২০০০ সাল। অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি এসেছি। বন্ধুদের সঙ্গে মাতাল সময় কাটিয়ে যাই যাই করেও কেন জানি যাওয়া হচ্ছে না। এমন সময় এলাকার কিছু ছোট ভাই এক বন্ধুর মাধ্যমে জানালাতে , বানিয়াশান্তায় (পতিতা পল্লী) একটা নতুন মেয়েকে এনে জোর করে দেহ ব্যবসায় বাধ্য করেছে। মেয়েটির নাম সাথী। বাড়ি নারায়ণগঞ্জ।
সম্মায়ের বােন তাকে খুলনায় বেড়ানোর কথা বলে এখানে বিক্রি করে গেছে। মেয়েটি নবম শ্রেণীতে পড়ে। আরো শুনলাম, দেহ ব্যবসায় রাজি না হওয়াতে প্রথমে লাঠি দিয়ে মেরেছে।পরে নখের মধ্যে কাটা ঢুকিয়েও তাকে বাধ্য করতে পারেনি। অবশেষে তাকে না খাইয়ে রাখা হয়। দুইদিন খেয়ে থাকার পরে সে ক্ষিধের কাছে নতি স্বীকার করে।
বানিয়াশান্তায় এখন তার একচেটিয়া বাজার। খদ্দেররা নাকি লাইনে দাড়িয়ে থাকে তাকে একবার চোখে দেখার জন্য। আমার এক মাসের ছোট চাচাতো ভাই আতাউর রহমান আতা নদীতে বােট চালায়। সে প্রায়ই বানিয়াশান্তায় যায় প্যাসেঞ্জার নিয়ে। আতা মেয়েটিকে দেখেছে এবং তার এক বন্ধু মেয়েটির কাছে গিয়েছিল। মেয়েটি ছেলেটিকে ভাই ডেকে সেখান থেকে উদ্ধারের জন্য ছেলেটির পা ধরে কেদেছে। আরো বলেছে, সে নাকি অনেক লোককে উদ্ধারের জন্য মিনতি করলেও আজ পর্যন্ত কেউ এগিয়ে আসেনি।
মেয়েটির কান্না দেখে সে কথা দিয়ে এসেছে তাকে উদ্ধারের একটা চেষ্টা সে করবে। পতিতা পল্লী সম্পর্কে যাদের ধারণা আছে তারা জানে প্রতিটা পল্লী মাস্তান এবং পুলিশ দ্বারা কিভাবে আচ্ছাদিত থাকে। পুলিশ এখানে আইনের প্রয়োগ না করে ক্ষমতা ব্যবহার করে দালাল ও ভেড় য়া বনে যায়। তারা ভালো করেই জানে কিভাবে একটা মেয়েকে পতিতা বানাতে হয়। বলা বাহুল্য, প্রতিটি নতুন মেয়েকে প্রথমে ভাড় যা তারপর যথাক্রমে পুলিশ ও সাংবাদিক ভাগ করে। চাইলেই কেউ সেখান থেকে কোনো মেয়েকে উদ্ধার করতে পারে না। আর তাই ছেলেটি আমাদের শরণাপন্ন হয়েছে।
আমরা কোনো বড় মাস্তান বা ক্ষমতাধারী নই, নিতান্তই সাধারণ। তবে আমি ও আমার বন্ধুরা মনে করি কবি শুধু কলম ধরে সমাজ সংস্কার করবে না প্রয়োজনে ছুরি-বন্দুকও ধরবে।
তাই কি মাস্তান কি ক্ষমতাবান, সবাই আমাদের কেমন যেন দৃষ্টিতে দেখে। এই কিছুটা টক মিষ্টি ঝাল টাইপ দৃষ্টি আর কি। ছোট ভাইদের কথায় কোনো ঝুঁকি নেয়া ঠিক হবে না ভেবে আমরা আলােচনায় বসলাম। বানিয়াশান্তায় যাওয়ার আগে বন্ধুরা আমাকে বললাে, আবিদ, ভালো করে ভেবে দেখ। এতো বড় রিস্ক নিবি কি না।
যদি পুলিশের কাছে ধরা পড়ি তারা হাজতে পুরবে। সঙ্গে মাস্তানদের নির্যাতন। তাছাড়া সবাই জানবে আমরা সত্যিই খারাপ। শুধু ভদ্রতার ভান করি। নারী সম্ভোগে এসে ঝামেলা বাধিয়ে এখন থানা হাজতে আছি। তাছাড়া মেয়েটিকে এনেই বা কি করবা? মেয়েটি যদি স্বজনদের কাছে ফিরে যেতে না চায়? আমি বললাম, মেয়েটিকে তিনটি শর্ত দেবাে। যদি সে শর্তগুলাে মানে তবেই তার জন্য রিস্ক নেবাে।
প্রথম শর্ত সে বাড়ি যেতে চাইলে তাকে বাড়ি পাঠিয়ে দেবাে কিন্তু বাড়ির পরিস্থিতি যা-ই হােক আমরা আর কোনো দায়িত্ব নেবাে না। দ্বিতীয় শর্ত সে বাড়ি যেতে না চাইলে তাকে এখান থেকে লেখাপড়া করতে হবে। এ ব্যাপারে আমার মিশনারিজ স্কুলের এক শিক্ষকের সঙ্গে কথা হয়েছে। তিনি বলেছেন, মেয়েটিকে স্কুল হস্টেলে রেখে লেখাপড়ার সব ব্যবস্থা তিনি করবেন। তৃতীয় শর্ত হলাে সে যাকে ইচ্ছে তাকে বিয়ে করতে পারবে।
তবে সে যাকে বিয়ে করতে চাইবে সেই ছেলেরও তাকে বিয়ে করার মানসিকতা থাকতে হবে। তা না হলে অবশ্যই তাকে বাড়ি যেতে হবে। মেয়েটি সম্পর্কে পরিকল্পনা স্থির করে আমরা তিন বন্ধু মিলে বানিয়াশান্তায় গেলাম। সামান্য পরিচিতি ও বড়দের স্নেহধন্য হওয়ায় এসব এলাকা যে কতােটা বিব্রতকর তা স্থানীয় ছেলেরা জানে। আতার বােটে করে খুব গােপনে মেয়েটি যে বাড়ি থাকে সেই বাড়ির সামনে নেমে দ্রুত চলে গেলাম বাড়ির পেছনে। সেখানে একটা বসার ঘরে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর মেয়েটি এলাে। মেয়েটিকে দেখে বুঝলাম কেন মানুষ লাইন ধরে দাড়িয়ে থাকে তাকে ভােগের আশায়।
হরিণের মাংসই যে হরিণের শত্রু! এই মাত্র সে একজনকে সঙ্গ দিয়ে আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। পতিতালয়ের সাবলীলতা এখনাে তাকে গ্রাস করতে পারেনি। সে কিছুটা জড়ােসড়াে। শহীদ খদ্দের সেজে তার রুমে গিয়ে বুঝিয়ে এলাে কিভাবে তাকে এখান থেকে নিয়ে যাবাে এবং শর্তগুলাের ব্যাপারে বিশেষভাবে সতর্ক করা হলাে।
সাথী ভেবেছিল আজই তাকে নিয়ে যাবাে। যখন শুনলাে আজকে আমরা এসেছি শুধু পরিস্থিতি ও রাতের বেলা কোন রাস্তা দিয়ে বের হবাে তা পর্যবেক্ষণ করতে, তখন সে কিছুটা বিষন্ন হয়ে গেল। ফিরে আসার পথে বলে এলাম, সাথী, এতো দিন যখন সহ্য করেছে আর এক দুইদিন একটু সহ্য করাে। তােমাকে আমরা পরশু রাতে নিয়ে যাবাে।
সে আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে শুধু বললাে, আমার কেবলি মনে হতাে কেউ আমাকে উদ্ধার করবেই। এতো কষ্টের পরও বাচতে বড় সাধ জাগে। বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে আমার জীবন বিবর্ণ হলেও পৃথিবীটা তাে বিবর্ণ নয়। আমি কি তার একটুও রঙ নিয়ে আবার বাচতে পারবাে না? শরীর থেকেও মৃত্যুকে ভয় পাই নাকি জীবনকে ভালো বাসি জানি না।
বেচে থাকতে মূল্য দিচ্ছি শরীর দিয়ে। আল্লাহর প্রতি অভিযােগ নেই। বৈচিত্রকে সমুন্নত রাখতে তিনি সচেষ্ট। তবে আমারও একটা সহ্যসীমা আছে। ধরুন আগামী পরশু অর্থাৎ বৃহস্পতিবারই হবে আমার শেষ দিন। আপনারা এলে বেচে থাকার জন্য শেষ লােভটুকু করবাে। তা না হলে শুক্রবার দিনটা তাে শুভ রইলােই। আর কোনো কথা না বলে অপেক্ষারত এক কাস্টমারকে হাতের ইশারায় ডেকে ঘরে দুয়ার দিল। বৃহস্পতিবার প্ল্যান করা হলাে আমি খদ্দের সেজে সারা রাতের জন্য সাথীকে বুক করবাে। আর রাতের যে কোনো এক সময় সুযােগ বুঝে বন্ধুরা সাথীর রুমের তালা ভেঙে আমাদের মুক্ত করবে।
রাতের বেলা প্রতিটি রুমের বাইরে থেকে তালা বন্ধ করে রাখা হয়। চাপা উত্তেজনা ও অস্বস্তি নিয়ে শেষ বিকেলে আতার বােটে নদী পার হয়ে এলাম বানিয়াশান্তায়। সঙ্গে ছয় বন্ধু কিছু লাঠি ও কয়েকটি রামদা নিলাম। সবাইকে বােটে রেখে আমি আর জামাল খদ্দের সেজে সাথী যে বাড়ি থাকে সেই মাসির কাছে গেলাম। দেখি মাসির পাশেই সাথী উদ্বিগ্ন অবস্থায় বসে আছে। আমাকে। দেখেই যেন প্রশান্তিতে ভরে গেল সে। দরদাম ঠিক করে সাথীকে নিয়ে যখন রুমে গেলাম তখন জামাল অন্য মেয়ের কাছে যাবার অজুহাতে পরিস্থিতি নিরূপণ করতে চলে গেল। সাথীকে নিয়ে যখন রুমে ঢুকলাম তখন রাত প্রায় নয়টা।
রুমে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে সাথী আলতাে করে আমায় জড়িয়ে ধরে বললাে, সারাটি দিন যে কতাে শংকার মাঝে কেটেছে তা বলতে পারবাে না। শুধু মনে হচ্ছিল তুমি আসবে না। অথবা তুমি আসার আগেই অন্য কেউ আমাকে সারা রাতের জন্য নির্বাচন করবে। বলতে বলতে কেদে ফেললাে সে। একটা ওড়না দেখিয়ে বললাে, কাল ভােরে ওই ওড়নাটা গলায় পেচিয়ে ঝুলে পড়তাম। তার মাথায় আলতাে করে হাত বুলিয়ে বললাম, শান্ত হও। এসেই যখন পড়েছি তখন এখান থেকে তােমাকে নিয়ে যাবােই।
তার আগে আমাদের শর্তগুলাে তােমাকে আর একবার মনে করিয়ে দিতে চাই। আমার সব শর্ত মনে আছে। গত পরশু থেকে তােমাদের কথা যতাে ভেবেছি ততােই আমি খেই হারিয়ে ফেলেছি। কেন? এই কয়েকদিনের বাস্তবতায় মানুষের প্রতি বিশ্বাস আমার শেষ হয়ে গিয়েছিল। যখন দেখলাম শুধু আমাকে উদ্ধার করার জন্য মান-সম্মান বাজি রেখে বানিয়াশান্তায় প্রথম এলে তখন আমি দিশেহারা হয়ে গেলাম।। তােমাকে কে বললাে যে আমি ওই দিনই এখানে প্রথম এসেছি। তােমার চাচাতো ভাই আতা কাল এখানে অনেকক্ষণ আমার সঙ্গে কথা বলে গেছে। সে বলেছে, তােমার বাবা-বােন স্কুলে শিক্ষকতা করেন।
তুমি খুলনাতে এমএতে ভর্তি হওয়ার অপেক্ষায় আছাে। তােমার সম্পর্কে আরো অনেক কথাই শুনলাম তার কাছে। শুনতে শুনতে মনে হয়েছে এই ছেলেটিই তাে আমাকে উদ্ধার করতে আসবে। তুমি ছাড়া অন্য কেউ এলে পৃথিবীটা বড় গতানুগতিক হয়ে যেতাে। তখন থেকেই মনের মধ্যে তােমার প্রচ্ছন্ন উপস্থিতি আমাকে ভাবালুতায় নিয়ে গেছে। মনে হয়েছে আমি আর একা নই। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললাে, তােমাকে ঘিরে যে বােধের জন্ম হয়েছে তা কোনো প্রেমের চঞ্চলতা নয়, এ এক নির্ভরতা, এ এক বিশ্বাস। তাই তাে আজ আর তােমায় আপনি বলে কিছুতেই সম্বােধন করতে পারলাম না। হঠাৎ কথা থামিয়ে বলে উঠলাে, সেই তখন থেকে কি বক বক করে যাচ্ছি, আমার মাথা মনে হয় ঠিক নেই।
তােমার খাবার আনতে ভুলে গেছি। দাড়াও বলেই সে এক দৌড়ে হােটেল থেকে পরাটা আর গােশত ভুনা নিয়ে এলাে। তারপর খাবার সাজাতে সাজাতে বললাে, এ খাবারের টাকা কিন্তু আমার দেহ বিক্রির টাকা নয়। খুলনায় আসার সময় মা আমাকে দিয়েছিলাে। দেখলাম তার দুই গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। তার একটি হাত আমার মুঠোর মধ্যে নিয়ে বললাম, কেন নিজেকে অতাে ছোট ভাবছাে? কেন ভাবছাে তুমি শেষ হয়ে গিয়েছাে? তুমি আবার স্বাভাবিক জীবনযাপন করবে। লেখাপড়া করবে। কেন প্রবঞ্চনা করছে। আমার জীবন আর কখনােই স্বাভাবিক হবে না। কেন? কারণ আমি এখন নষ্টা মেয়ে। ঝরা ফুল দিয়ে কখনাে পূজা হয় না। তােমাদের শর্ত অনুসারে যদি তােমাকে বিয়ে করতে চাই তুমি কি আমায় গ্রহণ করবে?
সাথীর জলভরা পুণ্যদৃষ্টির সামনে বড় অসহায় হয়ে পড়েছিলাম। নিজের অজান্তে মুঠোর মধ্যে থাকা তার হাতে মৃদু চাপ দিয়ে বললাম, সাথী, শরীর মসজিদও নয় মন্দিরও নয় যে পাক পবিত্রতার দোহাই পাড়াে। সত্যি কথা বলতে কি তুমি ছাড়া কোনো মেয়ের এতো কাছে কখনােই আসিনি। কিন্তু আমার জীবন সম্পর্কে অনেক ভাবি। এই ভাবনার মধ্যে একজন নারীর উপস্থিতি নিশ্চয় থাকে। যে শরীর থেকেও মানসিকভাবে শুভ্র। তবে হ্যা, আমার জীবনসঙ্গী যে হবে তার প্রতি আমার কিছু প্রত্যাশা তাে থাকবেই।
এই প্রত্যাশার ব্যাপারে আমি খুব কট্টর। এখানে আবেগ কাজ করে না। যুক্তি এখানে সুকঠোর। প্রত্যাশাগুলাে কি? যেমন তাকে অবশ্যই গ্রাজুয়েশন শেষ করতে হবে। আর? হেসে বললাম, আর শুনে কি হবে? তােমার জন্য এই একটা শর্ত বহাল। তােমাকে আপন করে নিতে আমার কোনো দ্বিধা নেই। তবে অবশ্যই তােমাকে ডিগ্রি পাস করতে হবে এবং আমি প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। সাথী কি বুঝলাে সেই জানে। তবে একটু আড়ষ্ট হয়ে গেল।
আমি তার আর একটু কাছে গিয়ে বললাম, প্রেম-ভালো বাসা নিয়ে কাব্য করার মানসিকতা আমার নেই। আমি এখনাে কোনো ভালো বাসায় জড়াইনি। কেন? এখন যাকে ভালো বাসবাে আমি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগেই সে মেয়ের বিয়ে হয়ে যাবে। আর আবেগের বশে তাকে বিয়ে করে দুজনে শুধু শুধু কষ্ট করার পক্ষপাতী আমি নই।। তােমার চাচাতো ভাই ঠিকই বলেছিল। তুমি নাকি রসকষহীন। হ্যা। রাত তখন প্রায় দুটো। বাইরে জামালের সংকেত ধ্বনি পাওয়ার পর সাথী একটা চাবি দিয়ে বললাে, আমি তালার চাবিটি চুরি করে রেখে দিয়েছি।
আমরা রুম থেকে বের হতেই সে আমাদের নিয়ে একটা গলি পথ অনুসরণ করে বললাে, খুব সাবধান, পুলিশ কিন্তু টহল দিচ্ছে। আমি এক হাতে সাথীকে ধরে অন্য হাতে একটা রাম দা নিয়ে এগুচ্ছি। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম মাস্তান পুলিশ যেই সামনে আসুক না কেন বিনা যুদ্ধে নাহি দেবাে সূচাগ্র মেদিনী। শেষ পর্যন্ত নিরাপদেই সাথীকে নিয়ে আতার বােটে উঠলাম।
সাথী আমার পাশে কবুতরের বাচ্চার মতাে কাপছে। তাকে নিয়ে যখন মংলা এলাম তখন ফজরের আজানের সামান্যই বাকি। ভাের হওয়ার আগেই তাকে আতাদের বাসায় রেখে আমরা মামুনের স্টুডিওর ভেতর বসে পরিকল্পনা করলাম আমাদের করণীয়। কিন্তু ভাের হতে না হতেই বুঝতে পারলাম পানি বেশ ঘােলাটে হয়ে গেছে। মংলার যেসব গডফাদার সাথীর স্বাদ নিয়েছে তারা সহজে ছেড়ে দেবে বলে মনে হয় না। যখন বুঝলাম তাকে মংলায় রাখাটাই বিপদ তখন নিয়ে গেলাম আমাদের গ্রামের বাড়ি। হঠাৎ আতা ঘােষণা করলাে সে সাথীকে বিয়ে করতে চায়।
বললাম, ভালো কথা কিন্তু সাথীরও মতামত থাকতে হবে। মংলার পরিস্থিতি এমনই ঘােলাটে হয়ে গেল যে সাথী আমাদের জন্য বড় বিপদের কারণ হয়ে গেল। তখন সব ভুলে গিয়ে আতার সঙ্গে সাথীর বিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়ে গেল। কিন্তু কেন যেন আমার মন এতে সায় দিচ্ছে না। কেবলই মনে হচ্ছে কাজটা ঠিক হচ্ছে না। সাথীর মতামতেরও প্রয়ােজন আছে। শহীদ ও জামাল বললাে, সাথী বিয়ে বসতে না চাইলে তার দায়িত্ব নেবে কে? তাই তাকে বাই ফোর্স আতার সঙ্গেই বিয়ে দিতে হবে। আর তাকে নারায়ণগঞ্জ পৌছে দেয়ারও রিস্ক নিতে চাই না। নারী অপহরণ কেস বড় সাংঘাতিক।
বললাম, বারে, সাথী তখন সত্য ঘটনা বলবে। শহীদ বললাে, পুলিশ বড় সাংঘাতিক। তারা টাকার জন্য নির্দোষ ব্যক্তিকে দোষী করে। আর নারায়ণগঞ্জে কে আমাদের শেলটার দেবে।। পরিস্থিতি যাহােক, সাথীকে ক্রীড়নক বানাতে মন আমার কিছুতেই সায় দিচ্ছিল না। এ মনােভাবের জন্য তারা আমায় ভুল বুঝলাে। তাছাড়া আমার প্রতি সাথীর দুর্বলতাটাও তারা প্রত্যক্ষ করেছে। কিন্তু আমার মনােভাবটা না বুঝে বললাে, সাথীর দায়িত্ব নিতে হলে তােকে একাই নিতে হবে। বড় বড় মাস্তান সব এক জোট হয়েছে, এখন অন্য কোনো ঝামেলা পােহাতে চাই না। একটু ভাবার সময় নিয়ে বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে বিশ্রাম নিতে গিয়ে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম। ঘুম ভাঙলাে মামুন আর বাবুলের ডাকে।
বাবুল বললাে, আবিদ ভাই, তারা সাথীকে আপনার গ্রামের বাড়ি থেকে নিয়ে এসে আতার সঙ্গে বিয়ে দিচ্ছে। বুঝলাম আমাদের মধ্যেই দুটো দল হয়ে গেছে। কেউ আমার মতকে প্রাধান্য দিতে চায় কেউ শহীদ ও জামালের। শেষ বিকেলে শহীদ মামুনের স্টুডিওতে বেজার মুখে ঢুকে বললাে, আবিদ এর মধ্যে আমি আর নেই। খানকিটা আতাকে বিয়ে করতে রাজি হচ্ছে না। বলে প্রয়োজনে তাকে আবার পাড়ায় রেখে আসতে। তবুও সে আতাকে বিয়ে করবে না। এ কথা শােনার পর আতার বাসায় যাওয়া মাত্র সাথী আমায় দেখে দৌড়ে এসে আমার কলার চেপে ধরে বললাে, আমায় যদি রক্ষা করতে না পারাে তবে পাড়ায় রেখে এসাে। সবার সামনে সাথীর এ আচরণ আমাকে ও সাথীকে দোষী সাব্যস্ত করে বিচার করা শুরু করলাে। আতার বাসার সবাই সাথীকে বললাে, আবিদকে বিয়ে করার কথা ভুলেও মনে এনাে না। তার বাবা একটা বাঘ। তােমার কথা শুনলেই আবিদকে ত্যাজ্য করবে।
তুমি কি তার জীবনটা ধ্বংস করতে চাও? তােমাকে উদ্ধার করার এই ফল পাবে সে? নিজেকে অসহায় মনে হচ্ছে। এই প্রথম পরিস্থিতি আমায় ভিকটিম করেছে। সাথীকে নিয়ে বিদ্রোহী হবাে সে অবস্থা এখন নেই। এরই মাঝে মােবাইলে খবর পেলাম ভােরেই মাস্টার্সের রেজিস্ট্রেশনের জন্য খুলনায় যেতে হবে। জীবনে যা-ই করি না কেন মাস্টার্সটা সম্পূর্ণ করতেই হবে। আর এ ব্যাপারে কোনো আপস নেই। তাই সাথীকে নির্জনে ডেকে বললাম, এখন তােমায় গ্রহণ করতে গেলে আমাকে চরম ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। আমি চাই না আমার জীবনের কোনো অনিষ্টের জন্য তােমাকে দায়ী করি। সত্যি বলতে কি তােমার প্রতি আমার যে অনুভূতি তা ভালো বাসা নাকি অনুকম্পা সেটা আমার কাছে বেশ দুর্বোধ্য।
তাছাড়া আতা খুব ভালো ছেলে। নামাজি। কয়েক পারা কোরআন মুখস্থ, সর্বোপরি সে তােমায় মনে হয় গভীরভাবে ভালো বাসে। তােমার ব্যাপারে তার আগ্রহটাই বেশি ছিল। আর আমার উপদেশ হলাে, যে তােমাকে ভালো বাসে তাকে বিয়ে করাে আর যাকে তুমি যা ভেবে ভালো বাসতে যাচ্ছাে সে তা নাও হতে পারে। আমার কথাগুলাে নীরবে শুনে শুধু বললাে, আমাকে আবার পতিতালয়ে রেখে আসা যায় না? এ কথা শুনে নির্বাক হয়ে চেয়ে রইলাম। অনেকক্ষণ নিশ্রুপ থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শুধু বলতে পারলাে, পাড়াতে আমার তবু খদ্দের নির্বাচন করার স্বাধীনতা ছিল। মুক্তি পেতে গিয়ে সেটুকুও হারালাম। তারপর আমার হাত দুটো ধরে বললাে, আমার এক রাতের ভালো বাসা আজীবনের পাথেয় করে প্রমাণ করবাে বেশ্যারাও ভালো বাসতে পারে। আমাকে আর কিছু বলার সুযােগ না দিয়ে ঘরে ঢুকে ঘােষণা করলাে এখনই যদি বিয়ে হয় তাহলে সে রাজি নইলে সে আবার পাড়ায় যাবে বা আত্মহত্যা করবে।
সে সন্ধ্যায় আতা ও সাথীর বিয়ে হলাে, আমি নীরব দর্শক। একটা দম বন্ধ অবস্থা আমায় বিষন্ন করে। রাখলাে। সবাই মনে করলে আমি সাথীর ভালো বাসায় পাগলপ্রায়। অথচ আমার আবাল্য বন্ধুরা আমাকে বুঝতে চাইলাে না, আমায় অপরাধী সাব্যস্ত করে দণ্ড দিল অসহায় মেয়েটিকে। আর আমি পরাজিতের মতাে মেনে নিলাম সবকিছু।। তাদের সংসার খুব সুখের হয়েছে। একটা কন্যা সন্তান নিয়ে তাদের দিন ভালো ই কাটছে। আতা আজ বুঝতে পেরেছে, আমি সাথীকে ভালো বাসিনি, শুধু চেয়েছিলাম তার একটা গতি হােক তার মনের মতাে করে। তবে দুঃখ এই, সাথী আমায় দেখলে আজো কঠিন হয়ে যায়।
সম্মায়ের বােন তাকে খুলনায় বেড়ানোর কথা বলে এখানে বিক্রি করে গেছে। মেয়েটি নবম শ্রেণীতে পড়ে। আরো শুনলাম, দেহ ব্যবসায় রাজি না হওয়াতে প্রথমে লাঠি দিয়ে মেরেছে।পরে নখের মধ্যে কাটা ঢুকিয়েও তাকে বাধ্য করতে পারেনি। অবশেষে তাকে না খাইয়ে রাখা হয়। দুইদিন খেয়ে থাকার পরে সে ক্ষিধের কাছে নতি স্বীকার করে।
বানিয়াশান্তায় এখন তার একচেটিয়া বাজার। খদ্দেররা নাকি লাইনে দাড়িয়ে থাকে তাকে একবার চোখে দেখার জন্য। আমার এক মাসের ছোট চাচাতো ভাই আতাউর রহমান আতা নদীতে বােট চালায়। সে প্রায়ই বানিয়াশান্তায় যায় প্যাসেঞ্জার নিয়ে। আতা মেয়েটিকে দেখেছে এবং তার এক বন্ধু মেয়েটির কাছে গিয়েছিল। মেয়েটি ছেলেটিকে ভাই ডেকে সেখান থেকে উদ্ধারের জন্য ছেলেটির পা ধরে কেদেছে। আরো বলেছে, সে নাকি অনেক লোককে উদ্ধারের জন্য মিনতি করলেও আজ পর্যন্ত কেউ এগিয়ে আসেনি।
মেয়েটির কান্না দেখে সে কথা দিয়ে এসেছে তাকে উদ্ধারের একটা চেষ্টা সে করবে। পতিতা পল্লী সম্পর্কে যাদের ধারণা আছে তারা জানে প্রতিটা পল্লী মাস্তান এবং পুলিশ দ্বারা কিভাবে আচ্ছাদিত থাকে। পুলিশ এখানে আইনের প্রয়োগ না করে ক্ষমতা ব্যবহার করে দালাল ও ভেড় য়া বনে যায়। তারা ভালো করেই জানে কিভাবে একটা মেয়েকে পতিতা বানাতে হয়। বলা বাহুল্য, প্রতিটি নতুন মেয়েকে প্রথমে ভাড় যা তারপর যথাক্রমে পুলিশ ও সাংবাদিক ভাগ করে। চাইলেই কেউ সেখান থেকে কোনো মেয়েকে উদ্ধার করতে পারে না। আর তাই ছেলেটি আমাদের শরণাপন্ন হয়েছে।
আমরা কোনো বড় মাস্তান বা ক্ষমতাধারী নই, নিতান্তই সাধারণ। তবে আমি ও আমার বন্ধুরা মনে করি কবি শুধু কলম ধরে সমাজ সংস্কার করবে না প্রয়োজনে ছুরি-বন্দুকও ধরবে।
তাই কি মাস্তান কি ক্ষমতাবান, সবাই আমাদের কেমন যেন দৃষ্টিতে দেখে। এই কিছুটা টক মিষ্টি ঝাল টাইপ দৃষ্টি আর কি। ছোট ভাইদের কথায় কোনো ঝুঁকি নেয়া ঠিক হবে না ভেবে আমরা আলােচনায় বসলাম। বানিয়াশান্তায় যাওয়ার আগে বন্ধুরা আমাকে বললাে, আবিদ, ভালো করে ভেবে দেখ। এতো বড় রিস্ক নিবি কি না।
যদি পুলিশের কাছে ধরা পড়ি তারা হাজতে পুরবে। সঙ্গে মাস্তানদের নির্যাতন। তাছাড়া সবাই জানবে আমরা সত্যিই খারাপ। শুধু ভদ্রতার ভান করি। নারী সম্ভোগে এসে ঝামেলা বাধিয়ে এখন থানা হাজতে আছি। তাছাড়া মেয়েটিকে এনেই বা কি করবা? মেয়েটি যদি স্বজনদের কাছে ফিরে যেতে না চায়? আমি বললাম, মেয়েটিকে তিনটি শর্ত দেবাে। যদি সে শর্তগুলাে মানে তবেই তার জন্য রিস্ক নেবাে।
প্রথম শর্ত সে বাড়ি যেতে চাইলে তাকে বাড়ি পাঠিয়ে দেবাে কিন্তু বাড়ির পরিস্থিতি যা-ই হােক আমরা আর কোনো দায়িত্ব নেবাে না। দ্বিতীয় শর্ত সে বাড়ি যেতে না চাইলে তাকে এখান থেকে লেখাপড়া করতে হবে। এ ব্যাপারে আমার মিশনারিজ স্কুলের এক শিক্ষকের সঙ্গে কথা হয়েছে। তিনি বলেছেন, মেয়েটিকে স্কুল হস্টেলে রেখে লেখাপড়ার সব ব্যবস্থা তিনি করবেন। তৃতীয় শর্ত হলাে সে যাকে ইচ্ছে তাকে বিয়ে করতে পারবে।
তবে সে যাকে বিয়ে করতে চাইবে সেই ছেলেরও তাকে বিয়ে করার মানসিকতা থাকতে হবে। তা না হলে অবশ্যই তাকে বাড়ি যেতে হবে। মেয়েটি সম্পর্কে পরিকল্পনা স্থির করে আমরা তিন বন্ধু মিলে বানিয়াশান্তায় গেলাম। সামান্য পরিচিতি ও বড়দের স্নেহধন্য হওয়ায় এসব এলাকা যে কতােটা বিব্রতকর তা স্থানীয় ছেলেরা জানে। আতার বােটে করে খুব গােপনে মেয়েটি যে বাড়ি থাকে সেই বাড়ির সামনে নেমে দ্রুত চলে গেলাম বাড়ির পেছনে। সেখানে একটা বসার ঘরে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর মেয়েটি এলাে। মেয়েটিকে দেখে বুঝলাম কেন মানুষ লাইন ধরে দাড়িয়ে থাকে তাকে ভােগের আশায়।
হরিণের মাংসই যে হরিণের শত্রু! এই মাত্র সে একজনকে সঙ্গ দিয়ে আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। পতিতালয়ের সাবলীলতা এখনাে তাকে গ্রাস করতে পারেনি। সে কিছুটা জড়ােসড়াে। শহীদ খদ্দের সেজে তার রুমে গিয়ে বুঝিয়ে এলাে কিভাবে তাকে এখান থেকে নিয়ে যাবাে এবং শর্তগুলাের ব্যাপারে বিশেষভাবে সতর্ক করা হলাে।
সাথী ভেবেছিল আজই তাকে নিয়ে যাবাে। যখন শুনলাে আজকে আমরা এসেছি শুধু পরিস্থিতি ও রাতের বেলা কোন রাস্তা দিয়ে বের হবাে তা পর্যবেক্ষণ করতে, তখন সে কিছুটা বিষন্ন হয়ে গেল। ফিরে আসার পথে বলে এলাম, সাথী, এতো দিন যখন সহ্য করেছে আর এক দুইদিন একটু সহ্য করাে। তােমাকে আমরা পরশু রাতে নিয়ে যাবাে।
সে আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে শুধু বললাে, আমার কেবলি মনে হতাে কেউ আমাকে উদ্ধার করবেই। এতো কষ্টের পরও বাচতে বড় সাধ জাগে। বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে আমার জীবন বিবর্ণ হলেও পৃথিবীটা তাে বিবর্ণ নয়। আমি কি তার একটুও রঙ নিয়ে আবার বাচতে পারবাে না? শরীর থেকেও মৃত্যুকে ভয় পাই নাকি জীবনকে ভালো বাসি জানি না।
বেচে থাকতে মূল্য দিচ্ছি শরীর দিয়ে। আল্লাহর প্রতি অভিযােগ নেই। বৈচিত্রকে সমুন্নত রাখতে তিনি সচেষ্ট। তবে আমারও একটা সহ্যসীমা আছে। ধরুন আগামী পরশু অর্থাৎ বৃহস্পতিবারই হবে আমার শেষ দিন। আপনারা এলে বেচে থাকার জন্য শেষ লােভটুকু করবাে। তা না হলে শুক্রবার দিনটা তাে শুভ রইলােই। আর কোনো কথা না বলে অপেক্ষারত এক কাস্টমারকে হাতের ইশারায় ডেকে ঘরে দুয়ার দিল। বৃহস্পতিবার প্ল্যান করা হলাে আমি খদ্দের সেজে সারা রাতের জন্য সাথীকে বুক করবাে। আর রাতের যে কোনো এক সময় সুযােগ বুঝে বন্ধুরা সাথীর রুমের তালা ভেঙে আমাদের মুক্ত করবে।
রাতের বেলা প্রতিটি রুমের বাইরে থেকে তালা বন্ধ করে রাখা হয়। চাপা উত্তেজনা ও অস্বস্তি নিয়ে শেষ বিকেলে আতার বােটে নদী পার হয়ে এলাম বানিয়াশান্তায়। সঙ্গে ছয় বন্ধু কিছু লাঠি ও কয়েকটি রামদা নিলাম। সবাইকে বােটে রেখে আমি আর জামাল খদ্দের সেজে সাথী যে বাড়ি থাকে সেই মাসির কাছে গেলাম। দেখি মাসির পাশেই সাথী উদ্বিগ্ন অবস্থায় বসে আছে। আমাকে। দেখেই যেন প্রশান্তিতে ভরে গেল সে। দরদাম ঠিক করে সাথীকে নিয়ে যখন রুমে গেলাম তখন জামাল অন্য মেয়ের কাছে যাবার অজুহাতে পরিস্থিতি নিরূপণ করতে চলে গেল। সাথীকে নিয়ে যখন রুমে ঢুকলাম তখন রাত প্রায় নয়টা।
রুমে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে সাথী আলতাে করে আমায় জড়িয়ে ধরে বললাে, সারাটি দিন যে কতাে শংকার মাঝে কেটেছে তা বলতে পারবাে না। শুধু মনে হচ্ছিল তুমি আসবে না। অথবা তুমি আসার আগেই অন্য কেউ আমাকে সারা রাতের জন্য নির্বাচন করবে। বলতে বলতে কেদে ফেললাে সে। একটা ওড়না দেখিয়ে বললাে, কাল ভােরে ওই ওড়নাটা গলায় পেচিয়ে ঝুলে পড়তাম। তার মাথায় আলতাে করে হাত বুলিয়ে বললাম, শান্ত হও। এসেই যখন পড়েছি তখন এখান থেকে তােমাকে নিয়ে যাবােই।
তার আগে আমাদের শর্তগুলাে তােমাকে আর একবার মনে করিয়ে দিতে চাই। আমার সব শর্ত মনে আছে। গত পরশু থেকে তােমাদের কথা যতাে ভেবেছি ততােই আমি খেই হারিয়ে ফেলেছি। কেন? এই কয়েকদিনের বাস্তবতায় মানুষের প্রতি বিশ্বাস আমার শেষ হয়ে গিয়েছিল। যখন দেখলাম শুধু আমাকে উদ্ধার করার জন্য মান-সম্মান বাজি রেখে বানিয়াশান্তায় প্রথম এলে তখন আমি দিশেহারা হয়ে গেলাম।। তােমাকে কে বললাে যে আমি ওই দিনই এখানে প্রথম এসেছি। তােমার চাচাতো ভাই আতা কাল এখানে অনেকক্ষণ আমার সঙ্গে কথা বলে গেছে। সে বলেছে, তােমার বাবা-বােন স্কুলে শিক্ষকতা করেন।
তুমি খুলনাতে এমএতে ভর্তি হওয়ার অপেক্ষায় আছাে। তােমার সম্পর্কে আরো অনেক কথাই শুনলাম তার কাছে। শুনতে শুনতে মনে হয়েছে এই ছেলেটিই তাে আমাকে উদ্ধার করতে আসবে। তুমি ছাড়া অন্য কেউ এলে পৃথিবীটা বড় গতানুগতিক হয়ে যেতাে। তখন থেকেই মনের মধ্যে তােমার প্রচ্ছন্ন উপস্থিতি আমাকে ভাবালুতায় নিয়ে গেছে। মনে হয়েছে আমি আর একা নই। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললাে, তােমাকে ঘিরে যে বােধের জন্ম হয়েছে তা কোনো প্রেমের চঞ্চলতা নয়, এ এক নির্ভরতা, এ এক বিশ্বাস। তাই তাে আজ আর তােমায় আপনি বলে কিছুতেই সম্বােধন করতে পারলাম না। হঠাৎ কথা থামিয়ে বলে উঠলাে, সেই তখন থেকে কি বক বক করে যাচ্ছি, আমার মাথা মনে হয় ঠিক নেই।
তােমার খাবার আনতে ভুলে গেছি। দাড়াও বলেই সে এক দৌড়ে হােটেল থেকে পরাটা আর গােশত ভুনা নিয়ে এলাে। তারপর খাবার সাজাতে সাজাতে বললাে, এ খাবারের টাকা কিন্তু আমার দেহ বিক্রির টাকা নয়। খুলনায় আসার সময় মা আমাকে দিয়েছিলাে। দেখলাম তার দুই গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। তার একটি হাত আমার মুঠোর মধ্যে নিয়ে বললাম, কেন নিজেকে অতাে ছোট ভাবছাে? কেন ভাবছাে তুমি শেষ হয়ে গিয়েছাে? তুমি আবার স্বাভাবিক জীবনযাপন করবে। লেখাপড়া করবে। কেন প্রবঞ্চনা করছে। আমার জীবন আর কখনােই স্বাভাবিক হবে না। কেন? কারণ আমি এখন নষ্টা মেয়ে। ঝরা ফুল দিয়ে কখনাে পূজা হয় না। তােমাদের শর্ত অনুসারে যদি তােমাকে বিয়ে করতে চাই তুমি কি আমায় গ্রহণ করবে?
সাথীর জলভরা পুণ্যদৃষ্টির সামনে বড় অসহায় হয়ে পড়েছিলাম। নিজের অজান্তে মুঠোর মধ্যে থাকা তার হাতে মৃদু চাপ দিয়ে বললাম, সাথী, শরীর মসজিদও নয় মন্দিরও নয় যে পাক পবিত্রতার দোহাই পাড়াে। সত্যি কথা বলতে কি তুমি ছাড়া কোনো মেয়ের এতো কাছে কখনােই আসিনি। কিন্তু আমার জীবন সম্পর্কে অনেক ভাবি। এই ভাবনার মধ্যে একজন নারীর উপস্থিতি নিশ্চয় থাকে। যে শরীর থেকেও মানসিকভাবে শুভ্র। তবে হ্যা, আমার জীবনসঙ্গী যে হবে তার প্রতি আমার কিছু প্রত্যাশা তাে থাকবেই।
এই প্রত্যাশার ব্যাপারে আমি খুব কট্টর। এখানে আবেগ কাজ করে না। যুক্তি এখানে সুকঠোর। প্রত্যাশাগুলাে কি? যেমন তাকে অবশ্যই গ্রাজুয়েশন শেষ করতে হবে। আর? হেসে বললাম, আর শুনে কি হবে? তােমার জন্য এই একটা শর্ত বহাল। তােমাকে আপন করে নিতে আমার কোনো দ্বিধা নেই। তবে অবশ্যই তােমাকে ডিগ্রি পাস করতে হবে এবং আমি প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। সাথী কি বুঝলাে সেই জানে। তবে একটু আড়ষ্ট হয়ে গেল।
আমি তার আর একটু কাছে গিয়ে বললাম, প্রেম-ভালো বাসা নিয়ে কাব্য করার মানসিকতা আমার নেই। আমি এখনাে কোনো ভালো বাসায় জড়াইনি। কেন? এখন যাকে ভালো বাসবাে আমি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগেই সে মেয়ের বিয়ে হয়ে যাবে। আর আবেগের বশে তাকে বিয়ে করে দুজনে শুধু শুধু কষ্ট করার পক্ষপাতী আমি নই।। তােমার চাচাতো ভাই ঠিকই বলেছিল। তুমি নাকি রসকষহীন। হ্যা। রাত তখন প্রায় দুটো। বাইরে জামালের সংকেত ধ্বনি পাওয়ার পর সাথী একটা চাবি দিয়ে বললাে, আমি তালার চাবিটি চুরি করে রেখে দিয়েছি।
আমরা রুম থেকে বের হতেই সে আমাদের নিয়ে একটা গলি পথ অনুসরণ করে বললাে, খুব সাবধান, পুলিশ কিন্তু টহল দিচ্ছে। আমি এক হাতে সাথীকে ধরে অন্য হাতে একটা রাম দা নিয়ে এগুচ্ছি। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম মাস্তান পুলিশ যেই সামনে আসুক না কেন বিনা যুদ্ধে নাহি দেবাে সূচাগ্র মেদিনী। শেষ পর্যন্ত নিরাপদেই সাথীকে নিয়ে আতার বােটে উঠলাম।
সাথী আমার পাশে কবুতরের বাচ্চার মতাে কাপছে। তাকে নিয়ে যখন মংলা এলাম তখন ফজরের আজানের সামান্যই বাকি। ভাের হওয়ার আগেই তাকে আতাদের বাসায় রেখে আমরা মামুনের স্টুডিওর ভেতর বসে পরিকল্পনা করলাম আমাদের করণীয়। কিন্তু ভাের হতে না হতেই বুঝতে পারলাম পানি বেশ ঘােলাটে হয়ে গেছে। মংলার যেসব গডফাদার সাথীর স্বাদ নিয়েছে তারা সহজে ছেড়ে দেবে বলে মনে হয় না। যখন বুঝলাম তাকে মংলায় রাখাটাই বিপদ তখন নিয়ে গেলাম আমাদের গ্রামের বাড়ি। হঠাৎ আতা ঘােষণা করলাে সে সাথীকে বিয়ে করতে চায়।
বললাম, ভালো কথা কিন্তু সাথীরও মতামত থাকতে হবে। মংলার পরিস্থিতি এমনই ঘােলাটে হয়ে গেল যে সাথী আমাদের জন্য বড় বিপদের কারণ হয়ে গেল। তখন সব ভুলে গিয়ে আতার সঙ্গে সাথীর বিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়ে গেল। কিন্তু কেন যেন আমার মন এতে সায় দিচ্ছে না। কেবলই মনে হচ্ছে কাজটা ঠিক হচ্ছে না। সাথীর মতামতেরও প্রয়ােজন আছে। শহীদ ও জামাল বললাে, সাথী বিয়ে বসতে না চাইলে তার দায়িত্ব নেবে কে? তাই তাকে বাই ফোর্স আতার সঙ্গেই বিয়ে দিতে হবে। আর তাকে নারায়ণগঞ্জ পৌছে দেয়ারও রিস্ক নিতে চাই না। নারী অপহরণ কেস বড় সাংঘাতিক।
বললাম, বারে, সাথী তখন সত্য ঘটনা বলবে। শহীদ বললাে, পুলিশ বড় সাংঘাতিক। তারা টাকার জন্য নির্দোষ ব্যক্তিকে দোষী করে। আর নারায়ণগঞ্জে কে আমাদের শেলটার দেবে।। পরিস্থিতি যাহােক, সাথীকে ক্রীড়নক বানাতে মন আমার কিছুতেই সায় দিচ্ছিল না। এ মনােভাবের জন্য তারা আমায় ভুল বুঝলাে। তাছাড়া আমার প্রতি সাথীর দুর্বলতাটাও তারা প্রত্যক্ষ করেছে। কিন্তু আমার মনােভাবটা না বুঝে বললাে, সাথীর দায়িত্ব নিতে হলে তােকে একাই নিতে হবে। বড় বড় মাস্তান সব এক জোট হয়েছে, এখন অন্য কোনো ঝামেলা পােহাতে চাই না। একটু ভাবার সময় নিয়ে বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে বিশ্রাম নিতে গিয়ে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম। ঘুম ভাঙলাে মামুন আর বাবুলের ডাকে।
বাবুল বললাে, আবিদ ভাই, তারা সাথীকে আপনার গ্রামের বাড়ি থেকে নিয়ে এসে আতার সঙ্গে বিয়ে দিচ্ছে। বুঝলাম আমাদের মধ্যেই দুটো দল হয়ে গেছে। কেউ আমার মতকে প্রাধান্য দিতে চায় কেউ শহীদ ও জামালের। শেষ বিকেলে শহীদ মামুনের স্টুডিওতে বেজার মুখে ঢুকে বললাে, আবিদ এর মধ্যে আমি আর নেই। খানকিটা আতাকে বিয়ে করতে রাজি হচ্ছে না। বলে প্রয়োজনে তাকে আবার পাড়ায় রেখে আসতে। তবুও সে আতাকে বিয়ে করবে না। এ কথা শােনার পর আতার বাসায় যাওয়া মাত্র সাথী আমায় দেখে দৌড়ে এসে আমার কলার চেপে ধরে বললাে, আমায় যদি রক্ষা করতে না পারাে তবে পাড়ায় রেখে এসাে। সবার সামনে সাথীর এ আচরণ আমাকে ও সাথীকে দোষী সাব্যস্ত করে বিচার করা শুরু করলাে। আতার বাসার সবাই সাথীকে বললাে, আবিদকে বিয়ে করার কথা ভুলেও মনে এনাে না। তার বাবা একটা বাঘ। তােমার কথা শুনলেই আবিদকে ত্যাজ্য করবে।
তুমি কি তার জীবনটা ধ্বংস করতে চাও? তােমাকে উদ্ধার করার এই ফল পাবে সে? নিজেকে অসহায় মনে হচ্ছে। এই প্রথম পরিস্থিতি আমায় ভিকটিম করেছে। সাথীকে নিয়ে বিদ্রোহী হবাে সে অবস্থা এখন নেই। এরই মাঝে মােবাইলে খবর পেলাম ভােরেই মাস্টার্সের রেজিস্ট্রেশনের জন্য খুলনায় যেতে হবে। জীবনে যা-ই করি না কেন মাস্টার্সটা সম্পূর্ণ করতেই হবে। আর এ ব্যাপারে কোনো আপস নেই। তাই সাথীকে নির্জনে ডেকে বললাম, এখন তােমায় গ্রহণ করতে গেলে আমাকে চরম ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। আমি চাই না আমার জীবনের কোনো অনিষ্টের জন্য তােমাকে দায়ী করি। সত্যি বলতে কি তােমার প্রতি আমার যে অনুভূতি তা ভালো বাসা নাকি অনুকম্পা সেটা আমার কাছে বেশ দুর্বোধ্য।
তাছাড়া আতা খুব ভালো ছেলে। নামাজি। কয়েক পারা কোরআন মুখস্থ, সর্বোপরি সে তােমায় মনে হয় গভীরভাবে ভালো বাসে। তােমার ব্যাপারে তার আগ্রহটাই বেশি ছিল। আর আমার উপদেশ হলাে, যে তােমাকে ভালো বাসে তাকে বিয়ে করাে আর যাকে তুমি যা ভেবে ভালো বাসতে যাচ্ছাে সে তা নাও হতে পারে। আমার কথাগুলাে নীরবে শুনে শুধু বললাে, আমাকে আবার পতিতালয়ে রেখে আসা যায় না? এ কথা শুনে নির্বাক হয়ে চেয়ে রইলাম। অনেকক্ষণ নিশ্রুপ থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শুধু বলতে পারলাে, পাড়াতে আমার তবু খদ্দের নির্বাচন করার স্বাধীনতা ছিল। মুক্তি পেতে গিয়ে সেটুকুও হারালাম। তারপর আমার হাত দুটো ধরে বললাে, আমার এক রাতের ভালো বাসা আজীবনের পাথেয় করে প্রমাণ করবাে বেশ্যারাও ভালো বাসতে পারে। আমাকে আর কিছু বলার সুযােগ না দিয়ে ঘরে ঢুকে ঘােষণা করলাে এখনই যদি বিয়ে হয় তাহলে সে রাজি নইলে সে আবার পাড়ায় যাবে বা আত্মহত্যা করবে।
সে সন্ধ্যায় আতা ও সাথীর বিয়ে হলাে, আমি নীরব দর্শক। একটা দম বন্ধ অবস্থা আমায় বিষন্ন করে। রাখলাে। সবাই মনে করলে আমি সাথীর ভালো বাসায় পাগলপ্রায়। অথচ আমার আবাল্য বন্ধুরা আমাকে বুঝতে চাইলাে না, আমায় অপরাধী সাব্যস্ত করে দণ্ড দিল অসহায় মেয়েটিকে। আর আমি পরাজিতের মতাে মেনে নিলাম সবকিছু।। তাদের সংসার খুব সুখের হয়েছে। একটা কন্যা সন্তান নিয়ে তাদের দিন ভালো ই কাটছে। আতা আজ বুঝতে পেরেছে, আমি সাথীকে ভালো বাসিনি, শুধু চেয়েছিলাম তার একটা গতি হােক তার মনের মতাে করে। তবে দুঃখ এই, সাথী আমায় দেখলে আজো কঠিন হয়ে যায়।
আরো নতুন নতুন valobasar Golpo পড়তে ভিজিট করুন
উত্তরমুছুনWWW.VALOBASARGOLPO2.XYZ
ভালবাসার এস এম এস
উত্তরমুছুনভালোবাসার কষ্টের গল্প কাহিনী
Bangla Love Sms 2021
রোমান্টিক প্রেমের গল্প
সত্যিকারের ভালবাসার গল্প