিল।
ছেলেটিও বাজিখেলায় মেতেছে। খেলাটা কিছুই নয়। হয়তো একটা বাচ্চা ছেলে খেলতে খেলতে এমন অকম্মটি করেছে, অথবা বেড়ালের মরা বাচ্চাকে কোনো ছেলে এভাবে মমি করে ফেলে দিয়েছে। যাক গে কাগজগুলো তাে পাওয়া গেল, তাও কম লাভ?
তা কি করে হয়? তবে এবার সত্যি কথাটি বলা যাক। শহরের ঘুম ভাঙার পর মেথর ও বাসার কাজের মেয়েদের মতো গৃহশিক্ষকরাও। বেরিয়ে পড়ে। আমিও ছাত্রী পড়াতে বেরিয়ে এই ঘটনার সঙ্গে ক্ষণিকের জন্য জড়িয়ে পড়লাম—সেটা বর্ণনা করা যায় কিনা দেখা যাক। সবাই গল্পের শেষটা আগে শুনতে চায়, অথবা আমরা সবাই শকুনের মতাে, মানুষের দুর্দশা দেখলে আনন্দ পাই। আচ্ছা আচ্ছা মানলাম, সবাই নয়। কেউ কেউ তো বটেই !
দেখা যাক সাত সকালে ছেলেটি কী করছে। ঘুমের আলসামিটা কাটানর জন্য ছেলেটির দিকে মন দিলাম। ছেলেটি কোনো দিকে তাকাচ্ছে না, ওদিক থেকে একজন অাসছে, ঝি-মেয়েটি দোতলা বাসায় ঢুকল। আমি ছেলেটির কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম আর তক্ষুণি ছেলেটি রঙিন পলিথিনের মোড়কের শেষ গিটটি খুলে সুতোখানা কোলের পাশে রাখল। হাঁ করা মুখর্টি দেখে সবকিছু পরিষ্কার হয়ে গেল, সারা শরীরে শিরশির শীত বয়ে গেল, চোখের ভুরু কুঁচকে গেল—একটি অপূর্ব মানব-শিশু!
ছেলেটি মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগল, একটা ঝাকুনি দিয়ে নেড়ে দিল, একবার যেন শিশুর মুখে হাত রেখে আদর করল, আবার হাত দিয়ে নাভিরুচ্ছু দেখল, দেখল চোখ দুটো চোখ দুটো বোজা, গম্ভীর, বিমর্ষ-ভাব বুঝিমুঠো-করা হাতে যেন অন্য জগতের কিছু একটা ধরে আছে, ফিনফিনে পাতলা চুল, গায়ের রঙ ফ্যাকাশে শাদা, মাথার পেছনটা একটু বড় ও উচু নিচু সবকিছু সে মন দিয়ে দেখে নিল, দেখতে দেখতে তার মুখের ভঙ্গিও পাল্টে গেল, কী এক জান্তব আকর্ষণে তাকিয়ে আছে সে তার কাছে সবকিছু বিস্ময়, এত কাছ থেকে এরকম কিছু সে আগে দেখে নি, তারপর কী একটা অচেনা ও অজানা শিহরণ সারা শরীরে খেলে গেল, হঠাৎ সে চোখ তুলে তাকাল। আমার সঙ্গে চোখাচোখিতে বিদ্যুৎ শিহরণ খেলে গেল।
আর আমি কিছু বুঝে বা না বুঝে কেন যে ছেলেটির কান ধরে চিৎকার করে উঠলাম, যেন সমস্ত অপরাধ ঐ ছেলেটির—এই, রাখ, কোথায় পেয়েছিল বল '''কোথায়?
কথাগুলো সত্যিই কি আমি বলেছিলাম, অথবা খুব একটা ভেবেও বােধ হয় বলি নি! অথবা আদৌ কিছু বলি নি, সবই অমার ভাবনা শুধু। ছেলেটি বসা-অবস্থায় আমাকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দেখল, অথবা ছেলেটি চোখের পলকে হ্রণশিশুটি দলামোচা করে আমার মুখের ওপর ছুড়ে মেরে খিলখিল করে হেসে দৌড় দিল। অামার ফুসফুসের ভেতর দম আটকে গেল, বমি ছুটে এল, মাথা ঘুরে উঠল—ততক্ষণে ছেলেটি গলি থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছে। ততক্ষণে স্থানকাল সম্পর্কে আমার জ্ঞান হল, একজন লোক এসে আমার পাশে দাঁড়াল, আরাে একজন এল, তারপর আরাে একজন। তারপর জল্পনা-কল্পনা, অস্তে অাস্তে ভিড় বেড়ে যাওয়া, নানা জনের নানা উক্তি...। তারপর মেথরেও শিশুটি নিতে চাইবে না, তারপর পুলিশে ডায়েরী করা, টানাপোড়েন, গলির বাড়িতে বাড়িতে অবিবাহিত মেয়েদের সম্পর্কে আন্দাজ অনুমান যুক্তিতর্ক খাড়া করা, ঝি-চাকরানীদের মুখে মুখে পাচার হওয়া কাহিনী...তারপর সবকিছু একদিন শেষ হয়ে যাবে, হ্যা, একদিন ধামাচাপা পড়ে যাবেতবে পাঠকগণ জানেন পৃথিবীটা শুধু এরকম নয়, এরকম ঘটনা হরহামেশা ঘটে না, এই দৃশ্যটিই গলির একমাত্র পরিচয় নয়। আমাকেও দায়ী ভেবে বসবেন না যেন। আমি একেবারে ধোয়া তুলসী পাতা।
এবার ওপাশের দোতলা বাড়ির পর্দার ফাঁকে দাঁড়ান কুমারী মেয়েটির অবস্থা কী হল জানা দরকার। মেয়েটি খুব কষ্টে জানালায় দাঁড়িয়ে অাছে। শ্রাবণের আকাশের মতো ওখানে দাঁড়িয়েছিল। হয়তাে তার অালো-হাওয়া দরকার, অথবা শ্রাবণের আকাশটাই তার দোসর, অথবা এসব তার অভ্যেস...ঝি-গিরির মতো প্রতি ভোরে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছেলেমেয়ে পড়াতে যাওয়া যুবককে দেখতে দাড়িয়েছে, মানুষের কত রকম সখ-অভ্যেস আছে।
মেয়েটি প্রথমে আকাশের চেয়ে বেশি থমথম হয়ে গেল, তারপর নিচের দিকে তাকাতেই তার স্নায়ু এক পায়ে দাঁড়িয়ে এক সঙ্গে বেজে উঠল, তখন ছেলেটি কাগজের পুটলি খুলে ঐ শিশু দেখছে। দেখে মেয়েটির বুক, বুকের ভেতর হৃদপিণ্ড, হৃদপিণ্ডের ভেতর শব্দ, শরীরের লক্ষ লক্ষ জীবকোষ, স্নায়ুতন্ত্র, স্নায়ুর রাজা মস্তিষ্ক, একে একে সকলেই বিদ্রোহী হয়ে উঠল। তার সমস্ত ভালোবাসা ঐ ছোট দুর্বল অপুর্ণ মৃত শিশুটির জন্য...এই ভালোবাসার মাঝেই নিহিত আছে অপরিসীম দুঃখ...কোনো এক লজ্জাকর পরিস্থিতি? অথচ কয়েক ঘন্টা অাগেও ভুণটি কত আপন ছিল। প্রতি ঘটা, প্রতি সেকেণ্ড, প্রতিটি পলঅনুপল একজনের রক্ত থেকে শক্তি নিয়ে বেঁচেছিল, ভালোবাসা ও কষ্ট দিয়েছিল। ছেলেটির এতটুকু দয়ামায়া নেই আর তার পাশে দাঁড়ান যুবক? সে কেন দাড়িয়ে, ছেলেটি অমন করে পালাল কেন? পালাবার আগে যখন থপ করে মাটিতে ফেলল তখন.. তখন মেয়েটির সন্তান ধারণক্ষম গর্ভাশয়টি কে যেন হাত দিয়ে চিরতরে নষ্ট করে দিল...তার কাল্পনিক গর্ভপাতের আশঙ্কা অর্থাৎ তেমন এক নিষ্ঠুর যন্ত্রণার ছায়া তাকে জাপটে ধরল।
সে দাঁত দিয়ে তার নিচের ঠোট কামড়ে ধরল, রক্তের নোনতা স্বাদ পেল এবং অমনি তার সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল। তখন মেয়েটির প্রচণ্ড কামনা জেগে উঠল—একবার শুধু একবার ঐ শিশুকে চুমু খেতে, দু হাতে আগলে ধরে অনুভব করতে, অশেষ ভালোবাসায় কোলে তুলে বুকের বোতাম খুলে দুধ খাওয়াতে, শুধু একবার যদি বুকের ভালোবাসা বিলিয়ে দেওয়া যেত! মেয়েটির বুক সত্যি ভারি হয়ে উঠল। আস্তে আস্তে জানালার শিক ধরা দু হাত শিথিল হয়ে গেল, তারপর আরো আস্তে আস্তে দেয়াল ঘেঁষে মেঝের ওপর মেয়েটি লুটিয়ে পড়ল। তারপর ঘর হাওয়া শহর প্রকৃতি বাল্যপ্রণয় কুমারীজীবন এবং পৃথিবীর যাবতীয় শোক-সঙ্গীত তার বোধে ঝড় তুলল। সে যখন পা ছড়িয়ে চিৎপাত পড়ে গেল, তার মানানসই বুক, তার নিজের ইচ্ছের অপরিণত শিশু, গর্ভের ভেতরকার দস্যিপণা করা ছেলে, তার প্রেমিক... স্বপ্নে স্বপ্নে সারা শরীরে এক মধুর যন্ত্রণাময় আকুতি ছড়িয়ে পড়ল। বুকের গভীরে তিরতির করে দুধের অন্তঃসলিল নিঃসরণ কী তৃপ্তিকর...কী মিষ্টি লঘু নিঃশ্বাস! সেই লঘু নিঃশ্বাস...যা পৃথিবী থেকে আস্তে আস্তে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে, যে লঘু নিঃশ্বাস এক সময় সবার বুক থেকে সুখে।বেরিয়ে তাকে আরো সুখী করে তুলত...আঃ, আহা! আর আমি? আমার কথা এখন থাক। ক্ষমা করুন, ক্ষমা করবেন।
আরো নতুন নতুন valobasar Golpo পড়তে ভিজিট করুন
উত্তরমুছুনWWW.VALOBASARGOLPO2.XYZ
valo laglo. post korte thakun. vromon, golpo, kobita, technology and health related post porte tripretreatBD blog visit korun. valo lagle share korun.
উত্তরমুছুন